টি-টোয়েন্টিতে নিজেদের ‘ব্র্যান্ডে’র ব্যাটিংই করল বাংলাদেশ

মোসাদ্দেককে আউটের সফল আবেদন নওয়াজের। শেষ দিকে দ্রুত উইকেট পড়েছে বাংলাদেশেরছবি: এএফপি

টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং বোঝাতে ক্রাইস্টচার্চে আজ পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটা হতে পারে ‘মডেল’ উদাহরণ।

পাকিস্তান আগে ব্যাট করে তুলেছে ৫ উইকেটে ১৬৭। ওভারপ্রতি গড়ে ৮ রানের একটু বেশি লক্ষ্য। সে লক্ষ্য তাড়া করতে নামা বাংলাদেশের ইনিংসকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ১০ ওভারে উঠেছে ২ উইকেটে ৬৪। অর্থাৎ জয়ের জন্য শেষ ১০ ওভারের দরকার ১০৪।

ম্যাচটা যাঁরা দেখেছেন কিংবা ফলটা জানেন, প্রশ্নটা তাঁদের প্রতি নয়। যাঁরা দেখেননি তাঁদের কাছে যদি জানতে চাওয়া হয়, এখান থেকে বাংলাদেশ কি ম্যাচটা জিততে পেরেছে?

উত্তর দেওয়ার আগে কেউ কেউ বলতে পারেন, এ নতুন কী! টি-টোয়েন্টিতে এ তো চিরায়ত বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষের রান দেড় শ-র ওপাশে গেলে তাড়া করতে নেমে কাঁপাকাঁপি শুরু হয়। পাওয়ারপ্লেতে উইকেট পড়বে, আর সেই চাপ কাটাতে প্রথম ১০ ওভারে ব্যাটিং হবে ওয়ানডে ধাঁচে।

তারপর শেষ ১০ ওভারে মেরেকেটে যতটুকু এগোনো যায়, কিংবা অলআউট! সেই পথে লক্ষ্য হাতছাড়া হলেও সমস্যা নেই, ম্যাচ কিংবা সিরিজ শেষে ‘শিক্ষা সফর’-এর বয়ান তো তৈরি-ই থাকে! আর সমর্থকেরাও সেসব শুনে খানিকটা গালমন্দ কিংবা হতাশ হয়ে কয়েক দিন পর সব ভুলে যান। প্রস্তুতি নেন নতুন সিরিজের। তারপর আবারও যা তা–ই!

ব্যতিক্রম? টি-টোয়েন্টিতে অন্তত কালেভদ্রে।

ইয়াসির একাই যা একটু টি–টোয়েন্টিসুলভ ব্যাটিং করলেন
ছবি: এএফপি

সাকিব আল হাসানের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের অধিনায়কত্ব করা নুরুল হাসান কাল বলেছিলেন, নিউজিল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজটি দিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রস্তুতি নেবে দল। এই সিরিজে বাকি দুই দল পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডও প্রস্তুতি নেওয়ার পথেই হাঁটবে।

তা, সিরিজের প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের প্রস্তুতিটা হলো কেমন? এই প্রশ্নের উত্তরে ফিরে যাওয়া যায় আগের প্রসঙ্গে। এই সংস্করণে বাংলাদেশ যেমন ব্যাটিং করে, সেটাই দেখা গেল আরকি!

শেষ ১০ ওভারে জয়ের জন্য যখন ১০৪ রান দরকার, হাতে ছিল ৮ উইকেট। এখান থেকে শেষ ৫ ওভারে দরকার ছিল ৬৭, তখন হাতে উইকেটসংখ্যা মাত্র ৪! স্বীকৃত ব্যাটসম্যান হিসেবে শুধু ইয়াসির আলী উইকেটে।

ওভারপ্রতি গড়ে ১৩.৩০ রানের লক্ষ্যে ম্যাচটা এখান থেকে জেতার কথা নয় বাংলাদেশের। ঘটেছেও ঠিক তা–ই। পুরো ২০ ওভার খেলে ৮ উইকেটে ১৪৬ রানে থেমেছে বাংলাদেশ।

পাকিস্তানের কাছে ২১ রানের হারে ত্রিদেশীয় সিরিজে বাংলাদেশের শুরুটা হলো বাংলাদেশের মতোই।

টি-টোয়েন্টিতে মেহেদী হাসান মিরাজ-সাব্বির রহমান ওপেনিং জুটিতে কিছুদিন ধরেই ভরসা রাখা হচ্ছে। কিন্তু জোর করে মারার চেষ্টা করা ছাড়া আদৌও তাঁরা কোনো ভরসা দিতে পেরেছেন কি?

