ওয়েস্ট ইন্ডিজের যে দিন গেছে, একেবারেই গেছে
আয়ারল্যান্ড তখন জয়ের সুবাস পাচ্ছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়দের শরীরী ভাষায়ও ভাটার টান। ক্যারিবিয়ান ধারাভাষ্যকার ও সাবেক পেসার ইয়ান বিশপ তখন কথাটা বললেন, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ককে দেখুন। রান করতে পারেনি। ব্যাট হাতে সামনে থেকে নেতৃত্বও দিতে পারেনি। এ যেন গরিবের (পুওর) গল্প।’
বিশপ এরপর যা বলেছেন, তার হুবহু ইংরেজিটা তুলে দিলে মূল কথাটা বুঝতে সুবিধা হবে, ‘পুওর রান ফর পুরান।’ রসিক ক্যামেরাম্যান ঠিক তখনই ক্যামেরাটা ধরেন পুরানের পিঠে। জুম করে দেখালেন, জার্সিতে তাঁর নামের ‘পুওর’ অংশটি!
ক্লাইভ লয়েড–ভিভ রিচার্ডসরা এখনো জীবিত। আছেন মাইকেল হোল্ডিং আর অ্যান্ডি রবার্টসরাও। ক্রিস গেইল, কাইরন পোলার্ড, মারলন স্যামুয়েলস, ডোয়াইন ব্রাভোদের প্রজন্মের অনেকেই এখনো মাঠে আছেন। হোবার্টে আজ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিদায়টা নিশ্চয়ই তাঁরাও দেখেছেন?
নামে প্রথম রাউন্ড হলেও এক অর্থে বাছাইপর্ব থেকে বিদায় নিয়েছে এই টুর্নামেন্টেই দুবারের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বেলেরিভ ওভালে তাই পুরানদের নিয়ে একটু রসিকতার লোভ সামলাতে পারেননি ক্যামেরাম্যান। যে ক্যামেরাম্যান বিশপের কথার সঙ্গে মিলিয়ে মুহূর্তটা তৈরি করেছেন, এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ যে সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ নয়, সেটি তাঁরও অজানা থাকার কথা নয়।
সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ—বোঝাতে দুটি উদাহরণ টানা যায়। আশির দশকে ক্লাইভ–ভিভদের সেই সর্বজয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর তারপর টি–টোয়েন্টিতে গেইল–ব্রাভোদের সেই ভয়ডরহীন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এই দুটি দলের সাবেক খেলোয়াড়দের মধ্যে যাঁরা আজকের ম্যাচটি দেখেছেন, তাঁরাও স্বীকার করবেন—একটা যুগের অবসান ঘটেছে। পুরানের জার্সি নিয়ে ক্যামেরাম্যানের মজার কাজটা তাই ভিভ–গেইলদের মোটেও ভালো লাগার কথা নয়। অহমে যে লাগে!
বাস্তবতা হলো, সেই অহম এখন অতীত—শেলফে ধূলো জমা বইয়ের মতো। যেখানে অধ্যায় মাত্র দুটি। প্রথমটি, আশির দশক থেকে টানা ১৫ বছর ২৯ টেস্ট সিরিজে অপরাজিত সর্বজয়ী ক্লাইভদের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। পরেরটি শুরু একটি তারিখ দিয়ে, ৭ অক্টোবর ২০১২।
কলম্বোয় টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে এদিন শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এই সংস্করণে ক্যারিবিয়ানদের প্রথম শিরোপা। টি–টোয়েন্টিতে ভীষণ কার্যকর লাসিথ মালিঙ্গাসহ শ্রীলঙ্কা দলের বাকি বোলারদের ওপর দিয়ে সেদিন ক্যারিবিয়ান ‘সাইক্লোন’ বইয়ে দেওয়া স্যামুয়েলস আসলে ৫৬ বলে ৭৮ রানের ইনিংসটি দিয়ে একটি যুগের পত্তন করেছিলেন—আশির দশকে টেস্ট আঙিনার সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো টি–টোয়েন্টিতেও ক্যারিবিয়ান যুগ।
লোকে বলে, যুগ শেষ হতে ১২ বছর লাগে। কিন্তু রসিকতা করে বলা যায়, ক্যারিবিয়ানদের হিসাবটাই আলাদা। টি–টোয়েন্টিতে তাঁদের দ্রুত রান তোলার মতো যুগের হিসেবেও দুই বছর বাকি থাকল। অর্থাৎ ১২ বছরের হিসেব ১০ বছরেই শেষ!
