ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলা ক্রিকেটারদের অধিকার, মনে করেন ক্লাইভ লয়েড
১৯৮৩ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপজয়ী ভারতীয় ক্রিকেটারদের ম্যাচ ফি কত ছিল?
পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক রমিজ রাজা গত বছর ভারতীয় ক্রিকেটারদের পে স্লিপের ছবি পোস্ট করেছিলেন টুইটারে। সে সময় সুনীল গাভাস্কার, কপিল দেব, সন্দীপ পাতিলরা প্রতি ম্যাচে ম্যাচ ফি পেয়েছিলেন ২ হাজার ১০০ রুপি করে।
যদিও ১৯৮৩ সালের হিসাবে ম্যাচপ্রতি ২ হাজার ১০০ রুপি খুব খারাপ অঙ্ক ছিল না, কিন্তু তারপরও অন্যান্য খেলার তুলনায় এই অর্থ ছিল নিতান্তই অপ্রতুল। রমিজ রাজা ১৯৮৬ সালে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের একটি সফরের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, সেই সফরে টেস্ট ও ওয়ানডে সিরিজ খেলে তিনি আয় করেছিলেন সাকল্যে ৫৫ হাজার রুপি। একটা সিরিজ খেলে একজন ক্রিকেটার আয় করছেন মাত্র ৫৫ হাজার রুপি—আজকের দিনে এমনটা অবিশ্বাস্য।
যখন এনবিএতে মাইকেল জর্ডান প্রতি মাসে মিলিয়ন ডলার রোজগার করেন, যখন অন্য খেলার খেলোয়াড়েরা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার দাম হাঁকান, তখন ক্রিকেটাররা যদি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলে একটা ভালো অঙ্কের রোজগার করে, সেটি নিয়ে আপনি কেন সমালোচনা করবেন? ক্রিকেট খেলাটা অন্য অন্য খেলার চেয়ে ভিন্ন কেন হবে?
সত্তরের দশকের শেষ দিকে বিশ্বের অনেক শীর্ষ ক্রিকেটারই অস্ট্রেলিয়ায় ক্যারি প্যাকার সিরিজ খেলতে গিয়েছিলেন। ধনকুবের প্যাকার তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত বিশ্ব সিরিজ ক্রিকেট ও সুপার টেস্টে খেলতে শীর্ষ ক্রিকেটারদের যে অর্থ দিয়েছিলেন, সেটি তাঁদের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। সে কারণে নিষেধাজ্ঞার খড়্গ মাথায় নিয়েও ক্রিকেটাররা খেলতে গিয়েছিলেন প্যাকারের বিশ্ব সিরিজ ক্রিকেটে। নিষিদ্ধও হয়েছিলেন তাঁরা। যদিও এই বিশ্ব সিরিজ ক্রিকেটের দিগন্ত পাল্টে দিয়েছিল অনেক ক্ষেত্রেই।
হালে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট ক্রিকেটারদের আর্থিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। যদিও সত্তর–আশির দশকের আর্থিক পরিস্থিতি থেকে ক্রিকেট বেরিয়ে এসেছিল অনেক আগেই। কিন্তু সেই অর্থের পরিমাণ অন্য খেলার তুলনায় পিছিয়ে ছিলই। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট ক্রিকেটারদের রোজগার বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকটাই। আইপিএল এখন বিশ্বের সবচেয়ে অর্থকরি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগ, ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট চালু হয়েছে ক্রিকেট খেলুড়ে প্রায় প্রতিটি দেশই। সারা বছরজুড়েই চলে বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের আসর। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগ যেহেতু ক্রিকেটারদের আর্থিক দিক দিয়ে লাভবান করে, এটি যেহেতু দ্রুত ও একসঙ্গে অনেক টাকা আয় করার জায়গা, তাই ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটকে এখন অনেক ক্রিকেটারই প্রাধান্য দিচ্ছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে টানা দুটি বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট নিয়ে ক্রিকেটারদের আগ্রহে কোনো সমস্যা দেখেন না। তিনি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রে এনবিএ কিংবা এনএফএলে প্রতি মাসে খেলোয়াড়েরা যদি মিলিয়ন ডলার কামাতে পারেন, তাহলে ক্রিকেটাররা ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলে টাকা কামালে দোষ কোথায়। তবে লয়েড দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলাকে প্রাধান্য দিতে চান। তিনি চান, ক্রিকেটাররা ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেললেও তাঁরা যেন দেশের হয়ে খেলাকেই প্রাধান্য দেন।