অ্যাশেজ কোন দল জিতবে, কেন জিতবে
মাইকেল ভন, অ্যালিস্টার কুক, কেভিন পিটারসেন আর নাসের হুসেইন—চারজনের বড় মিল, তাঁরা সবাই ইংল্যান্ডকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে পিটারসেনকে আলাদা করা যায় সহজেই। বাকি তিনজন জন্মসূত্রে ‘ইংলিশ’ হলেও পিটারসেন মূলত দক্ষিণ আফ্রিকান। ইংল্যান্ড দলে খেলেছেন ও নেতৃত্ব দিয়েছেন নাগরিকত্ব সূত্রে।
কে জিতবে এবারের অ্যাশেজ ভবিষ্যদ্বাণীতেও ভন, কুক আর হুসেইনদের চেয়ে আলাদা হয়ে গেলেন পিটারসেন। ভন, কুকের মতে, ইংল্যান্ড অ্যাশেজ জিতবে ৩–১ ব্যবধানে; হুসেইনের মতে, ৩–২। কিন্তু ‘ইংল্যান্ডের জয় চাই’ বলেও পিটারসেনের ভবিষ্যদ্বাণী অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে—তা–ও অস্ট্রেলিয়া ৪, ইংল্যান্ড ১!
সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটারদের মতো নিজ দেশের পক্ষে বাজি অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদেরও। জেসন গিলেস্পি রয়েসয়ে সম্ভাব্য ফল ৩–১ বললেও গ্লেন ম্যাকগ্রা বলে দিয়েছেন ৫–০। সাবেক ক্রিকেটারদের এই ভবিষ্যদ্বাণী কিংবা আশাবাদের মূলে আছে নানামুখী ভাবনা। কন্ডিশন, খেলার ধরন, খেলোয়াড়দের ফর্মসহ পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন উপাদান তাঁদের ভাবনার প্রভাবক।
আজ শুরু হতে যাওয়া অ্যাশেজ লড়াইয়ে যা কিছু ফল নির্ধারণে প্রভাবক হয়ে উঠতে পারে, সেটিই দেখে নেওয়া যাক এবার।
বাজবল ক্রিকেট
ব্রেন্ডন ম্যাককালাম কোচের দায়িত্ব নেওয়ার আগে ১৭ টেস্টের মাত্র ১টিতে জিতেছিল ইংল্যান্ড। ২০২২ সালের মে মাসে ম্যাককালাম দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৩ টেস্টের ১১টিতেই জিতেছে বেন স্টোকসের দল। মূলত এ সময়ে ইংল্যান্ডের খেলার ধরনে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। আক্রমণাত্মক ও ফলকেন্দ্রিক খেলার এই ধারাকে ম্যাককালামের ডাকনাম ‘বাজ’র সঙ্গে জড়িয়ে ‘বাজবল’ নামে ডাকা হচ্ছে।
এবারের অ্যাশেজে ইংল্যান্ডের সাফল্য পাওয়া না–পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে এই বাজবল। ইংল্যান্ড অধিনায়ক তো বলেই দিয়েছেন, নিজেদের খেলার ধরনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গ্রাউন্ড স্টাফদের ‘ফাস্ট অ্যান্ড ফ্ল্যাট পিচ’ বানাতে বলেছে তাঁর দল। নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ‘বাজবল’ ক্রিকেট সফল। এবার ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেটা কতটা কাজে লাগে, সেটি দেখার অপেক্ষায় অনেকে। দেখার অপেক্ষায় অস্ট্রেলিয়াও। কারণ, ‘বাজবল’কে থামানোর চ্যালেঞ্জ তাদেরই।
হ্যারি ব্রুক, জনি বেয়ারস্টো, বেন স্টোকসরা যে আক্রমণাত্মক মানসিকতা নিয়ে খেলে থাকেন, সেটি কাটিয়ে ওঠার ওপর নির্ভর করছে কতটা ক্রিকেটীয় দক্ষতার দল বর্তমান বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নরা। দুবারের অ্যাশেজজয়ী অধিনায়ক অ্যালিস্টার কুক তো বলেই দিয়েছেন, ‘অস্ট্রেলিয়া বাজবলকে কীভাবে মোকাবেলা করে, সেটি দেখতে মুখিয়ে আছি। কারণ, অনেক প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে এখানে।’
টপ অর্ডার ব্যাটিং
ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া—দুই দলেরই টপ অর্ডার ব্যাটিং নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। গত সপ্তাহে ওভালে হওয়া বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে রান পাননি অস্ট্রেলিয়ার দুই ওপেনার উসমান খাজা ও ডেভিড ওয়ার্নার। খাজার দুই ইনিংসের রান ১৩, ওয়ার্নারের ৪৪। অস্ট্রেলিয়ার সর্বশেষ ভারত সিরিজে রান না পাওয়ায় ওয়ার্নার অ্যাশেজে থাকবেন কি না, এ নিয়েই সংশয় ছিল। এখন দলে থাকলেও কতটা ভালো করবেন, তা দেখার বিষয়। টেস্টে সর্বশেষ ৩৪ ইনিংসে তাঁর একটিই মাত্র সেঞ্চুরি। খাজা তো টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে রান না পাওয়ার এমনও বলেছেন, ‘প্রথম তিন ব্যাটসম্যানের জন্য ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে কঠিন জায়গা ইংল্যান্ড।’
