ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ শেষে একবার এক পেস বোলারকে আচ্ছা করে শাসাচ্ছিলেন তাঁর কোচ। রেগেমেগে জিজ্ঞাসা করছিলেন, ‘তোকে বারবার মাঠের বাইরে থেকে বললাম ইয়র্কার দিতে। ইয়র্কার দিলি না কেন?’ শুনে ওই বোলার তো অবাক, ‘আরে স্যার কী বলেন! এটা ইয়র্কার মারার উইকেট নাকি?’
পরবর্তী অনেক বছরই ঘটনাটা হাস্যরসের খোরাক হয়ে থেকেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। ওই সময়ের ক্রিকেটাররা হয়তো ওই ঘটনা মনে পড়লে হাসেন এখনো। দুনিয়ায় ব্যাটিং উইকেট আছে, টার্নিং উইকেট আছে, বাউন্সি উইকেট আছে; কিন্তু ইয়র্কারের উইকেট বলে যে কিছু নেই! ইয়র্কার মানে তো একেবারে ব্যাটসম্যানের পা আর ব্যাট রেখে দাঁড়ানো জায়গাটাতে আঘাত করা, যাতে উইকেটের কোনো ভূমিকাই থাকে না।
যেমন নেই ফুল টসের উইকেট বলে কিছু। কখনো ব্যাটসম্যানকে প্রলোভনের ফাঁদে ফেলতে, কখনোবা বলের ওপর বোলারের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েই হয়ে যায় ফুল টস। আর বুঝে খেলতে পারলে ফুল টস মানেই ব্যাটসম্যানের জন্য রসগোল্লা। সপাং করে ব্যাট চালিয়ে বল পাঠিয়ে দাও মাঠের বাইরে। তবে টাইমিংটা ঠিক রাখতে হবে, শটে থাকতে হবে জোর। নইলে ওই লোভনীয় ফুল টসই স্টাম্পের বেলস উড়িয়ে বা সহজ ক্যাচে রূপ বদলে একটা থিতু ইনিংসকেও ‘মৃত’ ঘোষণা করে দিতে পারে, যেটা আজ সিলেটে হলো বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল হোসেনের ক্ষেত্রে।
আগেই বলে নেওয়া ভালো যে ফুল টস বলে আউট হওয়াটা টাইমড আউটের মতো কিছু নয় যে এ নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক বসাতে হবে। যুগে যুগে অসংখ্য ব্যাটসম্যান এমন রসগোল্লা মুখে পুরতে না পারার আফসোস নিয়ে মাঠ ছেড়েছেন। নাজমুলের আউট সেই তালিকায় নবতম সংযোজন মাত্র। তারপরও যে এই আউট নিয়ে আজ খেলার মধ্যে তো বটেই, দিন শেষের সংবাদ সম্মেলনেও এত আলোচনা; সেটার কারণও কিন্তু নাজমুলই।
কাল সিরিজপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে নাজমুল রীতিমতো ঘোষণা দিলেন যে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশ এই টেস্ট সিরিজ খেলবে জেতার জন্য। বিশ্বকাপ থেকে বেদনার বিউগল বাজাতে বাজাতে দেশে ফেরা একটা দল যখন নিজেদের জন্য দুর্বলতম সংস্করণের ক্রিকেটে নিজেদের চেয়ে শ্রেয়তর কোনো দলের বিপক্ষে অমন তেজি ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামে, তখন সেটাকে দুভাবেই দেখা যায়—হয় পাগলামি, নয়তো মাস্তানি।
