পাকিস্তান দলের মিডিয়া ম্যানেজার উমর ফারুক কালসন কথাটা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন। পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা কলকাতায় আসার পর শুধু বিরিয়ানির ওপরই আছেন, এ খবর কোত্থেকে এল!
কেন, এ খবর তো নেটেই আছে। যদিও অনুমিতভাবেই তাতে তথ্যসূত্রের কোনো উল্লেখ নেই।
উমর কালসন কিছুদিন আগেও পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। পাকিস্তানের তো বটেই, ভিনদেশি সাংবাদিকদেরও অনেকেই তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ। তাঁদের তিনি বোঝানোর চেষ্টা করলেন, পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা শুধুই বিরিয়ানি খেয়ে যাচ্ছেন, এ খবর একদমই ঠিক নয়।
বোঝাতে বোঝাতে একসময় চুপ মেরে গেলেন। হয়তো চেষ্টাটা নিরর্থক বুঝতে পেরেই। পাকিস্তান দল নিয়ে এত সব বিচিত্র খবর হচ্ছে যে এসবের ব্যাখ্যা দিতে গেলে তাঁর আর ঘুমানোর সময় থাকবে বলে মনে হয় না। খবর তো শুধু ভারত থেকেই হচ্ছে না। বেশির ভাগ খবরেরই উৎপত্তিস্থল পাকিস্তান। আমজনতার কথা বাদই দিন। সাবেক ক্রিকেটার, পিসিবি কর্মকর্তারাই তো কে কত বলতে পারেন, তার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন। কখন এটা বেশি হয়, সবারই মনে হয় তা জানা। যখন পাকিস্তান হারতে থাকে।
বিতর্ক চিরদিনই পাকিস্তান ক্রিকেটের ছায়াসঙ্গী। তবে মাঝখানে কিছুদিন একটু ব্যতিক্রম হয়েছিল। এতটাই যে অনেকে একটু বিস্মিতও হয়েছিলেন। কী ব্যাপার, পাকিস্তানের ক্রিকেট বদলে গেল নাকি! এই বিশ্বকাপে টানা হারতে শুরু করার পর বোঝা যাচ্ছে, এই জিনিস বদলানোর নয়। বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন বিতর্কের জন্ম হচ্ছে। টেলিভিশনে, অনলাইনে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্রিকেট দল ও ক্রিকেটারদের নিয়ে যাঁর যেমন খুশি লিখে বা বলে যাচ্ছেন। যাতে সর্বশেষ যোগ দিয়েছেন খোদ পিসিবি চেয়ারম্যান জাকা আশরাফও।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে কি কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছেন? বাংলাদেশও তো এমনই। যদিও এই বিশ্বকাপের আগে এমন তুমুল বিতর্কের মধ্যেও বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান স্বভাববিরুদ্ধভাবে নীরব ছিলেন। বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার পরও অনেক দিন তাঁর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে বাংলাদেশ হেরে যাওয়ার পর গত পরশু এই বিশ্বকাপে প্রথম সাংবাদিকদের সামনে এসেছেন। তবে যা বলার শুধু নিজেই বলেছেন এবং ভালোই বলেছেন। বিতর্ক এড়াতে কোনো প্রশ্নের উত্তরও দেননি।
তা জাকা আশরাফ কী করেছেন? সাবেক অধিনায়ক রশিদ লতিফের বক্তব্য খণ্ডন করতে পিসিবির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তার সঙ্গে বাবর আজমের ব্যক্তিগত হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা লাইভ টেলিভিশনে দেখিয়ে দিয়েছেন। রশিদ লতিফ টেলিভিশন শোতে দাবি করেছিলেন, বাবর আজম ফোন করলেও জাকা আশরাফ তা ধরছেন না। পাকিস্তান অধিনায়কের অবস্থা কতটা সঙিন, তা বোঝাতে এরপর এ-ও বলেছেন, অনেক চেষ্টা করেও নাকি পিসিবির কর্তাব্যক্তিদের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না বাবর।
রশিদ লতিফের কথা যে সত্যি নয়, সেটি প্রমাণ করতে পেরেছেন জাকা আশরাফ। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, ব্যক্তিগত হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা তিনি এভাবে প্রকাশ করতে পারেন কি না। ওই একই টেলিভিশন অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচক ইনজামাম-উল–হকের স্বার্থের সংঘাত নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর নিয়েও কথা বলেছেন জাকা আশরাফ। এটা তদন্ত করে দেখা হবে বলে জানানোর পর দিনে দিনেই ইনজামাম পদত্যাগ করেছেন। সব মিলিয়ে রীতিমতো ঘটনার ঘনঘটা। এ–ই না হলে পাকিস্তান ক্রিকেট!
