এক হাতে হেলমেট, অন্য হাতে ব্যাট। প্যাড জোড়া তখনো পায়ে। ঘামে জবজবে শরীর নিয়ে স্টেডিয়াম লাগোয়া নেট থেকে ড্রেসিংরুমের দিকে হেঁটে যাওয়ার পথে পরিচিত সাংবাদিকের ‘রিয়াদ ভাই’ ডাক শুনে থমকে দাঁড়ালেন মাহমুদউল্লাহ।
বাংলাদেশের নেটে সবচেয়ে লম্বা সময় ধরে ব্যাটিং করেছেন। এই গরমে এতক্ষণ ব্যাটিং করে ক্লান্তি আসারই কথা। মাহমুদউল্লাহকে দেখে তা বোঝার উপায় নেই। মুখে স্মিত হাসি। তাঁর ব্যাটিংয়ে যেমন অনায়াস একটা সাবলীলতা আছে, শরীরী ভাষাতেও যেন সেটির অনুবাদ। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, বিশ্বকাপের এই মহামঞ্চে আবার এসে দাঁড়াতে পেরেই তিনি কতটা খুশি!
মাহমুদউল্লাহর গল্পটা যেহেতু আপনার অজানা থাকার কথা নয়, বিশ্বকাপে আসতে পেরেই তাঁর খুশির কারণটাও বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন দেখছি না। জীবনের শেষ বিশ্বকাপটা পারফরম্যান্স দিয়ে রাঙিয়ে দিতে পারবেন কি না, এই প্রশ্নের উত্তর জানতে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। তবে মাহমুদউল্লাহ সবচেয়ে বড় জয়টা তো পেয়ে গেছেন বিশ্বকাপে এসেই। যা শুধু তাঁর নিজের জয় হয়েই থাকছে না। আটকে থাকছে না ক্রিকেটের সীমানাতেও। তাতে যে মাহমুদউল্লাহর লড়াইয়ের গল্পটা প্রাপ্য মর্যাদা হারায়। গল্পটা যেহেতু ক্রিকেটের, আগামী দিনের ক্রিকেটাররা মাহমুদউল্লাহর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা খুঁজবে, এটা তো খুবই স্বাভাবিক। একটু ভেবে দেখুন তো, অন্য যেকোনো ক্ষেত্রে প্রতিকূলতার সামনে দাঁড়ানো মানুষের জন্যও কি এটি অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস নয়!
ক্যারিয়ার ব্যাটিং গড় ৩৫.৩৫, বিশ্বকাপে সেটি ৫১.৩৩। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্যেও জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। যে টুর্নামেন্টে তাঁর ব্যাটিং গড় ৬৮.৫০। গত তিন বিশ্বকাপের দুটিতেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়েও মাহমুদউল্লাহর বড় অবদান।
কী সেই অনুপ্রেরণা? যখন একে একে সব দুয়ার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, নিভে যাচ্ছে আশার আলো, তখনো হাল ছেড়ো না। মন দিয়ে নিজের কাজটা শুধু করে যাও। ওটাই তো শুধু তোমার হাতে আছে। তাতে কাজ হবে কি হবে না, সময়ই বলে দেবে। তুমি নিজে শুধু আশা হারিয়ো না।
মাহমুদউল্লাহ তো সেটাই করেছেন। বাংলাদেশ দলে তাঁর জায়গা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেছে অনেক আগেই। একসময় তা আর প্রশ্নেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। দল থেকে বাদই পড়ে গেছেন। যে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের জন্য রোদে পোড়া কালকের দুপুরে মাহমুদউল্লাহর এমন নিজেকে নিংড়ে দেওয়া পরিশ্রম, গত মার্চে এই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের পরই মাহমুদউল্লাহর শেষ দেখে ফেলেছিলেন অনেকে। ‘বিশ্রাম’-এর আবরণে আসলে তো বাদই দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। সিরিজের পর সিরিজ দলে নেই। এদিকে এগিয়ে আসছে বিশ্বকাপ। তিন-চার মাস আগেও মাহমুদউল্লাহকে কজন এই বিশ্বকাপের দলে দেখেছিলেন, বলুন তো!
