পর্দার আড়ালে সাব্বিরের প্রস্তুতি কেউ দেখে না, সবাই ‘মুভিটাই দেখে’
সাব্বির রহমান—নামটা শুনলেই স্ট্রোকের ফুলকিমাখা সব স্মৃতি মনে পড়ার কথা। ব্যাট-বলের নিখুঁত টাইমিংয়ের শব্দ সেসব স্মৃতিকে আরও তরতাজা করে তোলে।
ব্যাট হাতে তাঁর অধারাবাহিকতার স্মৃতিই অবশ্য বেশি, যে কারণে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে আফগানিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টির পর দেশের হয়ে আর খেলার সুযোগ পাননি সাব্বির। সুযোগের পর সুযোগ হাতছাড়া করে জায়গা হারান জাতীয় দলে।
হুট করে সেই সাব্বিরই এখন আলোচনায়। চোটজর্জর বাংলাদেশের আসন্ন এশিয়া কাপের ১৭ সদস্যের দলে ডাক পেয়েছেন সাব্বির। ২৭ আগস্ট থেকে শুরু হতে যাওয়া এশিয়া কাপ হবে টি-টোয়েন্টি সংস্করণে। ছোট সংস্করণের এই ক্রিকেট দিয়ে আবারও জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পেছনে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে গত মৌসুমের পারফরম্যান্স বড় ভূমিকা পালন করেছে বলে বিশ্বাস সাব্বিরের।
বাংলাদেশ ‘এ’ দলের হয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যাওয়া সাব্বির জাতীয় দলে ফেরার অনুভূতি জানাতে গিয়ে কাল মুঠোফোনে বলছিলেন সে কথা, ‘অনেকদিন পর ফেরা। এত দিন দলের বাইরে ছিলাম। করোনা ছিল যে কারণে নিয়মিত লিগ হয়নি। ফেরার মঞ্চও ছিল না। এবার ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ভালো খেলেছি। সে জন্যই এত কিছু। এখন দলে ফিরতে পেরে ভালো লাগছে।’
সাব্বিরের দল লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জ গত ঢাকা লিগের রানার্সআপ। তাঁর ব্যাট থেকে ৫১৫ রান এসেছে ৩৯.৬১ গড় ও ১০২.৩৮ স্ট্রাইক রেটে। একটি সেঞ্চুরি ও একটি ফিফটি করেন টপ অর্ডারে ব্যাট করে। ঢাকা লিগে রান করলেই তিনি বিসিবির নজরে আসবেন, সেটি জেনেই নাকি নিজেকে তৈরি করেছেন সাব্বির, ‘করোনার মধ্যে খেলাধুলা বেশি হয়নি। ভাবনাটা এমন ছিল যে যদি একটা ভালো প্রিমিয়ার লিগ, এনসিএল বা বিসিএলে যদি ভালো খেলতে পারি, তাহলে আমি আবার বিসিবির নজরে আসব। এটাই আমার মূল লক্ষ্য ছিল।’
লক্ষ্য পূরণও হয়েছে সাব্বিরের। ঢাকা লিগের পারফরম্যান্স দেখেই সাব্বিরকে বাংলাদেশ টাইগার্স প্রোগ্রামে সুযোগ দেওয়া হয়। সেখানে বিসিবির সুযোগ-সুবিধা সাব্বিরকে ছন্দ ধরে রাখতে সাহায্য করেছে। এরপর জাতীয় দলে চোটের মিছিল কপাল খুলে দেয় সাব্বিরের, ‘তিন বছর পর বিসিবির একটা প্রোগ্রামে এসেছি। অনুশীলন করেছি। ভালো সুযোগ-সুবিধা পেয়েছি। বোলিং মেশিন পেয়েছি। উইকেট পেয়েছি। জাতীয় দলের বাইরে তো এসব সুবিধা পাওয়া যায় না। সেখানে কোচরা হয়তো ভালো ফিডব্যাক দিয়েছে যে সাব্বির এখনো ঠিক আছে। তাঁরা ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে বলেই নির্বাচকেরা আমাকে দলে নিয়েছে।’