কথাটা নাজমুল বলেছেন বলেই তাঁর বক্তব্যকে দ্বিতীয় শব্দটি দিয়ে পরিচিত করা ভালো। সফল হোন বা না হোন, তাঁর ব্যাটিংয়েও যে আক্রমণের ঘোষণা দেওয়ার একটা ব্যাপার থাকে সব সময়। আজও নাজমুলের ব্যাটে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল সেই ভাষা। দুই চার আর তিন ছক্কায় ৩৭ বলে ৩৫ রানের ইনিংসে তিনি বিশেষভাবে বেছে নিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডের বাঁহাতি স্পিনার এজাজ প্যাটেলকে। তাঁর করা ১৫তম ওভারে এক ছক্কা এক চার, ১৯তম ওভারে দুই চার এবং ২১তম ওভারে আরেকটি ছক্কা। কিন্তু সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে চার–ছক্কার এই আতশবাজি বেশিক্ষণ ফুটতে পারল না। বাদ সাধলেন গ্লেন ফিলিপস নামের প্রায় চার বছর পর টেস্টে ফেরা মৌসুমি এক অফ স্পিনার।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট অভিষেকের পর সিলেটেই ফিলিপস খেলছেন দ্বিতীয় টেস্ট। এটুকু পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু মূলত মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান এবং প্রয়োজনে বোলিং করা এই ফিলিপস কিনা ফিরেই নিলেন ৪ উইকেট! কাল বাংলাদেশের শেষ উইকেটটিও যদি এই অফ স্পিনারের দখলেই যায় তবে তো কথাই নেই, না গেলেও ফিলিপস এরই মধ্যে টেস্টটাকে স্মরণীয় করে ফেলেছেন ওই ৪ উইকেটে, যার প্রথমটি আবার নাজমুলকে ফুল টসে ফিরিয়ে।
ম্যাচ শেষে এ নিয়ে করা এক প্রশ্নে ফিলিপস হাসতে হাসতে বললেন, ‘টেস্টে প্রথম উইকেট পাব, এই স্বপ্ন অনেক দিনের। কিন্তু যেভাবে সেটা পেলাম, ভাবিনি সেভাবে পাব। লেগ স্পিনাররা অনেক সময় ভালো জায়গায় বল ফেলতে ফেলতেও হঠাৎ একটা লোভনীয় ফুল টস দিয়ে দেয়। ব্যাটসম্যানের চোখ আনন্দে নেচে ওঠে এবং বল সোজা বাইরে পাঠিয়ে দেয়। ওরকম কিছু আমিও সব সময় চাইতাম, তবে সেটা অবশ্যই বোলার হিসেবে টেস্টে আমার প্রথম উইকেটের জন্য নয়।’
যাঁর আউট নিয়ে এত কথা, সেই নাজমুলের প্রতি অবশ্য ফিলিপসেরও সহানুভূতি আছে। এর আগে বাংলাদেশ দলের হয়ে সংবাদ সম্মেলন করে যাওয়া মাহমুদুল হাসানও বলেছেন, ‘সব দিন তো আর এভাবে আউট হবে না। আমি একটু অবাক হয়েছি (নাজমুলকে ওরকম আউট হতে দেখে)। এর আগে উনি অনেকগুলো ভালো শট খেলেছিলেন।’
মৌসুমি বোলার বলেই ফিলিপসকে একটু মেরে খেলতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। আর ফিলিপসও সেই সুযোগে দিনের সেরা বোলার। তবে টেস্টে নিজের প্রথম উইকেট নিয়ে একটা অতৃপ্তি বোধহয় থেকেই যাবে তাঁর। নিজেই তো বললেন, ‘পারলে দ্বিতীয় উইকেটটার সঙ্গে এটাকে বদলে ফেলি আমি (হাসি)।’
ওরকম বলে আউট হওয়ায় অতৃপ্তি অবশ্য নাজমুলেরই বেশি হওয়ার কথা। ফুল টস বলে কিনা আউট হলেন ‘ফুল শট’ (পড়ুন বোকা বনে যাওয়া শট) খেলে! যেভাবে শুরু করেছিলেন তাতে উইকেটে থাকলে বড় কিছু আসতেই পারত তাঁর ব্যাট থেকে। সিলেটের উইকেট ‘ফুল টসের উইকেট’ না হোক, ব্যাটিং উইকেট তো বটেই।