ধারাভাষ্য কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসেই সামনে মোহাম্মদ আশরাফুলকে পেয়ে গেলেন ওয়াকার ইউনিস। কিছুদিন আগেই দুজন দক্ষিণ আফ্রিকায় কী একটা অনুষ্ঠানে একসঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। এরপর এই প্রথম দেখা। আশরাফুলকে জড়িয়ে ধরতে ধরতে ওয়াকার বললেন, ‘গান্দি (বাজে) ক্রিকেট! ছি, ছি, সাকিব এটা কী করল? তবে সাকিব, একমাত্র সাকিবের পক্ষেই এমন কিছু সম্ভব।’ একটু আগে ধারাভাষ্যেও কড়া ভাষায় বলে এসেছেন, বাংলাদেশ যা করেছে, তা ক্রিকেটের চেতনাবিরোধী।
ওয়াকার ইউনিস এমন কড়া সমালোচনা করেছেন বলেই হয়তো এ নিয়ে মহাতৎপর হয়ে উঠল আইসিসির লোকজন। আইসিসি টিভির প্রযোজক ধারাভাষ্যকারদের সঙ্গে কথা বললেন। কী বলেছেন, তা বোঝা গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। যখন সঞ্জয় মাঞ্জরেকার বলে দিলেন, এই বিষয়ে তিনি কোনো কথা বলতে পারবেন না। যা বলার বলবেন আইসিসি টিভির প্রযোজক অনিল চৌধুরী।
অনিল চৌধুরীর কথা কে শুনতে চায়! জানা দরকার তো সঞ্জয় মাঞ্জরেকারের মত। তিনি কী মনে করেন, অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসকে টাইমড আউট করাটা ঠিক হয়েছে, না বেঠিক? সঞ্জয় মাঞ্জরেকার মাথা নেড়ে বললেন, ‘সরি, আমি চুক্তিবদ্ধ। এ নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথাই বলতে পারব না।’
অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের মহাবিতর্কিত আউটের পর ধারাভাষ্য কক্ষ থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশের তিন-চারজন সাংবাদিকের এক জটলা দেখার পর ওই সঞ্জয় মাঞ্জরেকারই বলেছেন, ‘আপনারা তো ইতিহাস গড়ে ফেললেন।’
ইতিহাসই তো! যা এর আগে কখনো হয়নি, তা হয়ে গেলে সেটিকে ইতিহাস বলবেন না! এই বিশ্বকাপে আসার আগে সাকিব আল হাসান বলে এসেছিলেন, বাংলাদেশ এবার এমন কিছু করবে, যা আগে কখনো করেনি। এখন কেউ বলতেই পারেন, সাকিব কথা রেখেছেন। কথাটা সাকিব নিশ্চয়ই পারফরম্যান্স সম্পর্কেই বলেছিলেন। তাতে তেমন কিছু করতে না পারলেও এমন একটা কাণ্ড করে বসেছেন, যা এর আগে কখনো দেখেইনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট।
যা ঠিক না বেঠিক, তা নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে তোলপাড়। প্রেসবক্সে সাংবাদিকেরা প্রথমে বুঝতেই পারেননি, হঠাৎ খেলা বন্ধ কেন। কেনই–বা মাত্র নামা ব্যাটসম্যান অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস আম্পায়ারের সঙ্গে কথা বলছেন, সাকিবের সঙ্গেও। মাঠে স্লেজিং মাত্রা ছাড়িয়ে গেলেই সাধারণত এমন দৃশ্য দেখা যায়। খেলা থেমে যাওয়ার কারণ যে টাইমড আউটের আপিল, তা কীভাবে ভাববে কেউ! এমন কিছু এর আগে দেখলে তো!
