রানবন্যার বিশ্বকাপে আপনাকে স্বাগত

আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে অংশগ্রহণকারী ১০ অধিনায়কএএফপি

প্রথম ম্যাচটাই যেন ফাইনালের পুনর্মঞ্চায়ন। নাটকটা হয়তো ২০১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালের মতো জমে উঠবে না, তবু নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে আজ যখন গত বিশ্বকাপের রুদ্ধশ্বাস ফাইনালের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী এবারের বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে মুখোমুখি হবে, আহমেদাবাদের আবহেও ভর করতে পারে লর্ডসের রোমাঞ্চ।

চার বছরে অনেক কিছুই অবশ্য বদলেছে। লর্ডসে সেবার প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপার স্বাদ পেয়েছিল ইংল্যান্ড। অথচ এবারের বিশ্বকাপটা তারা শুরু করছে র‍্যাঙ্কিংয়ের পাঁচে থেকে, রানার্সআপ নিউজিল্যান্ড ছয়ে। শীর্ষে আছে বিশ্বকাপের স্বাগতিক ভারত, তাদের পরই প্রতিবেশী পাকিস্তান।

র‍্যাঙ্কিংয়ের এই ধারাটাই যেন ভারত বিশ্বকাপের সঙ্গে বেশি জুতসই। উপমহাদেশের বিশ্বকাপে উপমহাদেশের দলেরই তো সেরা হয়ে খেলার কথা। সর্বশেষ তিনটি বিশ্বকাপের ইতিহাসে এটাও দেখা যাচ্ছে যে স্বাগতিক দলই বিশ্বকাপ জেতে। ২০১১ সালে ভারত-বাংলাদেশ মিলিয়ে হওয়া বিশ্বকাপে ভারত, ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া এবং ২০১৯–এর ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড।

আরও পড়ুন

তবে ইতিহাস সব সময় বর্তমানের গতিপ্রকৃতি ঠিক করে দেয় না। ভারতের ১০টি ভেন্যুতে আগামী ৪৬ দিনে ৪৮ ম্যাচের লড়াই শেষে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরতে পারে, এমন দল অনেকই আছে। ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড আর পাকিস্তান তো সবার সম্ভাব্য সেরার তালিকাতেই আনাগোনা করবে। অতি অঘটন ঘটিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দৌড়ে ঢুকে পড়তে পারে ‘আনকমন’ কোনো দলও। সে কারণেই এটা বিশ্বকাপ, যেখানে অন্তত খেলা শুরুর আগপর্যন্ত শিরোপার দাবিদার সবাই। নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামকে পেছনে রেখে অধিনায়কদের ফটোসেশনে কাল বিশ্বকাপ ট্রফির সবচেয়ে কাছাকাছি থাকা দুজন যদিও রোহিত শর্মা আর জস বাটলার, বাকিদের স্মিত হাসি বলে দিচ্ছে, ট্রফি-সুধা পানের তৃষ্ণা তাঁদেরও আছে।

এ ট্রফির লড়াই শুরু হচ্ছে আজ
এএফপি

ভারতের বিশ্বকাপ নিয়ে এবার যে কয়টা পূর্বানুমান, তার অন্যতম, এই বিশ্বকাপ হবে রানবন্যার বিশ্বকাপ। ৩০০-এর নিচে রান করলে জয়ের সম্ভাবনা নেই। ৩০০-এর ওপরেও যত পারো রান করো। এটি হাওয়াই কোনো আলোচনা নয়। ভারতের উইকেটের ব্যাটিং–সহায়ক আচরণ এবং বিসিসিআইয়ের প্রধান কিউরেটর আশিস ভৌমিকের কথাতেও সে আভাস পরিষ্কার। কিছুদিন আগে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আশিস জানিয়েছেন, তাঁরা চান বিশ্বকাপের ১০ ভেন্যুতেই হোক রান উৎসব। দুই ইনিংসেই যেন ৩০০ রান হয়, সেই রেসিপিতেই বানানো হয়েছে বিশ্বকাপের উইকেট।

