এ বিশ্বকাপই কি ঠিক করে দেবে ওয়ানডের ভবিষ্যৎ
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি তো আছেই, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি লিগের ‘উৎপাত’। সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রের মতো আইসিসির সহযোগী সদস্য দেশগুলোও এখন বিশ্বের নামীদামি তারকাদের এনে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ আয়োজন করছে। তাই রব উঠেছে, এত কিছুর চাপে ওয়ানডে ক্রিকেট থাকবে তো?
টি-টোয়েন্টির ঝড় সামলে ওয়ানডে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। আগামী বৃহস্পতিবার থেকে ভারতে ৫০ ওভারের সংস্করণের বিশ্বকাপ শুরু হতে চলেছে। সবার নজর এখন এই বিশ্বকাপের দিকেই। এ টুর্নামেন্ট দিয়েই বোঝা যেতে পারে, গত এক যুগে ওয়ানডে ক্রিকেট কতটা বিকশিত হয়েছে। এটি ঠিক করে দিতে পারে ওয়ানডের ভবিষ্যৎ কী!
সর্বশেষ ২০১১ সালে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে যৌথভাবে ওয়ানডে বিশ্বকাপ আয়োজন করেছিল ভারত। এবার করছে এককভাবে। ২০১১-এর পর ও ২০২৩-এর আগপর্যন্ত এক যুগে যেখানে ওয়ানডে বিশ্বকাপ হয়েছে মাত্র দুটি, সেখানে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হয়েছে পাঁচটি! বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসিসহ সব ক্রিকেট বোর্ডের কাছে ওয়ানডের গুরুত্ব কমে যাওয়া বুঝতে এ তথ্যই যথেষ্ট।
এমনকি ওয়ানডের কারণেই যাঁরা ক্রিকেটের রথী-মহারথী হয়ে উঠেছেন, তাঁদেরও কেউ কেউ এই সংস্করণ বাদ দেওয়ার পক্ষে, যেমন ওয়াসিম আকরামের কথাই ধরা যাক। ১৯৯২ ওয়ানডে বিশ্বকাপ ফাইনালে আকরামের সেই দুটি বলই (অ্যালান ল্যাম্ব ও ক্রিস লুইসকে বোল্ড) তো তাঁকে কিংবদন্তি হয়ে ওঠার পথে প্রথম সোপান হিসেবে কাজ করেছে। অথচ সেই আকরামই কিনা ওয়ানডে ক্রিকেট বাদ দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন!
সর্বশেষ ক্রিকেটের আইন প্রণয়নকারী সংস্থা মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবের (এমসিসি) সভাপতি ও খ্যাতিমান ধারাভাষ্যকার মার্ক নিকোলাস ওয়ানডে ক্রিকেট উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনার পক্ষে মত দিয়েছেন।
ইএসপিএনক্রিকইনফোকে সম্প্রতি নিকোলাস বলেছেন, ‘আমরা জোরালোভাবে বিশ্বাস করি, ওয়ানডে শুধু বিশ্বকাপেই খেলা উচিত। এই সংস্করণের সার্থকতার জন্য দ্বিপক্ষীয় সিরিজগুলো কঠিন হয়ে উঠছে। অনেক দেশেই গ্যালারি ভরছে না। আর এখন টি-টোয়েন্টির ক্ষমতাও অতিপ্রাকৃত।’ অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক ইয়ান চ্যাপেল ক্রিকইনফোর কলামে লিখেছেন, ‘(টি-টোয়েন্টির সঙ্গে তুলনায় আনলে) ওয়ানডে ম্যাচের সংখ্যা কার্যত কমে গিয়েছে। এটির গুরুত্ব বিশ্বকাপের বছরের ওপর নির্ভর করে।’
১৯৭১ সাল থেকে পথচলা শুরুর পর ওয়ানডে সংস্করণ ধীরে ধীরে বৈশ্বিক ক্রিকেটের চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে ১৯৯২ বিশ্বকাপের মধ্য দিয়ে সবাই যখন সাদা বল, রঙিন পোশাক আর দিবা-রাত্রি ম্যাচের সঙ্গে পরিচিতি হলো। কিন্তু ২০০৭ সালে ভারত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতায় দৃশ্যপট যেন ভোজবাজির মতো বদলে যেতে থাকে। পরের বছর আইপিএলের আবির্ভাবে রং হারাতে থাকে ওয়ানডে সংস্করণ। মানুষ অনেক বেশি রান, গতিময় ম্যাচ আর দ্রুততম সময়ে ম্যাচের ফল দেখতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ছোট বাউন্ডারি, অত্যাধুনিক ব্যাট, ব্যাটসম্যানবান্ধব পিচ ও নিয়ম সেটাকেই ত্বরান্বিত করে।
২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতে বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারকে পূর্ণতা দিয়েছিলেন শচীন টেন্ডুলকার। ভারতীয় কিংবদন্তির কাছেও এখন ওয়ানডে সংস্করণ একঘেয়ে লাগছে। বার্তা সংস্থা এএফপিকে তিনি বলেছেন, ‘খেলাটা এখন খুব অনুমিত হয়ে পড়ছে। ১৫ থেকে ৪০ ওভার পর্যন্ত ম্যাচের গতি হারিয়ে যাচ্ছে, বিরক্তিকর মনে হচ্ছে।’
তবে যে যা-ই বলুন, ওয়ানডে ক্রিকেট এখনো কিন্তু রোমাঞ্চের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে বোলাররা কোনো দলের টপ অর্ডার ধসিয়ে দিয়ে যেমন ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ এনে দিতে পারেন, আবার মিডল বা লোয়ার অর্ডারের ব্যাটসম্যানরা বিপর্যয় থেকে দলকে টেনে তোলার যথেষ্ট সময় পান।
