ধরুন ৪০ বলে ৬০–৭০ রান প্রয়োজন বাংলাদেশের। সেখান থেকে বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ে দলকে জিতিয়ে দিল আফিফ হোসেন। অথবা ৬ বলে ১২ রানের শেষ ওভারে তাসকিন কিংবা হাসান মাহমুদ প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের পায়ে শৃঙ্খল পরিয়ে দিল, জিতে গেল বাংলাদেশ।
এ রকম কি হতে পারে না? আফিফ–লিটনদের ঝোড়ো ব্যাটিং, তাসকিন–হাসান মাহমুদদের ভালো বোলিং তো আমরা দেখিই। তো এই ভালো পারফরম্যান্সের আলোগুলো যদি এক দিনে জ্বলে ওঠে, দলের প্রয়োজনের মুহূর্তে ওরা এগিয়ে আসে, তাহলে বাংলাদেশের জিততে সমস্যা কোথায়? খেলাটা টি–টোয়েন্টি আর তাতে জেতার অধিকার সবার। শুধু সময়ের কাজটা সময়ে করতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, অস্ট্রেলিয়ার টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেই সুর আমরা দলের মধ্যে খুঁজে পাব।
টি–টোয়েন্টি ক্রিকেটটাই এমন। যদি দুইটা ভালো ওভার হয়, একজন ব্যাটসম্যান গুরুত্বপূর্ণ সময়ে একটা ভালো ইনিংস খেলে ফেলে, তখন যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে। কোন দল কার বিপক্ষে ঘটাল, সেটি এখানে কোনো বিষয়ই নয়।
সে জন্যই আমি বরাবরের মতো এবারও আশাবাদী, বাংলাদেশ ভালো খেলবে। জানি বেশির ভাগ মানুষ আমার সঙ্গে একমত হবেন না। কারণ, টি–টোয়েন্টি দল হিসেবে আমরা এখনো সেভাবে প্রতিষ্ঠিত নই। তবে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপে আমাদের দলের বাড়তি সুবিধা, তারা নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনে চার–পাঁচটা ম্যাচ খেলে গেছে। এশিয়া কাপ থেকে শুরু করে টি–টোয়েন্টি ক্রিকেটের মধ্যেই আছে দলের সবাই। দলের ভালো–মন্দ অনেক কিছুই এখন বোঝা যাচ্ছে। টিম ম্যানেজমেন্টের কাছেও নিশ্চয়ই তা পরিষ্কার। এখন শুধু ফাইন টিউনিংটা করতে হবে।
এটা ঠিক যে টি–টোয়েন্টির মধ্যে থাকলেও বিশ্বকাপের আগপর্যন্ত আমরা ভালো খেলতে পারছিলাম না। কিন্তু সেটা খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরাবে বলে মনে হয় না। বিষয়টা নির্ভর করছে তারা বিষয়টাকে কীভাবে নিচ্ছে, তার ওপর। খেলোয়াড়েরা যদি মনে করে ফলাফল যা–ই হোক, এই ম্যাচগুলোতে তাদের বিশ্বকাপের প্রস্তুতিটা অন্তত হয়ে গেছে, তাহলেই সবকিছু ইতিবাচকভাবে ধরা দেবে। কিছু সিনিয়র খেলোয়াড় না থাকায় অন্যদের সামনে বরং এই বিশ্বকাপ ভালো একটা সুযোগ হয়েই এসেছে। আমি চাই ওরা সুযোগটা দুহাত ভরে নিক।
তবে মাঠে নামার আগে সমস্যার জায়গাগুলো খুঁজে বের করে তার সমাধান করতে হবে। কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় যদি কেউ কেউ দায়িত্ব নিয়ে খেলতে পারে, সাকিব যেমন এর মধ্যেই রান পেতে শুরু করেছে। লিটনও রান করছে। আফিফ খুব ভালো ছন্দে আছে। ইয়াসির আলীও দারুণ সম্ভাবনাময়। কাজেই আমরা পারব না, আগে থেকে এই ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কাজটা কঠিন সন্দেহ নেই, তবে সেটা সব দলের জন্যই।
বিশ্বকাপের আগে দলের কিছু পরীক্ষা–নিরীক্ষা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। মেকশিফট ওপেনার খেলানো তার অন্যতম। এ ব্যাপারে টিম ম্যানেজমেন্টই ভালো বলতে পারবে। নিশ্চয়ই তাদের কোনো পরিকল্পনা আছে। তবে বুমরা, মিচেল স্টার্ক, কামিন্স, ভুবনেশ্বর, শাহিন শাহ আফ্রিদি, রাবাদার মতো বোলাররা বিশ্বকাপে খেলবে। সেখানে মেকশিফট ওপেনার দিয়ে থিঙ্কট্যাংক কী আশা করছে, আমি ঠিক নিশ্চিত নই।