ক্রিকেটই একমাত্র খেলা, যেটিতে ‘রুল’ নেই, ‘ল’ আছে। ক্রিকেটই একমাত্র খেলা, যেটিতে আইনের বাইরেও অলিখিত কিছু নিয়মনীতি আছে। যেটির ব্যত্যয় ঘটলেই প্রশ্ন ওঠে তা ক্রিকেটের চেতনাবিরোধী কি না।
অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের ‘টাইমড আউট’ হওয়ার পর অবধারিতভাবেই তা আরও বেশি উঠছে। এত বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা হয়ে আসছে, অথচ কোনো ব্যাটসম্যানের ‘টাইমড আউট’ হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। বিশ্বকাপের প্লেয়িং কন্ডিশন অনুযায়ী কোনো ব্যাটসম্যান আউট হওয়ার বা অবসর নেওয়ার দুই মিনিটের মধ্যে পরের ব্যাটসম্যানকে বল খেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এমসিসির নিয়ম অনুযায়ী, যা তিন মিনিট। এমন হওয়াটা খুবই অস্বাভাবিক যে বিভিন্ন সময় নানা কারণে ব্যাটসম্যান কখনো এর চেয়ে বেশি সময় নিয়ে ফেলেননি। তারপরও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কেউ টাইমড আউট না হওয়ার কারণ হতে পারে একটাই, ফিল্ডিং দলের অধিনায়ক এই আউটের জন্য আপিলই করেনি।
সাকিব করেছেন এবং ম্যাথুসের অনুরোধের পরও সেই আপিল প্রত্যাহার করতে রাজি হননি। আম্পায়ারের তাই কিছুই করার ছিল না। আপিল করলে আইনে যা আছে, সেটিই তো হবে। রমিজ রাজাও তা-ই মনে করেন। অনেক দিনের পরিচয় বলেই হয়তো আইসিসির বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে নিজের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দিলেন। সেই প্রতিক্রিয়া খুব ইন্টারেস্টিং। প্রথমেই বললেন, ‘আপনি ভুল লোককে প্রশ্নটা করছেন।’
কেন এমন বলছেন, তা স্পষ্ট হলো পরের কথায়, ‘আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অবস্ট্রাকটিং দ্য ফিল্ড আউট হওয়া প্রথম ব্যাটসম্যান। আইনে ছিল, তাই আউট হয়ে গেছি। আজ যেটা হয়েছে, এটাও তো আইনে আছে। তো আর কী বলার আছে?’
তার মানে রমিজ মনে করেন, সাকিব ক্রিকেটের চেতনাবিরোধী কিছু করেননি। তবে ভিন্নমতও আছে। ওয়াকার ইউনিসের কথা তো আগেই বলেছি। সাবেক দক্ষিণ আফ্রিকান ফাস্ট বোলার ডেল স্টেইনও যেমন টুইট করেছেন, ‘দ্যাট ওয়াজ নট কুল।’
আবার শ্রীলঙ্কার নামী সাংবাদিক রেক্স ক্লেমেন্টিন দায় দেখছেন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসেরই। তীব্র শ্লেষের সঙ্গে তিনি বললেন, ‘এটা স্কুলবয় ক্রিকেট ছাড়া আর কিছু নয়! ম্যাথুস হেলমেট ছাড়া একটা বল খেলে নিলেই পারত। হেলমেট না হয় পরে বদলাত। বল তো করছিল স্পিনার।’
অন্য সাংবাদিকদের মতো রেক্স তখনো জানেন না, ছিঁড়ে যাওয়া ফিতার কারণে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস হেলমেট বদলাতে চাওয়ার আগেই দুই মিনিট সময় পেরিয়ে গেছে। এই ম্যাচের চতুর্থ আম্পায়ার আদ্রিয়ান হোল্ডস্টক বিশ্বকাপের অফিশিয়াল সম্প্রচারক চ্যানেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এ কথা জানিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন পুরো প্রক্রিয়াটা। এই দুই মিনিটের ব্যাপারটা খেয়াল রাখার দায়িত্ব টিভি আম্পায়ারের। ম্যাথুসের বল খেলতে প্রস্তুত হওয়ার আগেই দুই মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার কথা টিভি আম্পায়ারই মাঠের আম্পায়ারদের জানিয়ে দেন। যদিও এরপর টাইমড আউটের আপিল করা না-করার ব্যাপারটা ছিল অবশ্যই সাকিবের ওপর।
হোল্ডস্টক সেই আপিল করার সময়টাও জানিয়ে দিয়েছেন। তা হেলমেটের ফিতা ছিঁড়ে যাওয়ার পর। তাহলে কি প্রথমে সুযোগ পেয়েও আপিল করেননি সাকিব? ফিতা ছিঁড়ে যাওয়ার কথা বলে ম্যাথুস যখন আরও সময় নিচ্ছিলেন, তখন আর সহ্য করতে পারেননি? ম্যাচ চলার সময় এই উত্তর পাওয়ার কোনো উপায় ছিল না।