বিশ্বকাপে নিউইয়র্কের পিচ: কারও চোখে বিপজ্জনক, কারও চোখে জঘন্য
একই লেংথের বল, অথচ একটি পিচে পড়ার পর ব্যাটসম্যানের বুক বরাবর আসছে তো আরেকটি যাচ্ছে হাঁটুর নিচ দিয়ে। ভালো লেংথের বল সামলানো তো ব্যাটসম্যানদের জন্য আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অস্বাভাবিকভাবে বল উঠে কোনোটি ব্যাটসম্যানের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে আবার কোনো কোনোটি হেলমেটে আঘাত করছে।
কোন পিচ ব্যাটসম্যানদের জন্য বধ্যভূমি হয়ে উঠেছে—ওপরের অংশটি পড়ার পর নিশ্চয় বুঝে ফেলেছেন। নিউইয়র্কের নাসাউ কাউন্টি স্টেডিয়ামের ২২ গজ এখন এক গোলকধাঁধা! ব্যাটসম্যানদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা জটিল–দুর্বোধ্য এই পিচ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ নিয়ে আলোচনার টেবিলে ঝড় তুলেছে। সপ্তাহ দুয়েক আগেও যেসব ক্রিকেটপ্রেমী আইপিএলে রানবন্যায় বুঁদ হয়ে ছিলেন, তাঁরাই নিউইয়র্কের পিচের কারসাজিতে দেখছেন টি–টোয়েন্টিতেও রান তোলা কতটা কঠিন!
যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে ক্রিকেট ছড়িয়ে দেওয়ার যে ইচ্ছা নিয়ে আইসিসি নিউইয়র্কে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আটটি ম্যাচ রেখেছে, সূচি ঘোষণার পর সর্ব মহলেই তা বাহবা পেয়েছে। কিন্তু বিশ্বকাপ শুরু হতেই ক্রিকেট বিশ্লেষকেরা আইসিসিকে তুলেছেন কাঠগড়ায় আর নিউইয়র্কের পিচকে রেখেছেন আতশি কাচের তলে।
নিউইয়র্কের নাসাউ কাউন্টি স্টেডিয়ামে এখন পর্যন্ত দুটি ম্যাচ হয়েছে। দুই ম্যাচ মিলিয়ে রান উঠেছে মাত্র ৩৫০। ইনিংসগুলো দেখুন না—শ্রীলঙ্কা ৭৭ রানে অলআউট। লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে দক্ষিণ আফ্রিকা ৪ উইকেটে ৮০, খেলতে হয়েছে ১৬.২ ওভার। গত সোমবার শ্রীলঙ্কা–দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ দিয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আয়োজনের যাত্রা শুরু হয় নিউইয়র্কের। নাসাউ কাউন্টি স্টেডিয়ামের অভিষেকে লো স্কোরিং ম্যাচ নিশ্চিতভাবেই কোনো ক্রিকেট অনুরাগীকে তৃপ্তি দিতে পারেনি।
তবে প্রথম ম্যাচ বলেই হয়তো নিউইয়র্কের পিচ নিয়ে সমালোচনা সেদিন ততটা ডালপালা মেলেনি। কিন্তু গত রাতে ভারত–আয়ারল্যান্ড ম্যাচেও একই দৃশ্যের অবতারণা হওয়ার পর পিচ নিয়ে সমালোচনা চরম মাত্রায় পৌঁছে গেছে। টি–টোয়েন্টিতে ভয়ডরহীন খেলে অনেকের প্রশংসা কুড়ানো আয়ারল্যান্ড কাল ৯৬ রানেই শেষ! ভারত লক্ষ্য তাড়া করেছে ১২.২ ওভারে, হারিয়েছে ২ উইকেট।
ভারতের স্কোরকার্ড দেখে থাকলে লক্ষ্য তাড়াকে সহজ মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভারতকেও কম বেকায়দায় ফেলেনি নিউইয়র্কের পিচ। জশ লিটলের বলে বাহুর উপরিভাগে আঘাত পেয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছে রোহিত শর্মাকে। সেই লিটলের বলেই ঋষভ পন্ত কনুইয়ে চোট পান। ঘটনার পর মাঠে ছুটে যাওয়া ভারতীয় দলের ফিজিওর কাছ থেকে প্রাথমিক চিকিৎসাও নিতে হয়েছে পন্তকে।
এমন নয় যে লিটল কাল দুর্দান্ত বোলিং করেছেন। বরং অন্য বোলারদের মতোই শুধু বল ছুড়েছেন, বাকি কাজ পিচই করে দিয়েছে। আয়ারল্যান্ডের হ্যারি টেক্টরও ব্যাটিংয়ের সময় শরীরের বিভিন্ন জায়গায় একাধিকবার আঘাত পেয়েছেন।
প্রশ্ন হলো, নিউইয়র্কের নাসাউ কাউন্টি স্টেডিয়ামের পিচ কেন এমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে? উত্তরও এত দিনে জেনে যাওয়ার কথা। এই মাঠে মোট ১০টি ড্রপ ইন (প্রতিস্থাপনযোগ্য বা অন্যত্র থেকে নিয়ে এসে বসানো) পিচ রয়েছে। এর মধ্যে ৪টি পিচ মূল মাঠে এবং ৬টি অনুশীলনের জন্য।
এসব পিচ অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে বানানো হয়েছে, কারিগর অ্যাডিলেড ওভালের প্রধান পিচ কিউরেটর ডামিয়ান হফ। অ্যাডিলেড থেকে পিচগুলো জাহাজে করে পাঠানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায়। এ বছরের শুরুর দিকে ফ্লোরিডা থেকে নিয়ে এসে বসানো হয় নিউইয়র্কের নাসাউ কাউন্টি স্টেডিয়ামে। কিন্তু ড্রপ–ইন পিচ স্থায়ীভাবে বসে যেতে আরও অনেক সময়ের প্রয়োজন। সেই সময়টা পায়নি বলেই ব্যাটসম্যানদের নাভিশ্বাস তুলে ছাড়ছে।