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম রিভস্পোর্টসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ক্যারিবীয় কিংবদন্তি স্মরণ করেছেন ১৯৭৭ সালের সেই ক্যারি প্যাকার সিরিজ। তিনি বলেছেন, নিজেদের মূল্যটা ওই সময়কার ক্রিকেটাররা বুঝতে পারেননি বলেই তাঁরা ক্যারি প্যাকার সিরিজে খেলতে গিয়েছিলেন, ‘আমি মনে করি, আমরা সেই সময় নিজেদের মূল্যটা বুঝিনি, সে কারণেই ক্যারি প্যাকার সিরিজ খেলতে গিয়েছিলাম। এখনকার ক্রিকেটাররা খুব ভালো করেই জানে, তারা কতটা মূল্যবান। আমার কথা, আইপিএল বা ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটকে যদি তারা গুরুত্ব দেয়, তাতে দোষের কিছু নেই। আমাদের উচিত ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলোয়াড়েরা যেন ভালোমতো খেলতে পারে, সে জন্য সুযোগ করে দেওয়া। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলার জন্য বছরের নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে দেওয়া উচিত।’
ভালো রোজগার ক্রিকেটারদের অধিকার বলেই মনে করেন লয়েড, ‘এটা ক্রিকেটারদের অধিকার। একজন খেলোয়াড় তাঁর জীবনের সেরা সময়টা খেলার পেছনে ব্যয় করে এবং সেই সময়টা খুব দীর্ঘস্থায়ী কিছু নয়, এ জন্য কেন তারা ভালো রোজগার করবে না?’
ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলাটা দোষের কিছু নয় বলেই মনে করেন লয়েড, ‘যখন এনবিএতে মাইকেল জর্ডান প্রতি মাসে মিলিয়ন ডলার রোজগার করেন, যখন অন্য খেলার খেলোয়াড়েরা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার দাম হাঁকান, তখন ক্রিকেটাররা যদি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলে একটা ভালো অঙ্কের রোজগার করে, সেটি নিয়ে আপনি কেন সমালোচনা করবেন? ক্রিকেট খেলাটা অন্য অন্য খেলার চেয়ে ভিন্ন কেন হবে?’
বিশ্বকাপজয়ী ক্যারিবীয় অধিনায়ক তারপরও দেশের হয়ে খেলাকেই প্রাধান্য দিতে চান, ‘ক্রিকেটাররা ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলুক, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সেটি করতে হবে দেশের হয়ে খেলাকে প্রাধান্য দিয়েই।’
ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের জন্যই ওয়েস্ট ইন্ডিজ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভুগছে। এমনটা ভাবার মানুষের অভাব নেই। সুনীল নারাইন, আন্দ্রে রাসেল, ক্রিস গেইল, কাইরন পোলার্ডদের মতো ক্রিকেটাররা অনেক সময় ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলার জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলা বাদ দিয়েছেন। দুনিয়াজুড়েই ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটারদের চাহিদা ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে থাকায় বিপাকে পড়ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। ব্যাপারটা দুর্ভাগ্যজনকই মনে করেন লয়েড। তবে এটা কেন হচ্ছে, সেটির ব্যাখ্যাও দিয়েছেন, ‘দেখুন ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের জনসংখ্যা খুব কম। আমাদের খুব বেশি খেলোয়াড় নেই। আমরা যদি ২০ জন ভালো ক্রিকেটার তৈরি করি, তাহলে ১০ জনকে হারাই। এটা মোটেও সুখকর কিছু নয় ক্যারিবীয় ক্রিকেটের জন্য। আমরা চাই আমাদের সেরা ক্রিকেটাররাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলুক। কিন্তু এ জন্য পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে, যেন ক্রিকেটাররা দেশের হয়ে খেলতে মুখিয়ে থাকে।’