তা ইনজামামের স্বার্থের সংঘাতটা কোথায়? যুক্তরাজ্যে নিবন্ধিত ইয়াজু নামে একটি প্রতিষ্ঠানের তিনি পরিচালক। যেটির আরেক পরিচালক পাকিস্তান উইকেটকিপার মোহাম্মদ রিজওয়ানও। দুজনই ২৩ শতাংশ করে মালিকানা। এই ইয়াজু আবার বাবর আজম, রিজওয়ান, শাহিন শাহ আফ্রিদি, ইমাম-উল–হক, ওয়াসিম জুনিয়রের মতো সাত–আটজন ক্রিকেটারের এজেন্ট। এটা তো পরিষ্কার স্বার্থের সংঘাত। প্রধান নির্বাচক কীভাবে ক্রিকেটারদের এজেন্ট হতে পারেন!
সব মিলিয়ে পাকিস্তান দল এখন মাঠে ও মাঠের বাইরের সমস্যায় জেরবার। বিশ্বকাপের ঠিক আগে ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে। প্রথম দুই ম্যাচে দারুণ জয়ের পর পাকিস্তানকে বিশ্বকাপের অন্যতম ফেবারিট মনে করাটাই তাই স্বাভাবিক ছিল। সেই পাকিস্তানই এরপর টানা চার ম্যাচ হেরে খাদের কিনারায়। বাকি তিন ম্যাচ জিতলেও সেমিফাইনালে খেলার নিশ্চয়তা নেই। তাকিয়ে থাকতে হবে অন্য ম্যাচগুলোর দিকে। এর মধ্যে শুরু হয়েছে অধিনায়ক বাবর আজমকে তুমুল আক্রমণ। কিছুদিন আগেই সবার নয়নমণি হয়ে থাকা বাবরের এখন সবকিছুই খারাপ। ব্যাটিং-অধিনায়কত্ব, এমনকি মাঠে হাঁটাচলাও।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা মিম ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাবর আজম নাকি তাঁর ব্যাটিং ও অধিনায়কত্ব দিয়ে জস বাটলারকে সংক্রমিত করেছেন। এই বিশ্বকাপের আগে অনেকেই বলেছিলেন, টুর্নামেন্টটা হবে বাবর আজমের। যাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম গৌতম গম্ভীর। তা হয়নি সত্যি, তবে বাবরের অবস্থা তো আর বাটলারের মতো শোচনীয় নয়। সেঞ্চুরি না পেলেও ৬ ইনিংসে ৩টি হাফ সেঞ্চুরি আছে। ইংল্যান্ড অধিনায়ক বাটলারের সর্বোচ্চ ইনিংস যেখানে ৪৩ রানের, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মাত্র ২০। সব দেখেশুনে ওয়াকার ইউনিস এতই ক্ষুব্ধ যে বাবর আজমকে রেহাই দেওয়ার জন্য একরকম আকুতিই করেছেন। মনে করিয়ে দিয়েছেন, বাবর আজম পাকিস্তানের সম্পদ।
কে তা শুনতে যায়! বাংলাদেশের সঙ্গে মিলের কথা বলছিলাম। কদিন আগে শাদাব খানের কথায় যার আরেকটা উদাহরণ পাওয়া গেছে। শাদাব পাকিস্তানের মানুষের একটা প্রবণতার কথা বলেছেন। দলে যাঁরা আছেন, সবাই খারাপ। যাঁরা দলের বাইরে আছেন, তাঁরা সবাই খুব ভালো। বাংলাদেশের ক্রিকেটেও তো এর চর্চা অনেক দিনের।
পাকিস্তানের মতো এত ঘূর্ণিঝড় না উঠলেও টানা পাঁচ ম্যাচে হারার পর বাংলাদেশ দলেরও যথেষ্টই সমালোচনা হচ্ছে। নেদারল্যান্ডসের কাছে হারার পর স্বাভাবিকভাবেই আরও বেশি। বিতর্ক, ক্রিকেট সংস্কৃতির মতো এই বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সে আজ ইডেন গার্ডেনসে মুখোমুখি হওয়া দুই দল তাই অনেকটাই মিলে যাচ্ছে এক বিন্দুতে। পার্থক্য বলতে একটাই। গাণিতিকভাবে পাকিস্তানের এখনো সেমিফাইনালে খেলার সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশের শুধুই একটু মুখ রক্ষার লড়াই।