মাঠে থেকে, একেবারে পাশে দাঁড়িয়ে প্রায় খুঁটে খুঁটে দেখে ধনাঞ্জয়া ডি সিলভা উইকেট সম্পর্কে যে ধারণা পেলেন, সেই একই ধারণা কাল দূরের প্রেসবক্স থেকেও পাওয়া যাচ্ছিল। সবুজ মাঠের মাঝখানে সাদা একখণ্ড জমিন। একটু কল্পনাপ্রবণ হলেই মনের পর্দায় ভাসিয়ে তোলা যাচ্ছিল ব্যাটসম্যানদের দুর্দান্ত সব শট, লম্বা ইনিংস, বড় জুটি এবং সময়ের দেয়ালে ক্রমেই ঝুলে যাওয়া একটা টেস্ট।
টেস্ট ম্যাচ পাঁচ দিনের খেলা। প্রতিটি দিন আসে ভিন্ন পরিস্থিতি আর সম্ভাবনা নিয়ে। কখনো কখনো চরম ব্যাটিং উইকেটেও তৈরি হতে পারে রোমাঞ্চকর আবহ। কাজেই শুধু কল্পনার আশ্রয় নিয়ে টেস্ট শুরুর আগের দিনই এর শেষ দেখে ফেলার চেষ্টা একটু বাড়াবাড়ি। তবে সমস্যা হলো জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের উইকেট সব সময়ই ব্যাটিং–স্বর্গ, যেটিতে এবার আরও বেশি ব্যাটিংয়ের মধু ঢালার চেষ্টা হয়েছে।
কাল শেষ বেলায় ঘাস কাটার মেশিন চালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে সবুজের শেষ আবরণটুকু। উইকেটের বিভিন্ন অংশে গলফ বল ড্রপ দিয়ে কিউরেটরদের বাউন্স বোঝার আগাম চেষ্টায় স্পষ্ট—এই টেস্টে বড় প্রভাবক করে তোলা হতে পারে উইকেটকেই। সেটি যদি দুই দলই সমানভাবে কাজে লাগাতে পারে, চট্টগ্রামে রানপ্রসবা এক টেস্টই আশা করা যায়। যার শেষটা রোমাঞ্চক করে তুলতে নায়ক হতে হবে বোলারদেরই।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের সর্বশেষ তিনটি টেস্ট ড্র–ই হয়েছে এখানে। আজ শুরু সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের আগেও বেশি করে আলোচনায় আসছে চট্টগ্রামের উইকেট এবং এই উইকেটে টেস্টের সম্ভাব্য পরিণতি। ম্যাচের ভবিষ্যতের অনেকটাই ঠিক করে দিতে পারে প্রায় সাদা ওই একখণ্ড জমিন। সমস্যা হলো বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের টালমাটাল ফর্ম আর আগের টেস্টে শ্রীলঙ্কার দুই ব্যাটসম্যান ধনাঞ্জয়া ও কামিন্দু মেন্ডিসের ‘ডাবল ডেকার’ শতরান শুরুর ওই কল্পনার ব্যাটিং প্রান্তে শ্রীলঙ্কাকেই রাখছে।
ধরুন রাখলই, তাই বলে বাংলাদেশের দিকে কি কিছুই থাকবে না? প্রায় এক বছর পর সাকিব আল হাসানের প্রত্যাবর্তন টেস্টে এমন প্রশ্নের উত্তরে সরাসরি ‘না’ শব্দটি না বলাই ভালো। সাকিব তাঁর যেকোনো প্রত্যাবর্তনই সাফল্যের রঙে রাঙাতে পছন্দ করেন। চট্টগ্রামের ব্যাটিং উইকেটে সে সম্ভাবনা যেমন তাঁর ব্যাট হাতে থাকবে, বোলিংয়েও বাংলাদেশ অনেকাংশেই তাকিয়ে থাকবে সাকিবের বাঁহাতি স্পিনের দিকে। প্রসঙ্গক্রমে এ মাঠে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তাঁর অতীতেও একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। ২০০৯, ২০১৪ ও ২০২২ সাল মিলিয়ে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মোট তিনটি টেস্ট খেলেছেন সাকিব। একটি অর্ধশতসহ ৪১.২৫ গড়ে রান করেছেন ১৬৫, একটি ৫ উইকেটসহ মোট উইকেট ১৫টি।