অবশ্য ফল ভালো মনে না হলে নিশ্চয়ই তারাও পরিকল্পনা থেকে সরে আসবে। নতুন বলে খেলে অভ্যস্ত লিটনকেই হয়তো আবার দেখা যাবে ওপেনিংয়ে। তবে নতুন কিছু চেষ্টা করার স্বাধীনতা দলের থাকাই উচিত। সফলতা এলে সবাই ভালো বলবে, না এলে খারাপ বলবে; এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে টিম ম্যানেজমেন্ট তো বসে থাকবে না। বরং এই সবকিছুতে বোঝা যাচ্ছে, বিশ্বকাপ নিয়ে দল একটা পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। সবারই উচিত সমালোচনা না করে সেটার ফলাফল দেখার জন্য অপেক্ষা করা।
আমার অস্ট্রেলিয়ায় খেলার যতটুকু অভিজ্ঞতা বা তাদের সম্পর্কে যতটুকু জানি, ওখানে ওয়ানডে ও টি–টোয়েন্টির উইকেটে সুষম বাউন্সই থাকে; কিন্তু বল খুব বেশি এদিক–সেদিক করে না। ট্রু বাউন্সের স্পোর্টিং উইকেটই হয় অস্ট্রেলিয়ায়। এই উইকেটে অনেক দল দেখবেন ১৭০–১৮০–১৯০ করে রান করবে। আমরাও নিউজিল্যান্ডে শেষ ম্যাচে ১৭০–এর ওপরে করেছি। ক্রাইস্টচার্চের মাঠ কিন্তু ছোট নয়, বেশ বড়। এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখা গেলে অস্ট্রেলিয়ায়ও ভালো কিছু হওয়ারই সম্ভাবনা থাকবে।
বোলিংয়ের কথা যদি বলেন, আমি বলব, যেকোনো সময়ের তুলনায় এখনই বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণ ভালো। পেস বোলিংয়ে এখন বোলার বেছে নেওয়ার সুযোগ আছে অনেক। শুধু দেখতে হবে, মানসিকভাবে কারা ভালো অবস্থায় আছে। তারা যদি সামর্থ্য অনুযায়ী বোলিং করতে পারে, দল তাহলে ভালো কিছুই পাবে। তাসকিন–হাসান মাহমুদ ভালো বোলিং করছে। খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে গেলেও মোস্তাফিজও আশা করি ফর্মে ফিরবে। আশা করি, আমরা আমাদের পাঁচ পেসারকেই ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে খেলাতে পারব।
অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের প্রসঙ্গে আসি। দূর থেকে মনে হতে পারে সিনিয়ররা কেউ নেই বলে সাকিব হয়তো দলে একটু একা হয়ে গেল। একা বলতে প্রয়োজনের সময় তাঁর শলাপরামর্শের লোকজন হয়তো কমে গেল। আমার কাছে কিন্তু একদমই তা মনে হয় না।
সাকিবের চরিত্রই একটু অন্য রকম। মানসিকভাবে অনেক শক্ত, নিজের প্রতি প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী। খেলা থেকে শুরু করে সেটা তার সবকিছুতেই স্পষ্ট। সাকিবের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধা, দলটার প্রত্যেক খেলোয়াড় তাকে অনেক সম্মান করে। আমরা যারা বাইরে আছি, তারাও ক্রিকেটার সাকিবকে সম্মান করি, অধিনায়ক সাকিবের ওপর আস্থা রাখি। কাজেই সিনিয়ররা না থাকলেও সাকিব ঠিকই তার কাজটা করে যাবে। বাকিটা নির্ভর করছে মাঠে আমরা কতটুকু দল হয়ে উঠতে পারি, তার ওপর।
এ ক্ষেত্রে লিটন, সৌম্য, তাসকিন, মোস্তাফিজের মতো ক্রিকেটারদের বেশি করে দায়িত্ব নিতে হবে। ওরা কিন্তু এখন আর তরুণ ক্রিকেটার নয়। টি–টোয়েন্টিতে তাদের একেকজনের ৮–৯ বছরের ক্যারিয়ার হয়ে গেছে। লিটন তো নিয়মিতই পারফর্ম করছে। আফিফও ৫৫টি ম্যাচ খেলে ফেলেছে, যেখানে আমি ক্যারিয়ার শেষ করেছি ৫৪টি টি–টোয়েন্টি খেলে।
আফিফ–লিটনের মতো কিছু খেলোয়াড় কিন্তু নিয়মিত পারফর্ম করছেও। হয়তো সবকিছু এক দিনে হচ্ছে না। ফলটাও আমরা তাই ভালো দেখছি না এবং তাদের উজ্জ্বল পারফরম্যান্সও আড়ালে চলে যাচ্ছে। যদি একসঙ্গে সবকিছু হয়, যেদিন আফিফ–লিটন ভালো ব্যাটিং করবে, সেদিন যদি দুজন বোলারও দারুণ বোলিং করে, তাহলে সাফল্য আসবেই।
সিনিয়ররা নেই বলে ওরা পারবে না, আমি তা মানি না। আর শুধু বুদ্ধি–পরামর্শ দেওয়ার জন্য এখন আর কারও খেলার প্রয়োজন নেই। খেললে পারফর্ম করতে হবে, দলে অবদান রাখতে হবে—এটাই শেষ কথা। সে রকম খেলোয়াড় আমাদের বিশ্বকাপের দলে কম নেই।
আমার আশাটা সে কারণেই। ওদের শুধু বলব, সামনে আসা সুযোগটা দুহাত ভরে নাও। সব আলো জ্বালিয়ে দাও একসঙ্গে।