সেই এজবাস্টনে এবার ইংল্যান্ডের হৃদয় ভেঙে জিতল অস্ট্রেলিয়া

নাথান লায়নকে কোলে তুলে নিয়েছেন প্যাট কামিন্স, এজবাস্টনে ইংল্যান্ডকে ২ উইকেটে হারানোর পররয়টার্স

শেষ দিন। শেষ সেশন। শেষ ঘণ্টা।

পাঁচ দিন ধরে চলা এজবাস্টন-টেস্ট নামের নাটক এসে ঠেকেছিল সেখানে। এ দিনের আগে ফিরে আসছিল ২০০৫ সালের এজবাস্টনের স্মৃতি। ইতিহাসের অন্যতম সেরা অ্যাশেজ সিরিজের সেরা টেস্ট ছিল সেটি। নিশ্চিত পরাজয়ের মুখ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে জয়ের দুয়ারে গিয়ে থেমে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া, হেরেছিল ২ রানে। সেবার লক্ষ্য ছিল ২৮২, এবার ২৮১।

এবার ২২৭ রানে অ্যালেক্স ক্যারি যখন ফিরলেন, ইংল্যান্ড তখন পরিষ্কার ফেবারিট। তবে দিনের ৪.৩ ওভার বাকি থাকতে ওলি রবিনসনের শর্ট বলে প্যাট কামিন্সের আউটসাইড-এজ গেল থার্ডম্যানে, এরপর হ্যারি ব্রুক ডাইভ দিয়েও থামাতে ব্যর্থ হলেন—সেই কামিন্স তখন উদ্বাহু। ১৮ বছর আগে ২ রান দূরে থেমেছিল অস্ট্রেলিয়া, এবার তারা জিতল ২ উইকেটে। কামিন্স তখন অপরাজিত ৪৪ রানে, নাথান লায়নের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কের জুটি অবিচ্ছিন্ন ৫৫ রানে, লর্ডসে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে থেকে যাওয়া নিশ্চিত অস্ট্রেলিয়ার!

অবশ্য  গতকাল শেষ বিকেলের বিশ্বের শীর্ষ দুই ব্যাটসম্যান মারনাস লাবুশেন ও স্টিভেন স্মিথকে ফিরিয়ে রোমাঞ্চের যে মঞ্চ সাজিয়েছিলেন স্টুয়ার্ট ব্রড, সেখানে শিগগির উঠতে পারেননি চরিত্ররা। দুই দল আর দর্শকদের যে একটা লম্বা সময় অপেক্ষায় রাখে বার্মিংহামের আকাশ! রাতভর ঝরা বৃষ্টি ছিল সকালেও, সেটি থামলেও মাঠ শুকাতে সময় লেগেছে। প্রথম সেশনে হয়নি একটি বলও, অবশেষে সেটি শুরু হয় নির্ধারিত সময়ের ৩ ঘণ্টা ১৫ মিনিট পর।

বৃষ্টিতে প্রথম সেশনে খেলাই হতে পারেনি
রয়টার্স

গত চার দিন সেভাবে ল্যাটারাল মুভমেন্টের দেখা পাননি পেসাররা, টানা বৃষ্টিতে একটু সজীব হয়ে ওঠা উইকেটে সেটির আশা হয়তো করেছিল ইংল্যান্ড। তবে দিনে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম উইকেটটি পেতে ইংল্যান্ডকে অপেক্ষা করতে হয়েছে অষ্টম ওভার পর্যন্ত। স্টুয়ার্ট ব্রডের অ্যাওয়ে সুইংয়ে খোঁচা দেন নাইটওয়াচম্যান স্কট বোল্যান্ড। তবে দুই দিন মিলিয়ে ৪০ বলে ২০ রানের ইনিংসে বোল্যান্ড ভালোই ভুগিয়েছেন ইংলিশদের।

শেষ দিনে স্পিনের বড় ভূমিকা থাকবে, সেটি বলা হচ্ছিল শুরু থেকেই। তবে ইংল্যান্ডের মূল স্পিনার মঈন আলী সে ভূমিকা কতটা পালন করবেন, সে আলোচনা ছিল ভালোভাবেই। অবসর ভেঙে প্রায় দুই বছর পর ফেরা এ অফ স্পিনার প্রথম ইনিংসে গুরুত্বপূর্ণ দুটি উইকেট নিলেও ছিলেন খরচে। সেই মঈনই ইংল্যান্ডকে এনে দেন পরের ব্রেকথ্রু। আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের জন্য পরিচিত ট্রাভিস হেড শুরুতে ছিলেন খোলসবন্দী, মঈনের বলে ব্যাকফুটে গিয়ে খেলতে গিয়ে স্লিপে ক্যাচ দেন এ বাঁহাতি।

