তিন ম্যাচ হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ দুটিতে জিতেছে—বিশ্বকাপ শুরুর আগে এ কথা বললে মনে হয় সবাই খুশি হতেন। কথাটা সাকিব আল হাসানের। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচে নিজেকে ফিরে পাওয়ার পর।
সেই ফিরে পাওয়া অবশ্য শুধুই ব্যাটিংয়ে। বোলার সাকিব এখনো দেখা দেননি। যদিও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ব্যাটসম্যান সাকিবের চেয়ে বোলার সাকিবেরই বেশি কীর্তিধন্য। টুর্নামেন্টের ইতিহাসে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির টানা তিন ম্যাচ উইকেটশূন্য থাকাটা রীতিমতো এক বিস্ময়। বিস্ময় বলছি বটে, তবে ক্যারিয়ারে এর আগেও একবার এমন হয়েছে। সেবার সাকিব টানা চার ম্যাচে উইকেট পাননি।
এবারও তা হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে বাজি ধরতে যাবেন না যেন। অলরাউন্ডারদের একটা সুবিধা আছে। ব্যাটিংয়ে ভালো করলে সেই আত্মবিশ্বাস বোলিংয়েও সঞ্চারিত হয়। বোলিংয়ে ভালো করলে ব্যাটিংয়ে। ব্যাটসম্যান সাকিবের নিজেকে ফিরে পাওয়া ঈদের দিন সকালে নেপালের বিপক্ষে ম্যাচে বোলার সাকিবেরও ফিরে রাখার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছে বলেই ধরে নেওয়া যায়।
দক্ষিণ আফ্রিকা-নেপাল ম্যাচের উইকেটের কথা মনে রাখলে ধরে নেওয়া-টেওয়ারও কিছু থাকে না। নেদারল্যান্ডস-বাংলাদেশ ম্যাচের উইকেটের সঙ্গে পরের ম্যাচের এমন আকাশ-পাতাল তফাত! রীতিমতো স্পিন-স্বর্গ। মজার ব্যাপার হলো, সেই স্পিন-স্বর্গে নেপালের তারকা লেগ স্পিনার সন্দীপ লামিচানে একটাও উইকেট পাননি। যেখানে ১৯ রানে ৪ উইকেট নিয়ে নিয়েছেন এমন এক লেগ স্পিনার, ক্যারিয়ারে আগের ৪৪ ম্যাচের মাত্র ৮টিতেই যিনি হাত ঘুরিয়েছেন। কুশল ভুরতেলকে এমন বোলিং করতে দেখে নিশ্চয়ই রিশাদ হোসেনের হাত নিশপিশ করছে।
এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পাওয়া লেগ স্পিনার তুরুপের তাস হয়ে উঠতে পারেন এই ম্যাচেও। তা নেপালের ব্যাটসম্যানরা নেটে যতই লামিচানে-ভুরতেলদের খেলুন না কেন! প্রশ্ন হচ্ছে, উইকেটের অমন আচরণ দেখে বাংলাদেশ উইনিং কম্বিনেশন বদলাবে কি না। তিন পেসারই দারুণ বোলিং করছেন। এতটাই যে হাতের চোট সেরে যাওয়ার পরও শরীফুল একাদশে ফিরতে পারছেন না। আরেকজন স্পিনার মানে মেহেদী হাসানকে খেলাতে চাইলে পেসারদের কাউকে বাদ দিতে হবে। আরেকটি জিনিসও মাথায় রাখতে হচ্ছে। এই মাঠে আগের দুই ম্যাচ হয়েছে ভিন্ন চরিত্রের দুই উইকেটে, এই ম্যাচে আবার নতুন উইকেট। সেটি আবার কী রূপে দেখা দেয়, কে জানে!
দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে নেপালের ম্যাচটা বাংলাদেশের জন্য বড় আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। তা একাধিক কারণে। প্রথমত প্রায় অচেনা প্রতিপক্ষ নেপালকে ভালো করে দেখার সুযোগ মিলেছে। অধিনায়ক নাজমুল হোসেন বিশ্বকাপে আসার আগেই বলছিলেন, নেপাল সম্পর্কে তাঁর জানাশোনা বলতে এশিয়ান গেমসে একটা ম্যাচ। দলের বাকিদেরও একই অবস্থা। নেপালের হালনাগাদ অবস্থা দেখার পর আরেকটা ঝুঁকিও থাকছে না। ও, নেপাল, এ আর এমন কি—এমন অতি আত্মবিশ্বাস আসতে পারছে না বাংলাদেশ দলের ত্রিসীমানাতেও।
দক্ষিণ আফ্রিকাকে যেভাবে কাঁপিয়ে দিয়েছে নেপাল, তা আরেকটি ব্যাপারও বুঝিয়ে দিয়েছে। টি-টোয়েন্টির দুনিয়ায় বড় দল-ছোট দল ধারণাটা প্রথাগত চিন্তা থেকে আলাদা করার সময় এসেছে। এই বিশ্বকাপের তিন বাছাই দল পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কার সুপার এইটে দর্শক হয়ে যাওয়াটা যা আরও ভালো করে বুঝিয়ে দিচ্ছে। নেপালকে তাই হালকাভাবে নেওয়ার ভুল করার কোনো কারণই নেই। তার ওপর ম্যাচটার যখন এমন গুরুত্ব।
গত কয়েক দিন এত কথা হয়েছে যে এই ম্যাচের গুরুত্বের ব্যাপারটি আপনার অজানা থাকার কথা নয়। নেদারল্যান্ডসকে হারিয়েই সুপার এইটে এক পা দিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ। এই ম্যাচে জিতলে আরেকটি পা-ও সুপার এইটের আঙিনায় চলে যাবে। হেরে গেলেও যে সুযোগ থাকবে না, তা নয়। যদিও এই প্রসঙ্গটা বাংলাদেশ দলের কারও সামনে তোলা এখন ঠিক নিরাপদ নয়। দুই ম্যাচে জয়, অন্য ম্যাচটিতেও জিততে জিততে হার দলের আবহে এমনই একটা ইতিবাচক ঢেউ তুলেছে যে এই বিশ্বকাপে বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে দল। অধিনায়ক-কোচের কাজ বলতে একটাই—দূরের স্বপ্ন নিয়ে বেশি না ভেবে ক্রিকেটারদের মনোযোগটা যেন বর্তমানে থাকে। দৃষ্টি থাকে যেন শুধু পরের ম্যাচেই।
নেপালের অধিনায়ক রোহিত পৌডেল বাংলাদেশের ক্রিকেট খুব নিবিষ্টভাবে অনুসরণ করেন। দুই-তিনবার বাংলাদেশে খেলতে গেছেন। বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা যেমন নেপালের উঠে আসার সঙ্গে বাংলাদেশের শুরুর দিনগুলোর মিল খুঁজে পান, রোহিতেরও সেটি চোখে পড়ে। বাংলাদেশ আরেকটা কারণেও তাঁর কাছে একটু আলাদা। টেলিভিশনে ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নেপালকে খেলতে দেখেই তাঁর মনে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নের বীজ বোনা। সেই বিশ্বকাপটা হয়েছিল বাংলাদেশে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে তাওহিদ হৃদয়ের সঙ্গে খুব ভালো পরিচয় আছে, এমন জানাশোনা থাকা আরেকজন নাঈম শেখ কেন দলে নেই—এ নিয়েও তাঁর কৌতূহল। বাংলাদেশ দলে কাকে সবচেয়ে বিপজ্জনক মনে করেন—প্রশ্নটা শেষ হওয়ার আগেই বলে দিলেন, ‘সাকিব আর মাহমুদউল্লাহ।’ কেন? রোহিতের উত্তর, ‘অভিজ্ঞতা। দুজনই খুব অভিজ্ঞ। আর অভিজ্ঞতা আপনি দোকানে কিনতে পাবেন না।’
আগেই জানতেন, তবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচে নিশ্চয়ই কথাটার মর্মার্থ আরও করে বুঝেছেন রোহিত পৌডেল!