কোটি টাকার হৃদয়ের কোটি টাকার ব্যাটিং
তাওহিদ হৃদয়ের নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়ার গল্পটা নতুন নয়। গত বিপিএলেই সিলেট স্ট্রাইকার্সের জার্সিতে হৃদয় দেখিয়েছেন তাঁর টি-টোয়েন্টির সামর্থ্য (১২ ইনিংসে ৩৬ গড় ও ১৪০ স্ট্রাইক রেটে ৪০৩ রান)।
বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের ব্যাটিং কৌশলে ফিরে গিয়ে ‘হার্ড হিটার’ হৃদয়কে খুঁজে বের করেছেন, দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে সিলেটকে নিয়ে গেছেন বিপিএল ফাইনালে। শিরোপা জিততে না পারলেও নির্বাচকদের মন জিতেছেন। বিপিএল পারফরম্যান্স দিয়েই খুব দ্রুত ঢুকে পড়েছেন জাতীয় দলে।
এসবই অবশ্য পুরোনো গল্প। এবারের বিপিএলে সেই হৃদয় এখন পর্যন্ত কী করেছেন, তা একটু দেখে নেওয়া যাক। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের হয়ে ১৩ ইনিংসে হৃদয়ের রান ৪৪৭, গড় ৪০.৬৩, স্ট্রাইক রেট ১৪৯.৪৯।
এখন পর্যন্ত টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকার শীর্ষস্থানও হৃদয়ের দখলে। এবারও তাঁর দল কুমিল্লা জায়গা করে নিয়েছে বিপিএল ফাইনালে। রান, গড়, স্ট্রাইক রেট—সব ক্ষেত্রেই গতবারের পারফরম্যান্সকে ছাড়িয়ে গেছেন এই তরুণ। তিনি এমন জায়গায় পৌঁছে গেছেন, যেখানে এর আগে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান যেতে পারেননি। বিপিএলের ইতিহাসে ১৪০-এর বেশি স্ট্রাইক রেটে ৪০০-এর বেশি রান করা একমাত্র বাংলাদেশি হৃদয়। এর আগে যাঁরা এই কীর্তি গড়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই বিদেশি।
২০২২ বিপিএলে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের ইংলিশ ওপেনার উইল জ্যাকস ৪১৪ রান করেছেন ১৫৫ স্ট্রাইক রেটে। ২০১৯-২০ মৌসুমে খুলনা টাইগার্সের রাইলি রুশোর ৪৯৫ রান এসেছে ১৫৫ স্ট্রাইক রেটে। এর আগের মৌসুমেও দাপট দেখিয়েছেন এই প্রোটিয়া। ২০১৮-১৯ মৌসুমে ১৫০ স্ট্রাইক রেটে ৫৫৮ রান করেছেন তিনি। ২০১৭-১৮ মৌসুমটা ছিল ক্রিস গেইলের। রংপুর রাইডার্সের হয়ে তিনি ৪৮৫ রান করেছেন অবিশ্বাস্য ১৭৬ স্ট্রাইক রেটে। ২০১২ সালে বিপিএলের উদ্বোধনী আসরে বরিশাল বার্নার্সের আহমেদ শেহজাদের ৪৮৬ রান এসেছে ১৫৫ স্ট্রাইক রেটে।
বুঝতেই পারছেন, বিপিএলে বেশি স্ট্রাইক রেট ও বেশি গড়ে রান করার কাজটা মূলত বিদেশিদেরই। ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে বিদেশি তারকাদের উড়িয়ে আনে এ জন্যই। পাওয়ারপ্লেতে বিস্ফোরক ব্যাটিং করবেন, মাঝের ওভারে দলের ইনিংসটাকে সাজাবেন। মঞ্চটাকে তৈরি করে দেবেন আরও এক বিদেশির জন্য, যিনি ইনিংসটা শেষ করে আসবেন চার-ছক্কায়।
বিপিএলে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের দায়িত্ব বরাবরই পার্শ্বনায়কের। পাওয়ারপ্লেতে বিদেশি ‘হিটার’ মারবেন, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের কাজ হবে তাঁকে সঙ্গ দেওয়া, জুটি গড়া। ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো দল সাজায়ও এই ভাবনা থেকে। তাই বিপিএলে বেশির ভাগ দেশি ব্যাটসম্যানের স্ট্রাইক রেট খুব ভালো হলেও ১২০ থেকে ১৩০-এর ঘরেই থাকে।
হৃদয় এ নিয়ে টানা দুই বছর সেই ‘বাংলাদেশি স্ট্রাইক রেট’ থেকে বেরিয়ে এসেছেন। সাকিব আল হাসান তা করছেন তিন বছর ধরে। তবে সাকিবের রান গত তিন বিপিএলে ৪০০ ছুঁতে পারেনি। হৃদয় নিয়মিত বড় ইনিংস খেলছেন এবং তাঁর ব্যাট থেকে রান আসছে বেশ দ্রুত। তিনি যেন বাংলাদেশেরই গেইল কিংবা রুশো!