বর্তমানে নিউইয়র্কের ড্রপ–ইন পিচগুলো যে অবস্থায় আছে, তাতে কেউ এটিকে ‘বিপজ্জনক’ আবার কেউ ‘জঘন্য’ বলে বর্ণনা করেছেন।
জিম্বাবুয়ের সাবেক অধিনায়ক ও ইংল্যান্ডের সাবেক প্রধান কোচ অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ইএসপিএন ক্রিকইনফোর ‘টাইম আউট’ অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘বলতে বাধ্য হচ্ছি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য এ ধরনের পিচ মোটেও ভালো নয়। এটা এখন বিপৎসীমার ওপরে অবস্থান করছে। আপনারা দেখেছেন বল একই লেংথে পড়ে দুই দিকেই বাঁক খাচ্ছে। কিছু বল স্কিড করে নিচু হয়ে আসছে। বাউন্সগুলো অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে এবং ব্যাটসম্যানদের বৃদ্ধাঙ্গুলি, গ্লাভস ও হেলমেটে আঘাত করছে। এ ধরনের পিচ সব ব্যাটসম্যানের জীবন খুব কঠিন করে তুলেছে।’
ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক মাইকেল ভন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেছেন, ‘জঘন্য পিচ। যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেট বিক্রির চেষ্টা করা বড় ব্যাপার, আমার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু খেলোয়াড়দের নিউইয়র্কের যে নিকৃষ্ট মানের পিচে খেলানো হচ্ছে, তা অগ্রহণযোগ্য। দলগুলো বিশ্বকাপে জায়গা করে নেওয়ার জন্য এত পরিশ্রম করল। আর এখন এ ধরনের পিচে খেলতে হচ্ছে।’
দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তানের সাবেক কোচ মিকি আর্থার এক্সে লিখেছেন, ‘নিউইয়র্কের এই পিচ খুবই বাজে।’ ভারতের সাবেক ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ কাইফ রোহিত শর্মার প্রশংসা করলেও পিচের নিন্দা জানিয়েছেন, ‘রোহিত শর্মার অর্ধশতকের জন্য করতালি। নিউইয়র্ক বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন পিচ। যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেটের জন্য এটি ভালো বিজ্ঞাপন নয়।’
তাহলে কি নিউইয়র্কের পিচে ‘হাই স্কোরিং’ ম্যাচ দেখা যাবে না? এ ধরনের পিচে রান করার জন্য ব্যাটসম্যানদের একটা উপায় বাতলে দিয়েছেন আইপিএলে ১৫ বছর ধরে কোচিং করানো এক বিখ্যাত কোচ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই কোচ ক্রিকবাজকে বলেছেন, ‘এ ধরনের পিচে আপনি সুইপ–রিভার্স সুইপও খেলতে পারেন। তবে ছক্কার পরিবর্তে স্কয়ার অব দ্য উইকেট দিয়ে এক বা দুই বাউন্সে চার মারার চিন্তা করতে হবে। এ ছাড়া ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এসে না খেলে ইনসাইড আউট শট খেলতে হবে। আপনি এভাবে ব্যাট করতে থাকলে বোলাররা কিছুটা ফুল লেংথে বল করার চেষ্টা করবে। তখন আপনি ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এসে ছক্কা মারার চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু এ ধরনের শট খেলার সময় ব্যাট কোনাকুনিভাবে চালাতে হবে, সোজা চালালে হবে না।’
সে না হয় হলো, কিন্তু নাসাউ কাউন্টি স্টেডিয়ামের আউটফিল্ডও তো ভারী আর মন্থর। স্টেডিয়াম নির্মাণের আগে এ মাঠ ছিল বালুময়। সেই বালু এখনো রয়ে গেছে। ফিল্ডাররা দৌড়ানোর সময় যেন বালু না ওড়ে এবং মাটি যেন উঠে না আসে, সে কারণে ঘাস কিছুটা বড় রাখতে হয়েছে। এই লম্বা ঘাসের মধ্যে বল প্রায়ই থেমে যাচ্ছে।
নিউইয়র্কে আগামী এক সপ্তাহে আরও ছয়টি ম্যাচ হবে। সবচেয়ে বড় ম্যাচ কোনটা, নিশ্চয় জানেন। আগামী রোববার সেখানে মুখোমুখি ভারত–পাকিস্তান। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের ম্যাচটিও ড্রপ–ইন পিচে হবে। এমন পিচে রোহিত–বাবরদের লড়াই কল্পনাও করতে পারছেন না জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার হার্শা ভোগলে। এক্সে তিনি লিখেছেন, ‘(নিউইয়র্কের) পিচগুলো নিয়ে কিছু একটা করতে হবে। এ ধরনের পিচে ভারত–পাকিস্তান ম্যাচ কল্পনাও করতে পারছি না।’
কিন্তু আইসিসি চাইলেও এখন আর নিউইয়র্কের পিচ বদলে ফেলার সুযোগ নেই। বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে তাই হয়তো আরও কিছুদিন সমালোচনার তিরে বিদ্ধ হতে হবে। নতুন এক শিক্ষাও তো হবে!