‘গাদ্দার’ আফগানিস্তান হারাতেই বেশি খুশি পাকিস্তান
ভালো কিছু যে হতে যাচ্ছে, সেটা বুঝতে পারছিলাম দুবাই বসেই। আর সুখবরটা পেলাম রাত একটায় আল্লামা ইকবাল এয়ারপোর্টে নেমে। আমরা উড়োজাহাজে থাকতেই আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৮৯ রানে জিতে এশিয়া কাপের সুপার ফোরে উঠে গেছে বাংলাদেশ।
কিন্তু তাতে আমি কী আনন্দ প্রকাশ করব; যাঁর কাছ থেকে খবরটা শুনলাম, তাঁর আনন্দ দেখেই আমি দিশাহারা! মধ্যবয়সী ভদ্রলোক লাহোরের মেট্রো ট্যাক্সিচালক। ‘আপনাদের দেশ তো আজ (কাল) দারুণ খেলল। আফসোস আপনারা খেলাটা দেখতে পারলেন না’ বলে শুরু করে একটু পরই তিনি বাংলাদেশের জয়ের প্রসঙ্গ থেকে সরে চলে গেলেন আফগানিস্তানের হারের প্রসঙ্গে। সে প্রসঙ্গে কথা হতে হতে একপর্যায়ে বুঝতে পারলাম, বাংলাদেশ জেতায় তো নয়, কালকের ম্যাচের ফলাফল নিয়ে তাঁর এই উত্তেজনা আসলে আফগানিস্তান হারায়।
‘ওরা গাদ্দার’—এক কথায় আফগানিস্তান সম্পর্কে এ–ই হলো তাঁর মূল্যায়ন।
—কেন গাদ্দার?
ট্যাক্সিচালক: গাদ্দার নয় তো কী! আমরা ওদের খেলা শিখিয়েছি। ক্রিকেটে ওদের উন্নতির পেছনে পাকিস্তানের অবদান আছে। ইনজামাম, উমর গুলের মতো আমাদের বড় বড় খেলোয়াড় ওদের খেলা শিখিয়েছে। আর এখন কিনা আমাদের বিপক্ষেই ওরা বেশি লাফালাফি করে! আমাদের স্টাম্প দেখায়! এক ম্যাচে তো উইকেট পেলেই এমন ভাব করছিল যেন ওরা জিতে গেছে। পরে কিন্তু ম্যাচটা পাকিস্তান জিতেছে। বেইমান না হলে কেউ এ রকম করে! আমাদের কাছে খেলা শিখে কিনা ওরা ভারতের পক্ষে কথা বলে।
—তো একটা দল জিতলে আনন্দ করবে না! এটা তো খেলা…
ট্যাক্সিচালক: খেলা তো ঠিক আছে। কিন্তু এরা আসলেই বেশি বাড়াবাড়ি করে। আফগানিস্তান কিন্তু এখনো পাকিস্তানের চেয়ে বড় দল হয়ে যায়নি। তাদের সেটা বোঝা উচিত। বাংলাদেশ যদি পাকিস্তান ছাড়া অন্য কোনো দলকে হারায়, আমরা কিন্তু খুশি হই। কিন্তু আফগানিস্তান জিতলে হই না। আফগানিস্তান আর ভারত এক।
বুঝলাম, ক্রিকেটের চেয়েও তাঁকে ক্রিকেটকে ঘিরে রাখা অদৃশ্য উপমহাদেশীয় রাজনীতির ঝাঁজটাই বেশি প্রভাবিত করে রেখেছে।
যুক্তির বুননের চেয়ে আবেগের ধাক্কা বেশি। তবে ইমরান খানের দারুণ ভক্ত এই লাহোরি ট্যাক্সিচালক যে ক্রিকেটের নিয়মিত অনুসরণকারী, সেটিও বুঝতে অসুবিধা হয়নি তাঁর কথা শুনে। পরশু ইন্টারনেটে খেলা দেখেই মিরাজ আর নাজমুলের ব্যাটিংয়ের খুব সুন্দর বর্ণনা দিলেন। যখন বললাম, এ রকম ব্যাটিং উইকেটে তো রান করবেই, তাঁর কণ্ঠে প্রতিবাদ, ‘কই, আফগানিস্তানের ব্যাটসম্যানরা তো পারেনি! বাংলাদেশের বোলিংও খুব ভালো ছিল। পেসারদের তো ওরা ভালোভাবে খেলতেই পারেনি।’
রাত তিনটায় হোটেলে চেকইন করছি। বাংলাদেশ থেকে খেলা কাভার করতে এসেছি শুনে চেকইন ফর্মে কিছু লিখতে লিখতে কলম থেমে গেল ম্যানেজার ওয়ারেসের।
ওয়ারেস: আপনারা কি মাঠ থেকে এলেন?
—না, ফ্লাইট দেরি হওয়ায় আমরা খেলা মিস করেছি।
ওয়ারেস: বাংলাদেশ দারুণ খেলেছে। দুর্দান্ত। আমার খুব ভালো লেগেছে ওদের জিততে দেখে।
—কিন্তু সুপার ফোরে তো বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচ। তখন নিশ্চয়ই বাংলাদেশের হারই চাইবেন আপনি।
হেসে হেসে বললাম কথাটা। ওয়ারেসও হেসে বলেন, ‘আপনারা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। অতিথি। এখন এ নিয়ে কিছু বলব না। তবে আফগানিস্তান হেরেছে, এতেই খুশি আমি।’
১৯৪৭ সালে ভারতভাগের পর জাতিসংঘে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদ জানিয়েছিল আফগানিস্তান। প্রতিবেশী দুই দেশের রাজনৈতিক বৈরিতার শুরু তখন থেকেই। পরে সেটা খেলাধুলায়ও ছড়িয়ে পড়ে। আর খেলাধুলায় ক্রিকেট মাঠেই দুই দলের সাক্ষাৎ সবচেয়ে বেশি বলে এখানে বৈরিতার প্রকাশও বেশি।
সেই সুযোগে পাকিস্তানে কাল পর্যন্ত ভালো সমর্থনই পেয়েছে বাংলাদেশ। এখানকার সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীদের কথাবার্তায় অন্তত সেটাই পরিষ্কার। কাল মাঠে আফগান পাঠান সমর্থকেরাই যদিও সংখ্যায় বেশি ছিলেন, কিছু হাততালি বাংলাদেশও পেয়েছে ‘অ্যান্টি–আফগান’ দর্শকদের কাছ থেকে।
অবশ্য ৬ সেপ্টেম্বরের ম্যাচে নিশ্চিতভাবেই পরিস্থিতি সে রকম থাকবে না। সুপার ফোরের লড়াইয়ে গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে সেদিন বাংলাদেশ যে মুখোমুখি হবে স্বাগতিক পাকিস্তানেরই।