খাজা অবশ্য ফিফটি পান ঠিকই। ১৯৮৯ সালে মার্ক টেলরের পর প্রথম অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ইংল্যান্ডের মাটিতে অ্যাশেজের একই টেস্টে সেঞ্চুরি ও ফিফটি করা ব্যাটসম্যান হয়েছেন এ ওপেনার। হয়েছেন পাঁচ দিনের টেস্টের ইতিহাসে প্রতি দিনই ব্যাটিং করা মাত্র পঞ্চম ব্যাটসম্যান। খাজা অবশ্য ম্যাচটি ঠিক নিজের হাতে নেননি, তিনি সময় কাটিয়ে রান করার চিরায়ত পথেই হেঁটেছেন।

এভাবেই নাগাল থেকে বেরিয়ে গেছে ইংল্যান্ডের ম্যাচ
রয়টার্স

ক্যামেরন গ্রিনের সঙ্গে খাজার জুটিতে অস্ট্রেলিয়া এগোচ্ছিল ভালোভাবেই। অস্ট্রেলিয়া চা-বিরতিতে যায় ৫ উইকেটে ১৮৩ রান নিয়ে। ফলে শেষ সেশনে তাদের প্রয়োজন ছিল ৯৮ রান, ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ছিল ৫ উইকেট। ইংল্যান্ডকে এর প্রথমটি এনে দেন ওলি রবিনসন। তাঁর বলটি স্টাম্পে ডেকে এনে নিজের বিপদটা ডেকে আনেন গ্রিন। খাজার সঙ্গে তাঁর জুটি থামে ৪৯ রানেই।

ইনিংসের ৭০তম ওভারে নিজের প্রথমটি করতে আসেন স্টোকস, সফল হন দ্বিতীয় ওভারে। এবার স্টাম্পে বল ডেকে আনেন খাজা। অন্যপ্রান্তে বল করে যাচ্ছিলেন জো রুট, মঈন আলীর আঙুলের চোটে যাঁর ওপরই ভরসা করছিলেন স্টোকস। তবে তখনো মনে হচ্ছিল, রুট-স্টোকসের জুটি অপেক্ষা করছে দ্বিতীয় নতুন বলের জন্যই। তবে স্টোকস সেটি নেননি। স্টোকস তাঁর সিদ্ধান্তে চমকে দিতে ভালোবাসেন, পুরোনো বলে রুটকে এনে আরেকবার চমকে দিলেন। রুট সফল তৃতীয় বলেই। পুরোনো বলে পার্ট-টাইমারের বিপক্ষে সুযোগ নিলেন অ্যালেক্স ক্যারি, তবে এবার ফিরতি ক্যাচটি নিলেন রুট। এর আগে কঠিন ও মোটামুটি নেওয়ার মতো ধরনের দুটি সুযোগ হাতছাড়া করেছিলেন রুট।

এতক্ষণ পর্যন্ত সেভাবে আক্রমণের দিকে না এগোলেও প্যাট কামিন্স আর অপেক্ষা করেননি। প্রথমে রুটের ওপর চড়াও হয়েছেন, এক ওভারে মেরেছেন দুটি ছক্কা। পুরোনো বলেই এগিয়েছে ইংল্যান্ড, ব্রডের শর্ট বলে সুযোগও এসেছিল। তবে লায়নের পুল শটে তোলা ক্যাচটি স্কয়ার লেগে দারুণ প্রচেষ্টার পরও নিতে পারেননি স্টোকস। ৮৬তম ওভারে গিয়ে দ্বিতীয় নতুন বলটি অবশেষে নেয় ইংল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়ার তখন দরকার ২৭ রান, তবে স্টোকসের ফিল্ড সেটিং দেখে মনে হচ্ছিল রানের ব্যাপারটি ভাবাচ্ছে তাঁকে। ব্রডকে ড্রাইভ করে মারা লায়নের চারে হয়তো সে চিন্তা আরেকটু বাড়ে তাঁর। রবিনসন ও ব্রডকে দিয়ে করিয়ে গেছেন স্টোকস, লায়ন আর কামিন্স বের করে গেছেন রান। ইংল্যান্ড খুঁজে ফিরেছে উইকেট।

সে উইকেটের দেখা পায়নি তারা। এ দিন যে এজবাস্টনের ফলটা বদলে দেবে অস্ট্রেলিয়া! এ দিন যে উল্লাসে মাতবেন কামিন্স ও লায়ন!