বাংলাদেশের বিশ্বকাপ কেমন হলো—আপনার-আমার সেই আলোচনা করারই দরকার পড়ছে না। অধিনায়ক সাকিব আল হাসান নিজেই তো স্বীকার করে নিয়েছেন, এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বাজে বিশ্বকাপ। সেটিও তো সেই কবে।
সাকিবের ওই স্বীকারোক্তি নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে হারার পর। পরের তিন ম্যাচের একটিতে টাইমড আউটের কারণে তুমুল আলোচিত এক জয়েও মনে হয় না, এই বিশ্বকাপকে অন্য কোনোভাবে দেখার সুযোগ আছে।
হ্যাঁ, জয়ের সংখ্যা বিচারে এর চেয়ে বাজে বিশ্বকাপও আছে। ২০০৩ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ একটা ম্যাচও জেতেনি। কানাডার বিপক্ষে হেরে শুরু, শেষ কেনিয়ার বিপক্ষে হেরে। তবে পরাজয়ের সংখ্যার দিক থেকে এবার সেটিকেও ছাড়িয়ে। সেবার ১৪ দলের বিশ্বকাপে ৭ দল করে দুটি পুল। চাইলেও তাই কোনো দলের ৬টির বেশি ম্যাচ হারার সুযোগ ছিল না। সবার সঙ্গে সবার খেলার এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ হেরেছে ৭টি ম্যাচ।
এটাই এবারের বিশ্বকাপকে এমন তমসাময় মনে হওয়ার একমাত্র কারণ নয়। ২০০৩ বিশ্বকাপে তো বড় কোনো আশা নিয়ে যায়নি বাংলাদেশ, এবার যেখানে ছিল সেমিফাইনালের স্বপ্ন। তা আইসিসি সুপার লিগে তৃতীয় হয়ে বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করা দল তো সেরা চারে থাকার স্বপ্ন দেখতেই পারে। অথচ সেই বিশ্বকাপেই কিনা আটে থেকে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলার টিকিটকেই অনেক বড় পাওয়া বলে মানতে হচ্ছে! তা কোথায় পথ হারাল বাংলাদেশ?
বিশ্বকাপের মতো বড় আসর এলে বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্তঃসারশূন্যতা পরিষ্কার ফুটে ওঠে। বেরিয়ে আসে অপেশাদারত্ব আর অব্যবস্থাপনার কঙ্কাল। ব্যর্থতায় এসবেরই বড় অবদান। তবে আপাতত সেসব দূরে সরিয়ে রেখে শুধু এই বিশ্বকাপের ভুলগুলো নিয়েই না হয় কথা হোক—
শুরুটা বিশ্বকাপেরও আগে
সর্বনাশের বীজটা তো পোঁতা হয়ে গেছে শুরুরও আগে। বলতে গেলে তামিম ইকবালের আকস্মিক অবসরের ঘোষণার দিনেই। এই বিশ্বকাপকেই সামনে রেখে প্রায় আড়াই বছরের অধিনায়ক মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েছিলেন ওয়ানডে দলটাকে। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ জয় যেটির সবচেয়ে বড় প্রমাণ। এরপর যা যা হয়েছে, সেসব মনে হয় না কাউকে নতুন করে জানানোর প্রয়োজন আছে। এক দিনের মধ্যে তামিমের অবসরের সিদ্ধান্ত বদলে সমস্যাটার সাময়িক সমাধান হয়ে গেছে বলে মনে হয়েছিল। সাকিব অধিনায়ক হওয়ার পর যা যা হয়েছে, তা হয়তো একদিন অবশ্যই প্রকাশ পাবে, যা প্রকাশ পেয়েছে, সেটাই তো এই বিশ্বকাপে আসার আগে সম্ভাব্য সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতি বোঝাতে যথেষ্ট। নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে ফেসবুক লাইভে আসতে অন্তত বাংলাদেশ দল দেশ থেকে রওনা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার সৌজন্য দেখিয়েছেন তামিম। তাতে কারও প্রতি কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণও ছিল না। যেখানে একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাকিব আল হাসানের সাক্ষাৎকারটি ছিল তামিমের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-অপবাদে ভরা। ওই সাক্ষাৎকারে সাকিব যে ভাষায়, যে ভঙিতে কথা বলেছেন; বিশ্বকাপে খেলতে আসার আগে কোনো অধিনায়ক এমন বলতে পারে, এটা বিশ্বাস করাই কঠিন। তর্কযোগ্যভাবে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যান, লম্বা একটা সময় দলের অধিনায়ক, এমন কাউকে এমন ব্যক্তিগত আক্রমণ দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে প্রভাব না ফেলেই পারে না। সাকিব নিজেও যা পরে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। অমন কুৎসিত একটা বিতর্কের পর বাংলাদেশ এই বিশ্বকাপে ভালো করলে সেটাই হতো অষ্টম আশ্চর্য। ওপেনার তামিমকে মিস করার কথা না হয় বাদই থাকল।
ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে ‘পাগলামি’
যদি বলা হয়, এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ভরাডুবির মূলে একটা সেঞ্চুরি, একটু হয়তো অবাকই হবেন। এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সেঞ্চুরিটা সেই ম্যাচটা জিতিয়েছে বটে, তবে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব চিন্তা করলে বাংলাদেশের ক্রিকেটে এর চেয়ে ‘ক্ষতিকর’ সেঞ্চুরি আর নেই। মেহেদী হাসান মিরাজকে নিয়ে এই বিশ্বকাপে অমন আদেখলাপনার মূলে তো ওই সেঞ্চুরিই। মিরাজকে ওপরে তুলে তছনছ করে দেওয়া হলো গত এক-দেড় বছরে মোটামুটি স্থিতাবস্থা নেওয়া ব্যাটিং অর্ডারকে। তিন নম্বরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলা নাজমুল হাসান বিশ্বকাপের আগে লম্বা একটা সময় দলের সবচেয়ে ধারাবাহিক ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার চিন্তাটা কীভাবে হাথুরু-সাকিবের মাথায় আসে, তা একটা রহস্য বটে। সাকিব-হাথুরুর কথাবার্তায় পরিষ্কার, এতে বড় একটা ভূমিকা ছিল ডানহাতি-বাঁহাতি কম্বিনেশন নিয়ে চিন্তা। যেটির এমন নিবিড় চর্চা বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো দল করে বলে জানা নেই।
শুধু কি আর নাজমুল, মিরাজকে ওপরে তুলে দেওয়ায় দলের অন্য সব ব্যাটসম্যানের জায়গাও নড়ে যায়। প্রতিপক্ষ বোলিং বা ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনায় একটি-দুটি ম্যাচে এমন করা যেতেই পারে, তবে এই ‘অনিয়ম’-ই যদি নিয়ম হয়ে যায়, তাহলে ব্যাটসম্যানদের নির্দিষ্ট ব্যাটিং অর্ডার থাকত না। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শেষ ম্যাচের পর সেই ম্যাচের অধিনায়ক নাজমুল হাসান অবশেষে প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়েছেন, এটা ভুল হয়েছে। নইলে কেন বলবেন, ভবিষ্যতে এমন কম করা ভালো, না করলে আরও ভালো।’
বিবর্ণ পেসারকুল
তামিমের অধিনায়কত্বের সময়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় এবং ইতিবাচক পরিবর্তন বলতে হবে, চিরদিনের স্পিন-নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে পেসারদের সত্যিকার একটা শক্তি হয়ে ওঠা। যেটির নেতৃত্বে ছিলেন তাসকিন। মাঝের ওভারগুলোতে ভরসা হয়ে ওঠা এবাদত চোটে ছিটকে পড়াটা বিশ্বকাপে আসার আগেই বড় একটা ধাক্কা। তাসকিনও সম্ভবত কোনো ম্যাচেই শতভাগ ফিট ছিলেন না। বাকি পেসাররাও একই রকম নিষ্প্রভ। একটা ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েও তানজিম আহমেদই যা একটু পেসারসুলভ ঝাঁজ ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন।
এবং মিরপুর
পেসারদের এমন নিষ্প্রভ থাকায় উইকেটেরও কি বড় ভূমিকা! মিরপুরকেন্দ্রিক বাংলাদেশের ক্রিকেট বিশ্বকাপের ব্যাটিং-স্বর্গ উইকেটে এসে হাবুডুবু খাবে, এটাই তো স্বাভাবিক। আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ বাদ দিলে বাংলাদেশ এমন সব উইকেটে খেলেছে, যেখানে ভুলের সীমারেখা খুবই কম। বল একটু এদিক-ওদিক হলেই চার বা ছয়। এমন উইকেটে বোলিং করতে অভ্যাস লাগে। স্পিনারদের ক্ষেত্রেও তো একই সমস্যা। নেদারল্যান্ডসের ম্যাচটা যদি মনে করে দেখেন, ডাচ স্পিনাররাও বাংলাদেশের স্পিনারদের চেয়ে বল অনেক বেশি টার্ন করিয়েছে। মিরপুরে তো বল ছেড়ে দিলেই চলে, বাকি কাজটা উইকেটই করে দেয়। সমস্যাটা শুধু বোলারদের নয়, এমন রানপ্রসবা উইকেটে ব্যাটিংয়েরও ভিন্ন একটা আর্ট আছে। ওয়ানডে ক্রিকেট অনেক দিনই যেখানে চলে গেছে ৩৫০-৬০ রানের যুগে, বাংলাদেশ এখনো পড়ে আছে ২৫০-২৬০ রানের চক্করে। বিশ্বকাপ-বিপর্যয়ের জন্য মিরপুরও তাই দায়ী।
মিরপুরের তো আর নিজের কিছু করার নেই। দায়টা আসলে বিসিবির।