এসবই গত কয়েক মাসের কথা। কিন্তু ২০১৯ সালে সাব্বিরের দল থেকে বাদ পড়ার পরের গল্পটা ছিল ভিন্ন। সেই গল্প জানতে চাইলে সাব্বির বলছিলেন, ‘বিহাইন্ড দ্য সিন আসলে কেউ দেখে না। মুভিটাই দেখে সবাই। আমি যে দুই-তিন বছর ধরে বিহাইন্ড দ্য সিনে (ভেতরে ভেতরে নিজেকে প্রস্তুত করা) কাজ করে যাচ্ছি সেটা কেউই দেখে না। রাজশাহীতে কাজ করে যাচ্ছি। জিম, রানিং, ফিটনেস, স্কিল করে গিয়েছি। আমার একটা বিশ্বাস ছিল যে, আমি একদিন না একদিন আবার দলে ফিরব। সে লক্ষ্যই অনুশীলন করে যাওয়া। সেটার ফল পেয়েছি। আল্লাহ একটা সুযোগ করে দিয়েছে। আশা করি শতভাগ চেষ্টা করব সুযোগটা কাজে লাগানোর। ফিটনেস ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। মানসিকতা নিয়ে কাজ করেছি মাইন্ড ট্রেনারের সঙ্গে। বিশ্বাস রেখেছি যদি খেলা শুরু হয়, তাহলে পারফর্ম করে দলে ফিরতে পারব।’
সাব্বিরের সুযোগটা সমালোচনা ছাড়া আসেনি। ৫০ ওভারের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের পারফরম্যান্স দেখে সাব্বিরকে টি-টোয়েন্টির দলে নেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ২০১৯ সালে বাদ পড়ার পর ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে সাব্বিরের পারফরম্যান্স অন্তত জাতীয় দলে ফেরার মতো নয়। বাদ পড়ার পর কুড়ি ওভারে ৩৬ ইনিংসে ফিফটি স্রেফ ২টি। সাব্বির অবশ্য বিষয়টি দেখছেন অন্যভাবে।
তাঁর যুক্তি, ‘একজন ব্যাটসম্যান যখন ফর্মে থাকলে কোন সংস্করণে খেলছেন সেটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। ফর্মে থাকলে তাঁকে দলে জায়গা দেওয়াটাই বড় ব্যাপার। আমি যেমন টি-টোয়েন্টি থেকে বাদ পড়েছিলাম, তখন আমার ওয়ানডে পারফরম্যান্স ভালো ছিল। এরপর ওয়ানডে থেকেও আমাকে বাদ দেওয়া হয়। এখন আবার উল্টো হয়ে গিয়েছে। ৫০ ওভারে ভালো করে টি-টোয়েন্টিতে ডাক পেয়েছি। সুযোগ পেলে সেটা ধরতে হবে। এটাই ব্যাটসম্যানের জন্য জরুরি।’
প্রশ্ন আছে বদলে যাওয়া আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির সঙ্গে সাব্বিরের মানিয়ে নেওয়া নিয়েও। প্রতি মৌসুমেই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে যেন গতির সঞ্চার হচ্ছে। সাব্বির এ সময়টা ছিলেন না জাতীয় দলে। দেশের বাইরে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগেও খেলা হয় না তাঁর। কুড়ি ওভারের গতির সঙ্গে তিনি তাল মেলাতে পারবেন তো?
প্রশ্নটার উত্তর দিতে নিজের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাকে ঢাল বানালেন সাব্বির, ‘যেহেতু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছি, একটা ধারণা তো অবশ্যই আছে। ঘরোয়া ক্রিকেট ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিশাল ফারাক আছে সেটাও মানি। যেহেতু দুই-তিন বছর পর যাচ্ছি, কিছুটা মানিয়ে নিতে তো হবেই। আর এশিয়া কাপে যাওয়ার আগে আমি ওয়েস্ট ইন্ডিজে কিছু ম্যাচ খেলব। এশিয়া কাপের আগে যদি প্রস্তুতি ম্যাচ পাই সেটা সাহায্য করবে। আর অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর চেষ্টা করব।’
সাব্বিরকে ঘিরে প্রতিশ্রুতি, প্রত্যাশা এসব নতুন নয়। জাতীয় দলে তাঁর প্রথম অধ্যায়ে এসবের সঙ্গে মিলেমিশে ছিল ব্যর্থতার হতাশাও। এশিয়া কাপ দিয়ে শুরু হতে যাওয়া সাব্বিরের দ্বিতীয় অধ্যায় কেমন হবে, সেটি সময়ই বলে দেবে।