বিশ্বকাপ আক্ষেপ হয়েই থাকল নিউজিল্যান্ডের সোনালি প্রজন্মের

কেইন উইলিয়ামসনের দল ২০২৪ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়েছেআইসিসি

৭৫.২ ওভার। ভেঙে বললে ৪৫২ বল।

নিউজিল্যান্ড–আফগানিস্তান ও নিউজিল্যান্ড–ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচের পুরো খেলার যোগফল এটি। তবে দুটি ম্যাচই নয়, বলতে পারেন ২০২৪ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের দৌড়ানো পথই এটুকু।

গ্রুপ পর্বে এখনো দুটি ম্যাচ বাকি কেইন উইলিয়ামসনদের। কিন্তু উগান্ডা ও পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে সেই দুটি ম্যাচ এখন খেলা না–খেলায় কিছু আসে যায় না। ‘সি’ গ্রুপ থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পর আফগানিস্তানও সুপার এইট নিশ্চিত করে ফেলায় নিউজিল্যান্ডের বিদায় নিশ্চিত হয়ে গেছে। যে বিদায়ের মঞ্চ কিউই ক্রিকেটে অনেক দিন ধরেই অচেনা। প্রথম পর্ব থেকে বাদ পড়ার অচেনা সেই পথ বলছে, একটি সোনালি প্রজন্মের দিনও এখন সমাগত।

এক দশক ধরে সাদা বলের আইসিসি টুর্নামেন্টে সবচেয়ে সফল দল নিউজিল্যান্ড। না, এ সময়ে একটিও ট্রফি জেতেনি দলটি। কিন্তু ২০১৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ওয়ানডে ও টি–টোয়েন্টি মিলিয়ে হওয়া ৬ বিশ্বকাপের সব কটিতে সেমিফাইনাল খেলা একমাত্র দল নিউজিল্যান্ড। এর মধ্যে ২০১৯ সালের ওয়ানডে আর ২০২১ সালের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ফাইনালও খেলেছেন উইলিয়ামসনরা (যদিও দুটিতেই হেরেছেন)। একই দল জিতেছে ২০২১ ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপও। কন্ডিশন আর ফর্ম যেমনই থাক, আইসিসি টুর্নামেন্টে শেষ চারে ওঠাকে রীতিমতো ‘রুটিন’ বানিয়ে ফেলেছিল নিউজিল্যান্ড। অথচ সেই দলটিই এবার পাঁচ দলের গ্রুপ থেকে বাদ প্রথম পর্বেই!

নিউজিল্যান্ডের আইসিসি টুর্নামেন্টে প্রথম ধাপ পেরোতে না পারার সর্বশেষ ঘটনাটি ২০১৪ সালের। সে বার বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ড খেলেছিল সুপার টেন পর্ব থেকে। কার্যত যা প্রথম পর্ব। র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ আটে থাকার সুবিধায় টুর্নামেন্ট শুরু করলেও সেখানেই থেমে গিয়েছিল ব্রেন্ডন ম্যাককালামের দল। ২০১৬ সালে প্রকাশিত আত্মজীবনী ‘ডিক্লেয়ার্ড’–এ ম্যাককালাম লিখেছিলেন, ওই ‘মুহূর্তটা ছিল বালুরেখা’র মতো। যার বাইরে আর যাওয়া যায় না।  

আরও পড়ুন

তবে একই বছরের জুনের স্মৃতি বর্ণনা করতে ম্যাককালামের লেখায় ছিল উচ্ছ্বাসের সুর। সেবার টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়েছিল নিউজিল্যান্ড। সিরিজের তৃতীয় টেস্টের শেষ দিনে ৫৩ রানে ম্যাচ জিতে সিরিজ ২–১ ব্যবধানে জেতে ম্যাককালামের দল। সেটি ছিল ২০০২ সালের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের প্রথম সিরিজ জয়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ে বাদ দিলে সেটিই ছিল এক যুগের মধ্যে কিউইদের প্রথম অ্যাওয়ে সিরিজ জয়। উচ্ছ্বসিত ম্যাককালাম তাঁর বইয়ে ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে সিরিজ জয়কে উল্লেখ করেছিলেন ‘আমার নিউজিল্যান্ড ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গৌরবময় মুহূর্ত’ বলে।

এবারের বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের পথচলা থেমে যাচ্ছে প্রথম পর্বেই
ব্ল্যাকক্যাপস

