রাজাই রাজা!
সেদিনও গলা ধরে আসছিল সিকান্দার রাজার। ক্যামেরায় তাঁকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। তবু ধরে আসা গলায় বলেছিলেন, ‘মোটেও ভালো লাগছে না। আমরা যে স্বপ্ন দেখেছিলাম তা ব্যথাতুর করে তুলেছে এই ট্রফিটা। ১৫ মিলিয়ন মানুষের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়েছে।’
২০১৮ সালে আইসিসি বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে টুর্নামেন্টসেরার পুরস্কার হাতে কথাগুলো বলেছিলেন সিকান্দার রাজা। পরের বছর ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি জিম্বাবুয়ে। মনের দুঃখে হাতের ট্রফিটা দেখিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন জিম্বাবুয়ে অলরাউন্ডার। সে বছরই (২০১৯) এসেছে আরও বড় ধাক্কা। বোর্ডে সরকারি হস্তক্ষেপের কারণে জিম্বাবুয়েকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিষিদ্ধ করে আইসিসি। তাতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব খেলতে পারেনি জিম্বাবুয়ে, তাই গত বছর এই টুর্নামেন্টে দলটিকে দেখা যায়নি।
রাজাও মনের দুঃখ চেপে রাখেননি। সে বছরের ১৯ জুলাই একটি টুইট করেছিলেন রাজা, ‘একটা সিদ্ধান্ত কীভাবে একটা দলকে অপরিচিত বানিয়ে দিল! একটা সিদ্ধান্ত কীভাবে অনেক লোককে বেকার বানিয়ে দিল! একটা সিদ্ধান্তে কতগুলো পরিবার ধাক্কা খেল! একটা সিদ্ধান্ত কীভাবে অনেকগুলো ক্যারিয়ার শেষ করে দিল! অবশ্যই আমি এভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানাতে চাইনি।’
জিম্বাবুয়ে নিষিদ্ধ হওয়ায় তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের শেষটা দেখে ফেলেছিলেন সিকান্দার রাজা। ভাগ্যিস, তিনি খেলা ছাড়েননি! জিম্বাবুয়ের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা ওঠার পর সিকান্দার রাজাও ফেরেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। তারপর ৩৬ বছর বয়সী এই অলরাউন্ডারের উত্থানটা ছিল দুর্দান্ত। গত আগস্টেই আইসিসির মাসসেরা ক্রিকেটার হয়েছেন।
এবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও ব্যাটে-বলে সামনে তুলে এনেছেন জিম্বাবুয়েকে। প্রথম রাউন্ডে হোবার্টে তাঁর ৮২ রানের ইনিংসে আইরিশদের হারায় জিম্বাবুয়ে। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষেও জিম্বাবুয়ের জয়ে তাঁর ২৩ বলে ৪০ রানের দুর্দান্ত ভূমিকা ছিল। জিম্বাবুয়ে সুপার টুয়েলভে ওঠার পর আজ নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তানের। ম্যাচের ফল কী হতে পারে, ম্যাচ শুরুর আগে তা মোটামুটি সবাই আন্দাজ করে নিয়েছিলেন। কী আর, ‘গোলিয়াথ’ পাকিস্তানের কাছে হারবে পুঁচকে ‘ডেভিড’ জিম্বাবুয়ে!
ভুল। মাত্র ১৩০ রানের পুঁজি নিয়ে পাকিস্তানকে শেষ বলে ১ রানে হারিয়ে সবাইকে বিস্ময় উপহার দিয়েছে জিম্বাবুয়ে। আর এই জয়ে বল হাতে দুর্দান্ত ভূমিকা ছিল রাজার। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে টানা দুই বলে ২ উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি ম্যাচে মোট ৩ উইকেট নেন। ব্যাটিংয়ে ভালো করতে না পারলেও বোলিংয়ে পুষিয়ে দেওয়ায় ম্যাচসেরাও রাজা। আসলে এবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ে যে তিন ম্যাচ জিতেছে, তার সবকটিতে ম্যাচসেরা অন্য কেউ হয়নি। রাজাই রাজা!
শুধু কী তাই, এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বাছাইয়ে জিম্বাবুয়ে যে পাঁচ ম্যাচ খেলেছে, তার মধ্যে ফাইনালসহ তিন ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়টিও রাজাই। হ্যাঁ, বলতে গেলে রাজা একার কাঁধেই জিম্বাবুয়েকে টেনে তুলেছেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। আর বিশ্বকাপে এসেও টানছেন সেই রাজাই!
তবে আজকের জয়টি যেহেতু আলাদা, বড় দল পাকিস্তানকে তো আর প্রতিদিন হারানোর সুযোগ আসে না! আবেগাপ্লুত রাজার তাই চার বছর আগের মতো আজও গলাটা ধরে এল। ম্যাচসেরার ট্রফি হাতে বললেন, ‘ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। গলাটা শুকিয়ে আসছে। আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ায় এমন লাগছে। এই দলটাকে নিয়ে আমি কী পরিমাণ গর্বিত তা বলে বোঝাতে পারব না।’
রাজা এরপর জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক ক্রেগ আরভিনকে দেখিয়ে একটি ঘটনা বললেন, ‘অস্ট্রেলিয়ায় আসার সময় অধিনায়ককে বলেছিলাম, যদি তুমি ম্যাচসেরা হও, তাহলে আমার ক্যাটালগ থেকে যে কোনো ঘড়ি পছন্দ করতে পারো, কিনে দেব। কিন্তু যদি আমি ম্যাচসেরা হই তাহলে তুমি কিনে দেবে। তাই (অধিনায়ককে) মনে করিয়ে দিতে চাই, তোমার কাছে আমার তিনটি ঘড়ি পাওনা আছে।’ যদি ভেবে থাকেন ঘটনার ঘনঘটার এখানেই শেষ, তাহলে ভুল হবে। রাজা এরপর আরও একটি ঘটনা জানালেন। আজকের ম্যাচে সামর্থ্য নিংড়ে খেলার প্রেরণাটা তিনি কোত্থেকে তুলে নিয়েছেন, জানালেন সে কথাও, ‘আরেকটি বিষয় জানাতে চাই। আজ সকালে রিকি পন্টিং আমাকে একটি ভিডিওবার্তা পাঠান। সেখানে প্রেরণামূলক অনেক কথা ছিল। এমনিতে প্রেরণা তো থাকেই, তবে আরও বেশি উদ্দীপনা যদি কোথাও থেকে পেয়ে থাকি তাহলে সেটি সেই ভিডিওবার্তা। রিকি পন্টিংকে ধন্যবাদ।’
রাজা, আপনাকেও ধন্যবাদ ক্রিকেটে ফিরে আসার জন্য। ছোট দেশের বড় রাজা হয়ে ওঠার জন্য। নাহ, ভুল হলো, এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ছোট দল বলে কিছু নেই।