সর্বশেষ ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড চার ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে এমনটা দেখা গেছে। এক বছর পর নিউজিল্যান্ডের ওয়ানডে দলে ফিরেই সেদিন ইংল্যান্ডের ব্যাটিংয়ে ধস নামান ট্রেন্ট বোল্ট।
সাউদাম্পটনে বৃষ্টির কারণে ৩৪ ওভারে নেমে আসা সেই ম্যাচে বোল্টের তোপেই একসময় ৫৫ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল ইংলিশরা। এরপর সাতে নামা লিয়াম লিভিংস্টোনের ক্যারিয়ারসেরা ৯৫* ও আটে নামা স্যাম কারেনের ৪২ রানের সুবাদে স্বাগতিকেরা পৌঁছে যায় ২২৬ রানে। পরে ডেভিড উইলি ও রিস টপলির দুর্দান্ত বোলিংয়ে নিউজিল্যান্ডকে ১৪৭ রানে গুটিয়ে দিয়ে ইংল্যান্ড ম্যাচ জিতে নেয় ৭৯ রানের বড় ব্যবধানে।
আবার সর্বশেষ এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কা-আফগানিস্তানের গ্রুপ পর্বের ম্যাচটির কথাও বলা যায়। হিসাবের গরমিলে একটুর জন্য সুপার ফোরে ওঠা হয়নি আফগানদের। ওই ম্যাচটি ২০০৩ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার হিসাবে ভুলের বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়েছিল।
ওয়ানডেতে এ পর্যন্ত ২৪ বার ৪০০ বা এর বেশি রানের দলীয় সংগ্রহ দেখা গেছে। এর মধ্যে ১৫ বারই ২০১১ বিশ্বকাপের পর। অর্থাৎ গত এক যুগে। আধুনিক ক্রিকেটের সংজ্ঞা বদলে দেওয়া ইংল্যান্ড তো গত বছর নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ৫০০ প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছিল। হয়নি মাত্র ২ রানের জন্য। ইংল্যান্ড এখন টেস্টও খেলছে ওয়ানডের মতো করে। আক্রমণাত্মক ও ফলকেন্দ্রিক চিন্তাধারা থেকে প্রসূত বিনোদনদায়ী এই ধরনের নাম হয়ে গেছে ‘বাজবল’।
টি-টোয়েন্টির জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গ তুলে ধরে নিকোলাস ক্রিকইনফোকে আরও বলেছেন, ‘মুক্ত বাজারে শুধু টাকার জয় হয়। টি-টোয়েন্টির অসাধারণ ক্ষমতা আছে, যেটা খেলোয়াড়দেরও আকৃষ্ট করে। তারা এটার অংশ হতে চায়। আমার মনে হয় পাশাপাশি দুই সংস্করণের সূচি রাখা ওয়ানডে খেলার মৃত্যু ঘটানোর গল্প লিখে যাচ্ছে।’
নিকোলাসের এ কথাটির পর দূর ভবিষ্যতে ওয়ানডের ভাগ্যে কী লেখা আছে, সেটা সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই বোঝা যাবে। তবে ইতিহাস-পরিসংখ্যানে ওয়ানডে তার গৌরব ঠিকই ধরে রেখেছে। করোনাকালীন দুই বছর ২০২০ ও ২০২১ সাল বাদ দিলে ১৯৯৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রতিটি বছরেই ন্যূনতম ৯০টি করে ওয়ানডে ম্যাচ হয়েছে।
ওয়ানডে ক্রিকেটের বিলুপ্তি কিংবা ম্যাচের সংখ্যা কমিয়ে আনা নিয়ে যখন এত কথা উঠছে, তখনো সংস্করণটি গড়তে যাচ্ছে রেকর্ড। ভারতে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের আগেই এ বছর ওয়ানডে ম্যাচের সংখ্যা ২০০ ছাড়াবে, যা নির্দিষ্ট এক বছরে সবচেয়ে বেশি। এর আগে কখনোই এক বছরে ২০০ ওয়ানডে হয়নি। আগামী চার বছরের এফটিপিতেও (ভবিষ্যৎ সফর পরিকল্পনা) রয়েছে অনেক ম্যাচ। এ সময়ে আইসিসির দুটি ওয়ানডে টুর্নামেন্টও হবে—২০২৫ সালে পাকিস্তানে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি ও ২০২৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে ও নামিবিয়ায় বিশ্বকাপ।
ভবিষ্যতে দ্বিপক্ষীয় সিরিজের অবস্থা যা-ই হোক, আইসিসির সবচেয়ে বড় ‘অর্থকরী ফসল’ ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচের জন্য করে হলেও ওয়ানডে বিশ্বকাপ চালু থাকবে। রাজনৈতিক বৈরিতায় এক দশকেরও বেশি সময় হলো ভারত-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলে না। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশের লড়াই দেখতে ক্রিকেটপ্রেমীদের চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকতে হয় বৈশ্বিক বা মহাদেশীয় টুর্নামেন্টের দিকে। আইসিসি নিজেও একাধিকবার স্বীকার করেছে, ভারত-পাকিস্তানকে তারা ইচ্ছা করেই একই গ্রুপে রাখে।
দুই দেশের সরকারের শীতল সম্পর্কের বরফ আবার কখনো গলতে শুরু করলে নিয়মিত হতে পারে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ। তখন নিশ্চয় পাঁচ দিনের টেস্ট আর সাড়ে তিন ঘণ্টার টি-টোয়েন্টির সঙ্গে এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচও দেখতে চাইবেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। এবারের বিশ্বকাপের প্রচারাভিযানের নামও তো তাই—‘ইট টেকস ওয়ানডে’!