ম্যাককালামের বর্ণ্যাঢ্য ক্যারিয়ারের গৌরবের মুহূর্তে জড়িয়ে থাকা সেই দলের বেশির ভাগই পরবর্তী এক দশকে কিউই ক্রিকেটের নিয়মিত মুখ হয়ে থেকেছেন। উইলিয়ামসনের বয়স ছিল ২৪–এর কাছাকাছি, টিম সাউদি ২৫, জিমি নিশাম ২৩, টম ল্যাথাম ২২ আর ইশ সোধি ২১ বছর। এদের সবাই পরের ১০ বছরে নিউজিল্যান্ডের হয়ে এক শর বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। এর মধ্যে উইলিয়ামসন আর সাউদির টেস্টসংখ্যাই এক শ হয়ে গেছে। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ বাদে আর কোনো ট্রফি না আসুক, নিয়মিতই শেষ চারে খেলার অন্যতম কারণই ছিল দীর্ঘদিন একসঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতা। সেই ধারাবাহিকতায় তৈরি করা হয়েছিল এবারের বিশ্বকাপের দলও। ২০২২ বিশ্বকাপে খেলা দলের ১৩ জনকেই দেওয়া আরেকটি বিশ্বকাপ জার্সি। ১৫ জনের দলে বয়সে চতুর্থ সর্বকনিষ্ঠ যিনি, সেই মার্ক চ্যাপম্যানও আগামী ২৭ জুন ত্রিশ বছর পূর্তির কেক কাটবেন।

আরও পড়ুন

কিন্তু অভিজ্ঞতা কিংবা সর্বশেষ ছয় আইসিসি টুর্নামেন্টের সাফল্য—কোনোটাই এ যাত্রায় আর নিউজিল্যান্ডকে উদ্ধার করতে পারেনি। প্রথমে আফগানিস্তানের কাছে মাত্র ৭৫ রানে অলআউট হয়ে ৮৪ রানের বড় হার, যা আফগানদের কাছেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম হার। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হার ১৩ রানে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝাতে গিয়ে কোচ গ্যারি স্টিড তাই অকপটে বলে ফেলেন, ‘কিছুটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ছেলেরা হতাশ। এখানে এসেছিলাম ম্যাচ জিততে, টুর্নামেন্ট জিততে।’

হতাশা নিয়ে দেশে ফিরতে হচ্ছে নিউজিল্যান্ড দলকে
ব্ল্যাকক্যাপস

টুর্নামেন্ট জয়ের লক্ষ্য নিয়ে আসা একটি দল কেন প্রথম পর্বেই বিদায় নিচ্ছে, এ নিয়ে কাঁটাছেড়ে করছেন অনেকেই। অনেকের কথায় উঠে এসেছে প্রস্তুতির অভাবের কথা। গত ফেব্রুয়ারির পর নিউজিল্যান্ডের বিশ্বকাপে থাকা খেলোয়াড়েরা একসঙ্গে ম্যাচ খেলেননি। মধ্যে পাকিস্তানে গিয়ে পাঁচ টি–টোয়েন্টির সিরিজ খেললেও সেটি ছিল দ্বিতীয় সারির দল। বিশ্বকাপ দলের ৯জনই ছিলেন আইপিএলে। আইসিসি যখন আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি ম্যাচের সূচি ঠিক করছিল, তখন খেলোয়াড় স্বল্পতার কথা ভেবে ম্যাচ নেয়নি নিউজিল্যান্ড। তবে শেষ দিকে চাইলেও তত দিনে আর ম্যাচের ব্যবস্থা হয়নি। আর তাই প্রস্তুতি ছাড়াই বিশ্বকাপের মঞ্চে খেলতে নামে নিউজিল্যান্ড, ফলাফল গায়ানায় আফগানিস্তান আর ত্রিনিদাদে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হারের হতাশা।

আজকের আফগানিস্তান–পাপুয়া নিউগিনি ম্যাচের পর যা আর হারের হতাশায় সীমাবদ্ধ নেই। নিউগিনিকে হারিয়ে আফগানদের সুপার এইট নিশ্চিত নিউজিল্যান্ডের জন্য খুলে দিয়েছে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায়ের দরজা। একই সঙ্গে বিদায়ের ক্ষণ এনে দিয়েছে সোনালি এক প্রজন্মেরও, যারা আট বছরের মধ্যে খেলেছে দুটি ফাইনালসহ ছয়টি সেমিফাইনাল। ভারত–শ্রীলঙ্কায় হতে যাওয়া ২০২৬ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও হয়তো কেউ কেউ থেকে যাবেন। কিন্তু কিউই ক্রিকেটের সাফল্যের পথচলাটা ক্যারিবিয়ান দ্বীপে থেমেই গেল!