স্বাগতিক ইংল্যান্ডেরও আছে দুশ্চিন্তা। কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে খুব একটা রান পাননি জ্যাক ক্রলি। জুনের শুরুতে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে বেন ডাকেট আর অলি পোপরা তিন অঙ্কের ইনিংস খেললেও ক্রলি পারেননি। আবার ডাকেট এখন রানের মধ্যে থাকলেও অস্ট্রেলিয়ার বোলিংয়ের বিপক্ষে এখনো পরীক্ষায় পড়তে হয়নি তাঁকে। অস্ট্রেলিয়ার শক্তিশালী পেস আক্রমণের বিপক্ষে তাঁর পারফরম্যান্স ইংল্যান্ডের গতিপথে প্রভাবক হয়ে উঠতে পারে।
স্মিথ–রুট ও মিডল অর্ডার
অ্যাশেজ শুরুর দুই দিন আগে যে র্যাঙ্কিং হালনাগাদ করা হয়েছে, সেখানে ব্যাটসম্যানদের মধ্যে প্রথম তিনজনই অস্ট্রেলিয়ার—মারনাস লাবুশেন, স্টিভেন স্মিথ ও ট্রাভিস হেড। অস্ট্রেলিয়ার মিডল অর্ডারে আরও আছেন ক্যামেরন গ্রিন। বিপরীতে ইংল্যান্ডের মিডল অর্ডারে খেলবেন জো রুট, বেন স্টোকস, হ্যারি ব্রুক ও জনি বেয়ারস্টোরা। দুই দলের মিডল অর্ডারের নেতৃত্ব দেবেন মূলত স্মিথ আর রুট। বর্তমানে সক্রিয় ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টেস্ট রান রুটের (১১০০৪), আবার সক্রিয়দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩১ সেঞ্চুরি স্মিথের।
দলের টপ ও মিডল অর্ডারের অন্য ব্যাটসম্যানরা ধরে খেলুক বা মেরে খেলুক, এক প্রান্ত আগলে রাখার কাজটি করতে হবে এ দুজনকেই। এর মধ্যে স্মিথ হয়ে উঠতে পারেন বড় প্রভাবক। ডন ব্র্যাডমান (১৯) ও জ্যাক হবসের (১২) পর অ্যাশেজ ইতিহাসের তৃতীয় সর্বোচ্চ ১১ সেঞ্চুরি ডানহাতি এ ব্যাটসম্যানের। ৩ হাজারের বেশি রান নিয়ে অ্যাশেজের পঞ্চম সর্বোচ্চ রানও তাঁরই। অ্যাশেজে অস্ট্রেলিয়ার (৫৪.৫০) মাটির তুলনায় ইংল্যান্ডে গড়ও বেশি (৬৫.০৮)। বিপরীতে রুট কিছুটা পিছিয়ে। টেস্ট খেলুড়ে বাকি দলগুলোর বিপক্ষে গড় ৫৩.৮২ হলেও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩৮.৭৬। যদিও ঘরের মাটিতে খেলা অ্যাশেজে তিনটি সেঞ্চুরি আছে রুটের।
দীর্ঘদিন দলের ব্যাটিংয়ের মূল স্তম্ভ হয়ে থাকা রুট–স্মিথ প্রভাবক হয়ে উঠতে পারেন অ্যাশেজেও।
অস্ট্রেলিয়ার পেস বোলিং
‘স্টোকস আর ম্যাককালামের অতি ইতিবাচক গেমপ্ল্যান সব প্রতিপক্ষের বিপক্ষে কাজে দিয়েছে’ বলেও জেসন গিলেস্পি অস্ট্রেলিয়াকে এগিয়ে রাখছেন। কেন এগিয়ে রাখছেন, তার ব্যাখ্যায় সাবেক এই পেসার বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার মানসম্পন্ন বোলিং আক্রমণ আছে। কামিন্স, বোল্যান্ড, হ্যাজলউড, স্টার্ক আর লায়নদের বোলিংয়ে ইংল্যান্ডের খেলার ফাঁকফোঁকর বের হয়ে পড়বে।’ গিলেস্পির মতো ইংল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার স্টিফেন ফিনও অস্ট্রেলিয়ার বোলিংকে এগিয়ে রাখছেন। এই পেসারের মতে, ‘খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক একটা সিরিজ হবে। আশা করি, অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ বোলাররা ফিট থাকবে, তাদের এখানে জেতার ভালো সুযোগ আছে।’
প্রথম টেস্ট
লড়াইটা পাঁচ টেস্টের, সময়ের ব্যাপ্তি দেড় মাসের। দীর্ঘ এই সময়ে অনেক প্রেক্ষাপটই বদলে যেতে পারে, বদল আসতে পারে খেলোয়াড়দের মানসিকতায়। এ জন্য সিরিজের শুরুটা বড় প্রভাবক হয়ে উঠতে পারে বলে ধারণা কারও কারও। যেমন ইংল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার ও ধারাভাষ্যকার জোনাথন অ্যাগনিউ এজবাস্টন টেস্টকে বেশ প্রাধান্য দিয়েছেন, ‘সবকিছু নির্ভর করছে প্রথম টেস্টের ফলের ওপর। এই ম্যাচে যে জিতবে, তারা অ্যাশেজও জিতবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এজবাস্টনে কে জিতবে?’ অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি পেসার গ্লেন ম্যাকগ্রাও মনে করেন, প্রথম টেস্ট পুরো সিরিজে বড় প্রভাব ফেলবে, ‘প্রথম টেস্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ম্যাচের ফলের পথ ধরে বাকি ম্যাচগুলো প্রভাবিত হবে।’