একটু আগে ‘হাল ছেড়ো না’ লেখার সময় অবধারিতভাবেই কবীর সুমনের গানের লাইনটা মনে পড়ে গেছে, ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে...।’ তখনই মনে হয়েছে, প্রথম অংশটা ঠিক আছে, কিন্তু পরের অংশটা মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে একেবারেই যায় না। এত অবহেলা, এত অবজ্ঞা সব নীরবে সয়ে গেছেন। জোরে কণ্ঠ ছাড়া দূরে থাক, প্রতিবাদে কখনো টুঁ শব্দটিও করেননি। ওটা তাঁর চরিত্রেই নেই। মাহমুদউল্লাহর জানা গল্পটাই আবারও লিখতে গিয়ে বরং আবুল হাসানের বিখ্যাত ওই কবিতাটা মনে পড়ে যাচ্ছে, ‘ঝিনুক নীরবে সহো/ ঝিনুক নীরবে সহো/ ঝিনুক নীরবে সহে যাও/ ভিতরে বিষের বালি,/ মুখ বুঁজে মুক্তা ফলাও।’
ঝিনুকের মতো নীরবে সয়ে গেছেন, এ নিয়ে তো কোনো সংশয়ই নেই। মুখ বুজে মুক্তা ফলানোর কাজটা হয়তো এখনো বাকি। শুধু বিশ্বকাপে খেলতে পারাটাকেই ‘মুক্তা ফলানো’ বললে মাহমুদউল্লাহ নিজেই নির্ঘাত আপত্তি করবেন। শেষটা রাঙিয়ে দিয়ে যেমন টেস্ট ছেড়েছেন, এখানেও নিশ্চয়ই এমন কোনো স্বপ্ন নিয়েই এসেছেন। সেই স্বপ্নের কথাও মুখ ফুটে কাউকে বলবেন না। ২০১৫ বিশ্বকাপের আগে কতজন বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বকাপে প্রথম সেঞ্চুরি করার স্বপ্নের কথা বলেছেন। মাহমুদউল্লাহ অ্যাডিলেডে তা করে ফেলার পর মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার মনেও এমন একটা স্বপ্ন ছিল। কিন্তু আমি কাউকে বলিনি।’
অ্যাডিলেডে ওই সেঞ্চুরিই গড়ে দিয়েছিল বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্যের ভিত। প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করার পরের ম্যাচেই আবারও সেঞ্চুরি। হ্যামিল্টনের ওই কনকনে ঠান্ডা আর সুইংয়ের বিষ মেশানো বোলিং—নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওই সেঞ্চুরিটা ম্যাচ জেতাতে পারেনি। তবে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা ইনিংস হিসেবে সেটির কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী আছে বলে মনে হয় না।
আইসিসি টুর্নামেন্টের সঙ্গে মাহমুদউল্লাহর আশ্চর্য একটা সখ্য আছে। ক্যারিয়ার ব্যাটিং গড় ৩৫.৩৫, বিশ্বকাপে সেটি ৫১.৩৩। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্যেও জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। যে টুর্নামেন্টে তাঁর ব্যাটিং গড় ৬৮.৫০। গত তিন বিশ্বকাপের দুটিতেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়েও মাহমুদউল্লাহর বড় অবদান। অ্যাডিলেডের কথা তো বলাই হলো। এর আগে ২০১১ বিশ্বকাপে চট্টগ্রামের জয়টা আরও রোমাঞ্চকর। দেশের মাটিতে সেই বিশ্বকাপ উদ্যাপন করতে চট্টগ্রামের টাইগারপাসে বিশাল একটা বাঘের মূর্তি বানানো হয়েছিল। ইংল্যান্ডের ২২৫ রান তাড়া করতে নেমে বাংলাদেশ যখন ৮ উইকেটে ১৬৯, কে বা কারা যেন সেই বাঘের পায়ের সঙ্গে একটা বিড়াল বেঁধে রেখে গিয়েছিল। বাংলাদেশ দল নামেই বাঘ, আসলে তো বিড়াল—নইলে কি আর এভাবে হারে!
বাংলাদেশ হারেনি। শফিউলের সঙ্গে অপরাজিত নবম উইকেটে মাহমুদউল্লাহর ৫৮ রানের জুটি এনে দিয়েছিল অভাবিত এক জয়। আজ আরেকটি বিশ্বকাপে সামনে আবার সেই ইংল্যান্ড। মুখ বুজে মুক্তা ফলানোর কথা বলছিলাম। মাহমুদউল্লাহ, আজই কি তা ফলানোর দিন?