গত বিপিএলে নিশ্চয়ই হৃদয়ের ব্যাটিংয়ে এমন কিছুর সম্ভাবনা দেখেছিলেন কুমিল্লার কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। সে জন্যই ড্রাফটের বাইরে থেকে হৃদয়কে দলে ভেড়াতে একটুও দ্বিধা করেননি। তবে ২৩-এর তরুণকে দলে ভেড়াতে কুমিল্লাকে মোটা অঙ্কের টাকা গুনতে হয়েছে। জানা গেছে, কুমিল্লার সঙ্গে হৃদয়ের চুক্তি এক কোটি টাকারও বেশি।
অবশ্য টাকার অঙ্ক যা-ই হোক, কুমিল্লার যে ‘পয়সা উশুল’ হয়েছে, সেটা নিশ্চিত। কাল মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে প্রথম কোয়ালিফায়ারে হৃদয়ের ব্যাট থেকে এসেছে ৬৪ রানের একটি ঝলমলে ইনিংস।
এর আগে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে খুলনা টাইগার্সের বিপক্ষে রান তাড়ায় অপরাজিত ৯১ রান করেন। তার আগে সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে হৃদয় দুর্দান্ত ঢাকার বিপক্ষে খেলেছেন ১০৮ রানের অপরাজিত ইনিংস, যা ছিল এবারের বিপিএলের প্রথম সেঞ্চুরি।
হৃদয়ের তিনটি ইনিংসই এসেছে রান তাড়ায়। তিনটি ম্যাচই জিতেছে কুমিল্লা। চট্টগ্রামে তাই কুমিল্লার কোচ সালাউদ্দিনই মজা করে বলছিলেন, ‘আমার মনে হয়, আমাদের বিনিয়োগটা ভালো ছিল। আমরা ঠিক খেলোয়াড়কে নিয়েছি। দুটি ম্যাচ একাই জিতিয়েছে। সে যেভাবে খেলে, স্ট্রাইক রেট বলেন আর যেটাই বলেন, তা দিয়ে দলটাকে এগিয়ে নিয়ে আসে। আমাদের বিনিয়োগটা খুব ভালো হয়েছে।’
কুমিল্লার অধিনায়ক লিটনের গতকালের কথা শুনলেও তা-ই মনে হবে। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে হৃদয় কেন ব্যতিক্রম, লিটনের ব্যাখ্যা ছিল এমন, ‘সে ভালো বলে ছয় মারতে পারে, যেটা আমাদের দেশে খুব কম ব্যাটসম্যান পারে। স্বাভাবিক, যেকোনো বোলার যে সংস্করণেই হোক না কেন, উইকেটেই বল করবে। আর সে উইকেটের বলটাই খুব বেশি ভালো মারে। এটা সে নয়, যারা বিশ্ব ক্রিকেটে সফল ব্যাটসম্যান, সবাই স্টাম্পের বল ভালো খেলে। আমার মনে হয়, এটা তার সবচেয়ে ভালো প্লাস পয়েন্ট। দেখতে ছোট হলেও বড় বড় ছয় মারতে পারে।’
এ তো গেল কৌশলগত ব্যাখ্যা; ভালো যেকোনো কিছুরই পেছনে থাকে কঠোর পরিশ্রম। সেখানেও লিটনের চোখে অন্যদের চেয়ে আলাদা হৃদয়, ‘যেটুকু সামনে থেকে দেখি, আমার মনে হয়, সে ক্রিকেট নিয়ে অনেক চিন্তা করে। অনেক হার্ড ওয়ার্কার। সাধারণত খুব কম ক্রিকেটার এত ঘন ঘন জিমে যায়। কোনো না কোনো কাজ করতেই থাকে। এটা তার ভালো একটা দিক।’
সামনেই যেহেতু টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, হৃদয়ের ছন্দ শুধু কুমিল্লার নয়, বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্যও ভালো দিক।