শেষ? বুঝিয়ে বলা প্রয়োজন।
৪ নভেম্বর, ২০২১। টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সুপার টুয়েলভের ম্যাচ। আবুধাবিতে সেই শ্রীলঙ্কার কাছেই হেরে বিদায় নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। গেইল, আন্দ্রে রাসেল, ব্রাভো, পোলার্ডরা ছিলেন বিশ্বকাপে। এবার তাঁদের কেউ নেই।
অর্থাৎ ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেই সর্বজয়ী টি–টোয়েন্টি প্রজন্ম গত বছরই অস্তমিত হয়েছে, এমন কথাও বলেন কেউ কেউ। কিন্তু অস্তমিত না বলে অস্তরাগে ছিল, সেটি বলা বেশি নিরাপদ। সে দলের শিমরন হেটমায়ার, রাসেল, হোল্ডার, পুরান, লুইসরা এখনো খেলছেন। এমনকি ৪৩ বছর বয়সী গেইলও অবসর নেননি। শুধু পোলার্ড গত এপ্রিলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়েন। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে হেটমায়ার–রাসেলদের এবার দেখা গেল না কেন? উত্তরে, ক্যারিবিয়ানদের জীবন–দর্শনের সঙ্গে তাঁদের ক্রিকেট খেলার দর্শনের মিলটা ধরিয়ে দেওয়া যায়।
পৃথিবীতে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা শুধু আজকের দিনটির জন্য বাঁচেন। কাল কী হবে, ভাবেন না। অর্থাৎ ভবিষ্যতের ভাবনা নেই। খাও–দাও, ফূর্তি করো, জীবনকে উপভোগ করো। টি–টোয়েন্টিও কি এমন নয়? অল্প সময়ের ম্যাচ কিন্তু ওয়ানডের মতো মেদহীন, পুরোটাই উপভোগ্য। বেশির ভাগ ক্যারিবিয়ানও ঠিক তেমনি। গেইল থেকে রাসেল, ব্রাভোদের কাছে, ফ্র্যাঞ্চাইজি টি–টোয়েন্টি লিগ বেশি উপভোগ্য, যেখানে মাঠের বাইরের সময়টা আসলে খানাপিনা আর ফূর্তিরই। মাঠের ভেতরেও কি কম!
উইকেট নেওয়ার কিংবা একটা ভালো ক্যাচ নেওয়ার উপভোগ–আনন্দে ক্যারিবিয়ানদের কি টেক্কা দেওয়া গেছে, নাকি যায়? ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে এই সুযোগগুলো বেশি থাকাতেই সম্ভবত জাতীয় দল তাঁদের সেভাবে টানেনি। আর তাই টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপগামী ফ্লাইট মিস করেন হেটমায়ার। জীবন তাঁদের শিথিল ও মজার, ঘড়ি কাঁটায় চেপে চাপ নেওয়ার নয়। আর তাই হেটমায়ারের মতো রাসেলও টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে জাতীয় দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন।
অথচ এই ক্রিকেটাররাই কিন্তু বর্তমান সময়ে ক্রিকেট খেলার সবচেয়ে জনপ্রিয় পথটা তৈরি করে দিয়েছেন। বিশ্বব্যাপী এই যে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের রমরমা তার অনেকটাই টি–টোয়েন্টিতে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটারদের আধিপত্যের জন্য। আবার দুর্ভাগ্যও আছে। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে তাঁদের আরও বেশি মনোযোগ দেওয়ার, সেটাও একটা কারণ হতে পারে।
২০১২ সালে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়কে যদি ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেই প্রজন্মের অভিযাত্রা হিসেবে ধরা হয়, তাহলে পরের চার–পাঁচ বছর সোনালি সময় কাটানোর কথা। ঘটেছেও তা–ই। আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টিতে তখন ক্যারিবিয়ান সামনে দাঁড়ানোর মতো দল ছিল কমই। দুই বছর পর ২০১৪ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল থেকে গেইল, সিমন্স, স্যামুয়েলস, ব্রাভোরা বিদায় নিয়েছিলেন বৃষ্টি আইনের মারপ্যাঁচে। শ্রীলঙ্কার ১৬০ রান তাড়া করতে নেমে ১৩.৫ ওভারে ১০৮ রানের লক্ষ্য পেয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। পারেনি। ২০ ওভারের খেলা হলে আর লক্ষ্যটা ১৬০–ই থাকলে কে জানে ফলটা অন্যরকমও হতে পারত! এর দুই বছর পর কলকাতায় টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজই চ্যাম্পিয়ন হলো। শেষ ওভারে কার্লোস ব্রাফেটের টানা চার ছক্কা...বিশপের সেই অমর বাণী, ‘কার্লোস ব্রাফেট, রিমেম্বার দ্য নেম!’
আহ, এই তো ওয়েস্ট ইন্ডিজ!
কিন্তু তারপর? পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে কোনো টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়নি। তাতে গেইল–পোলার্ড–ব্রাভোদের বয়স তো আর বসে থাকবে না! প্রকৃতির নিয়মে তাঁদের বয়স যেমন বেড়েছে, তেমনি মানুষের স্বভাব মেনেই ক্যারিয়ারের শেষ দিকে আরাম–আয়েশের সঙ্গে যতটা সম্ভব টাকা আয়ের পথে হেঁটেছেন গেইল–পোলার্ডরা। সেজন্য ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের ওপরে কিছু হয় না।
তবু গতবার চেষ্টা করেছিলেন গেইল–ব্রাভোরা। বয়স এবার তাঁদের আসতে দেয়নি। কিংবা সেই প্রজন্মের মধ্যে যাঁরা এখনো খেলার মধ্যে আছেন, তাঁদের জাতীয় দল টানেনি। একটা সুসজ্জিত দালান যেমন বছরে পর বছর ধরে একটু একটু করে ভেঙে পড়ে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ জাতীয় দলও তেমনি সেই প্রজন্ম হারিয়ে সম্ভবত ভগ্নদশার শেষ দফায়। যুগের সমাপ্তি ঘটে এভাবেই। কিন্তু এই সমাপ্তির পর চাইলে মার্কিন লেখক মারিয়ানা উইলিয়ামসনের কথায় বুক বাঁধতে পারেন।
‘এভরি এন্ডিং ইজ অ্যা নিউ বিগিনিং।’