প্রত্যাবর্তন টেস্টে সামনে যখন সেই শ্রীলঙ্কা, সাকিবের কাছে ভালো কিছু আশা করতে বাধা কোথায়! কিংবা অন্যভাবে যদি বলেন, এই উইকেটে শ্রীলঙ্কার ব্যাটিংকে অস্বস্তিতে ফেলতে তো স্পিনেই ভরসা বেশি করতে হবে বাংলাদেশকে। সে ক্ষেত্রে সাকিবই বড় আশা হবেন নিশ্চয়ই।
বলা হচ্ছে, চট্টগ্রামের উইকেট হবে ব্যাটিং–স্বর্গ। অথচ সেখানে বাংলাদেশের আশার কথা বলতে গিয়ে তাকানো হচ্ছে বোলারদের দিকে। চিন্তায় এই বৈসাদৃশ্যের কারণটা বুঝতে না পারার কথা নয় কারও। সিলেট টেস্টের দুই ইনিংসে ১৮৮ আর ১৮২ রানে অলআউট হয়ে বাংলাদেশ হেরেছে ৩২৮ রানে। ব্যাটিং উইকেটেও তাই ব্যাটসম্যানদের কাছে কিছু চাইতে বুক দুরু দুরু কাঁপে। ব্যাটিংয়ের দুই নির্ভরতা নাজমুল হোসেন আর লিটন দাসের রানের জন্য সংগ্রাম, মুমিনুল হক ছাড়া টপ এবং মিডল অর্ডারের অন্য ব্যাটসম্যানদের জ্বলে উঠতে না পারা—শুধু কন্ডিশনের বদলেই কি সম্ভব এই ছবিগুলো উল্টে দেওয়া? টেস্ট জিততে হলে বোলারদের যেমন প্রতিপক্ষের ২০ উইকেট নিতে হয়, ব্যাটসম্যানদেরও স্কোরবোর্ডে সেই রানটা রাখতে হয়, যেটা নিয়ে লড়াই করার সাহস পাবেন বোলাররা। সিলেট টেস্টের তিক্ত অভিজ্ঞতাই ব্যাটসম্যানদের কাছে সে রকম আশায় বাদ সাধছে।
অবশ্য আরেকটু বেশি অতীতে ফিরে গিয়ে যদি ২০২২ সালের মে মাসে এ মাঠে ড্র হওয়া শ্রীলঙ্কা টেস্টটার দিকে তাকান, তিন ইনিংসও পুরো হতে না পারা ওই টেস্টে শতরান ছিল তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিমের। আরও পেছনে যান…২০১৮। দুই ইনিংসেই মুমিনুল হকের শতরান, প্রথম ইনিংসে মুশফিকুর রহিমের ৯২, মাহমুদউল্লাহর ৮৩, লিটনের ৯৪। বাংলাদেশের তিনটি শতক (শামসুর রহমান, ইমরুল কায়েস ও মুমিনুল হক) ছিল ২০১৪ সালে ড্র হওয়া টেস্টেও। অবশ্য ও রকম ব্যাটিংয়ের পরও টেস্টগুলো বাংলাদেশ কেন জেতেনি, তা তো বুঝতেই পারছেন। শ্রীলঙ্কার ব্যাটসম্যানদেরও নিরাশ করেনি চট্টগ্রামের উইকেট।
তবু ব্যাট হাতে কম্পমান বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের রানে ফেরার আশায় আত্মবিশ্বাসের প্রবাহ তো দিতেই পারে সর্বশেষ তিন টেস্টের স্কোরকার্ড। তারপর না হয় ফলাফলের চিন্তা। এটাও জানা কথা যে শ্রীলঙ্কার ব্যাটিংটা খুব খারাপ না হলে এখানে ফলাফল বাংলাদেশের দিকে আনাটাও কঠিন। সেটা চিন্তা করেই হয়তো বাংলাদেশ আগে অন্তত মাঝামাঝি অবস্থানটা নিশ্চিত করতে চাইছে। তারপর বাকি কাজটা বোলাররা করে দিলে তো ভালোই।
নাজমুল হোসেন এমন কথায় আপত্তি করতে পারেন। কারণ, সিলেটে হারার পরও চট্টগ্রাম টেস্ট নিয়ে সেখানেই অধিনায়ক বলে এসেছেন, ড্রয়ের উদ্দেশ্য গা বাঁচানো নিরাপদ ক্রিকেট নয়, চট্টগ্রামে বাংলাদেশ খেলবে জেতার জন্যই।