লিটনও বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি উইকেটে
ছবি: এএফপি

এই সংস্করণে এখন পর্যন্ত চার ম্যাচে ওপেন করে একটিতেও পাওয়ারপ্লে পার হতে পারেনি এই জুটি। রান তোলার গতি ওভারপ্রতি সাড়ে ছয়ের একটু বেশি। আজও যেমন ৪.২ ওভার পর্যন্ত টিকেছে তাঁদের জুটি। মোহাম্মদ ওয়াসিমকে জোর করে পুল করতে গিয়ে ডিপ স্কয়ার লেগে ক্যাচ দেন মিরাজ (১১ বলে ১০)।

পরের ওভারে সাব্বির রহমানও পুল করতে গিয়ে বলের ওপর থেকে আগেভাগে চোখ সরিয়ে নেওয়ায় পেসার হারিস রউফকে ফিরতি ক্যাচ দেন। বাংলাদেশের স্কোর দাঁড়ায় ২ উইকেটে ৩৭।

নিউজিল্যান্ডের বাউন্সি উইকেটে দুই ওপেনার দু-একটি ভালো শট খেলেছেন বটে, কিন্তু উঠে আসা বল, যেটা নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় চিরায়ত—সেসব ডেলিভারিতে ভুগেছেন। অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়ায় এই দুজনকে দিয়ে ওপেন করালে এবং অলৌকিক কিছু না ঘটলে বিপদে পড়ার সম্ভাবনাই বেশি।

রান তাড়া করতে নেমে বাংলাদেশের ইনিংসে যা হয়, কার্যকর কিংবা অকার্যকর যা–ই হোক না কেন, বেশির ভাগ সময় একটা জুটি দাঁড়িয়ে যায়। এ সংস্করণে বর্তমানে বাংলাদেশের সেরা দুই ব্যাটসম্যান লিটন দাস ও আফিফ হোসেন মিলে তৃতীয় উইকেটে ৪০ বলে ৫০ রানের জুটি গড়েন, যা দলকে ১২.৩ ওভার পর্যন্ত টেনে নেয়।

অযথাই সুইপের ‘রোগ’একসময় ছিল লিটনের। আজ সেটাই যেন ফিরিয়ে আনার মাশুল হিসেবে স্পিনার মোহাম্মদ নওয়াজকে সুইপ করতে গিয়ে ডিপ ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ারে ক্যাচ দেন লিটন। ১ ছক্কা ও ৪ চারে ২৬ বলে লিটনের ৩৫ রানের ইনিংসটিতে প্রতিশ্রুতি ছিল।

আফিফ স্বভাবসুলভ লড়াই করলেও উইকেটে থাকার দরকার ছিল। পারেননি
ছবি: এএফপি

কথায় আছে, একটি উইকেট আরেকটি এনে দেয়। বাংলাদেশ দল ব্যাটিংয়ে থাকলে কথাটা যেন আরও বেশি করে সত্য—নওয়াজের পরের বলেই মোসাদ্দেক এলবিডব্লু! গোল্ডেন ডাক! বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়।

পরের দুই ওভারে আফিফ ও নুরুলও আউট! ২৩ বলে ২৫ রান করা আফিফ পেসার শাহনওয়াজ দাহানিকে মিডউইকেটে তুলে মারতে গিয়ে ক্যাচ দেন। আর নুরুল শিকার হন স্লগ সুইপে লং অনে ক্যাচ তুলে। ততক্ষণে ১৫ ওভার শেষ। ইয়াসির ছাড়া উইকেটে স্বীকৃত আর কোনো ব্যাটসম্যান নেই। জয়ের লক্ষ্যও প্রায় হাতছাড়া—শেষ ৫ ওভারে দরকার ৬৭।

অথচ লিটন-আফিফ উইকেটে থাকতে বাংলাদেশ আর যা–ই হোক হারের পথে ছিল না। এই যে হুট করে দুই-এক ওভারের মধ্যে গতিপথ পরিবর্তন, এটাই যেমন টি-টোয়েন্টি, তেমনি তার নেতিবাচক উদাহরণে বাংলাদেশের সমকক্ষ আর কোনো দল আছে কি না, তা গবেষণার বিষয়!

তবে এর মধ্যেও ব্যতিক্রম আছে—২১ বলে ৪২ রানে অপরাজিত থাকা ইয়াসির আলী। ২ ছক্কা ও ৫ চারে সাজানো টি–টোয়েন্টিসুলভ ইনিংস।

গবেষণা হতে পারে ২৪ রানে ৩ উইকেট নেওয়া মোহাম্মদ ওয়াসিমের একটি ওয়াইড নিয়েও। ১৯তম ওভারে টানা দুই বলে তাসকিন ও নাসুমকে ফিরিয়ে হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা জাগিয়েছিলেন এই পেসার। কিন্তু পরের বলটা তিনি কীভাবে ওয়াইড দিলেন, সেটি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন ধারাভাষ্যকার ইয়ান স্মিথ। এটাও সম্ভব! আসলে বিস্ময় তো প্রকাশ করা উচিত বাংলাদেশের ব্যাটিং নিয়ে। টি-টোয়েন্টিতে নিজেদের চিরায়ত ব্যাটিংয়ের ধারা বজায় রাখতে এতটা ধারাবাহিক আর কোন দল!

১৬৭ রান তাড়া করতে নেমে ৮.৪ ওভার, অর্থাৎ ৫২ ‘ডট’—এটাও সম্ভব? হ্যাঁ, বাংলাদেশ বলেই সম্ভব। সব সম্ভব!