বাকিটা নির্ভর করছে দলগুলোর ক্রিকেটীয় সামর্থ্য এবং সেই সামর্থ্য কাজে লাগানোর দক্ষতার ওপর। উইকেট আর কন্ডিশনের সুবিধা যে দল যত বেশি নিতে পারবে, বিশ্বকাপের ট্রফি ততই কাছে চলে আসবে তাদের। ব্যাপারটা তাহলে পরিষ্কার, এই বিশ্বকাপ জেতাবেন আসলে ব্যাটসম্যানরা। বোলাররা হবেন অনুঘটক মাত্র। কে কত কম রান দিয়ে বলটা আরেকজনের হাতে তুলে দিতে পারেন, সেই চেষ্টাই মূলত তাঁদের করে যেতে হবে। আর বোলিং যদি কিছু নির্ধারণ করেও, ব্যাটসম্যানদের ভুলের সুযোগ নিয়ে বেশির ভাগ ভেন্যুতে সেটা হয়তো পেসাররাই করবেন। কারণ তো জানাই। ভারতীয় উইকেট থেকে স্পিনের মায়াজাল হারিয়ে যেতে শুরু করেছে আরও আগেই। বিশ্বকাপটাকে পুরোপুরি রানবন্যার বানাতে ভেন্যুগুলোতে সেটিকে এক রকম ‘নিষিদ্ধ’ই ঘোষণা করার কথা আইসিসি ও বিসিসিআইয়ের।

আরও পড়ুন

তো, এমন কন্ডিশনে বিশ্বসেরা হবে কারা? আহমেদাবাদে কাল অধিনায়কদের সংবাদ সম্মেলনে ভারতের রোহিত শর্মাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এটাই—এবার চ্যাম্পিয়ন হবে কোন দল? খুবই সহজ-সরল প্রশ্ন, তবে এর উত্তর দেওয়া আবার ঠিক ততটাই কঠিন। স্বাভাবিকভাবে রোহিতের কাছেও এমন প্রশ্নের উত্তর নেই। স্বাগতিক এবং অন্যতম ফেবারিট দলের অধিনায়ক হয়েও তাঁর শুধু আশা, বিশ্বকাপে ভারত একটা ভালো অবস্থানে থাকুক।

টুর্নামেন্টের ছোট-বড় সব দলের সব অধিনায়কেরও নিশ্চয়ই ভালো কিছু নিয়ে দেশে ফেরার আশা। সেই ‘ভালো’র অর্থ একেক দলের কাছে একেক রকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। মধ্যম সারির দল বাংলাদেশের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান যেমন বললেন, ‘গত বিশ্বকাপের পর থেকে পয়েন্টের হিসাবে আমরা বাছাইপর্বে ৩ বা ৪ নম্বর দল ছিলাম। আমরা দল হিসেবে সত্যিই ভালো করেছি। এখন বিশ্বকাপে ভালো কিছু করে দেখানোর পালা।’ টুর্নামেন্টের সবচেয়ে দুর্বল দল বলে বিবেচিত নেদারল্যান্ডস অধিনায়ক স্কট এডওয়ার্ডসের কাছে আবার অংশগ্রহণটাই বড় কথা, ‘বিশ্বকাপটা যে শুরু করতে যাচ্ছি, আমরা এখন এটা নিয়েই রোমাঞ্চিত।’

ক্যাপ্টেনস ডে-তে কথা বলছেন সাকিব আল হাসান
এএফপি

বিশ্বকাপ ফুটবলের মতো অতটা না হলেও আজ শুরু বিশ্বকাপ ক্রিকেটও কম রোমাঞ্চ ছড়াবে না। টি-টোয়েন্টির আগ্রাসনের এই সময়ে যদিও ওয়ানডের অস্তিত্ব কিছুটা হুমকির মুখে, কেউ কেউ যখন ‘এটাই শেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপ কি না’ আলোচনাও তুলছেন, তার মধ্যেও বড় সত্যি হলো ক্রিকেটের বাণিজ্যিকীকরণ। ওয়ানডে বিশ্বকাপের মতো ক্রিকেট বিক্রির এত বড় বাজার, এত ব্যবসা সফল ইভেন্ট আর কোথায়!

আরও পড়ুন

উপমহাদেশে ক্রিকেট দিয়ে আলোড়ন তুলতে এই অঞ্চলের যেকোনো দুটি দেশের মুখোমুখি হওয়াই যেখানে যথেষ্ট, এই বিশ্বকাপে আবার হাতছানি আছে দু–দুটি ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ের। বিশ্ব ক্রিকেটে সেটির অর্থ কী, তা নিশ্চয়ই নতুন করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলগুলোও ভিড়ে যাওয়া মানে তো ক্রিকেটের সব গোলার্ধ ছুঁয়ে যাওয়া। যেটির পর খেলাটা থেকে আর কিছু চাওয়ারই থাকে না।

অনেকে তবু বলবেন, টি-টোয়েন্টির দখলদারির যুগে বিশ্বকাপ তো এখন বার্ষিক পরীক্ষার মতো প্রতিবছরের মামলা। তো আপনারাই বলুন, বার্ষিক পরীক্ষা না দিয়ে কি থাকা যায়? মিষ্টি তো কেনেন বার্ষিক পরীক্ষায় ভালো করলেই!