সাইম আইয়ুবের বয়স তো সবে ২২, একটু সময় দিতেই হবে

পাকিস্তানের তরুণ প্রতিভা সাইম আইয়ুবপ্রথম আলো

‘সত্যি বলতে, দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে সে ফিফটি করে যেভাবে আউট হয়েছে, আমি দায়িত্বে থাকলে আগামী দুই বছর সাইমকে দলের আশপাশে ঘেঁষতে দিতাম না।’
৩ সেপ্টেম্বর শেষ হওয়া রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে পাকিস্তানের প্রথম ইনিংসে ৫৮ রান করে মেহেদী হাসান মিরাজের বলে স্টাম্পিংয়ের শিকার হন সাইম আইয়ুব। ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে এসে তুলে খেলার চেষ্টা করতে গিয়ে উইকেট দিয়েছিলেন। এরপর পাকিস্তানের একটি টিভি শোতে কথাগুলো বলেছিলেন দেশটির সাবেক ক্রিকেটার কামরান আকমল।  

আগস্ট–সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরে ফেরা যাক। অ্যাডিলেডে কাল দ্বিতীয় ওয়ানডেতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পাকিস্তানের ৯ উইকেটের জয়ে ৭১ বলে ৮২ রানের ইনিংস খেলেন সাইম। তাঁকে নিয়ে ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক মাইকেল ভনের টুইট, ‘সাইম আইয়ুবকে দেখে সিরিয়াস প্রতিভাবান খেলোয়াড় মনে হচ্ছে, যে ভবিষ্যতে তিন সংস্করণেই অনেক বছর সফলতা পাবে।’  

ক্রিকেট খেলাটা আসলে এমনই। খারাপ খেললে শুনতে হবে আকমলের মতো মন্তব৵, ভালো করলে ভনের মতো। তাই বলে প্রতিভাকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। প্রতিভার প্রতিফলন ঘটুক বা না ঘটুক, প্রতিভা তো প্রতিভাই! পাকিস্তানের ইনিংসে ১৩তম ওভারে মিচেল স্টার্কের করা দ্বিতীয় ও তৃতীয় ডেলিভারি দুটি স্মরণ করতে পারেন। প্রথমটি চোখজুড়ানো কর্তৃত্ববাদী অফ ড্রাইভ।

আরও পড়ুন

পরেরটিতে পায়ের ওপর পিক আপ শটে স্টার্ককে পাঠিয়েছেন গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডে। ২২ বছর বয়সী এ ওপেনারের গত বছর মার্চেই আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়েছে। এরই মধ্যে ৬টি টেস্ট, ২৩টি টি–টোয়েন্টি, ২টি ওয়ানডে খেললেও এত দিন দলে আসা–যাওয়ার মধ্যে ছিলেন। গতকালের ইনিংসটি দিয়ে সাইম দলে নিজের জায়গা কতটুকু পাকা করতে পারলেন, সেটি সময়ই বলে দেবে। কারণ, দলটির নাম তো পাকিস্তান। কিছু না ঘটলেও অনেক কিছু ঘটতে পারে সেখানে!

সাইমের জন্য সমালোচনা অবশ্য নতুন নয়। পাকিস্তানের সাবেকদের সমালোচনা শুনে আসছেন আরও কম বয়স থেকে। পাশাপাশি আক্রমণাত্মক ও স্টাইলিশ হওয়ায় নজরও তাঁর ওপর পড়ে বেশি। তাই পারফরম্যান্স নিয়ে কাটাছেঁড়া চলতেই থাকে। যেমন ধরুন তাঁর ‘নো লুক শট’—এ শট বারবার খেলে আউট হওয়ায় কম কটাক্ষ সহ্য করতে হয়নি তাঁকে। পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল) ও ক্যারিবিয়ান সুপার লিগে (সিপিএল) শটটি খেলে প্রথম আলোচনায় আসা সাইম লোভ সংবরণ করতে না পেরে অনেকবার আউটও হয়েছেন।

সাইমের জন্য সমালোচনা অবশ্য নতুন নয়। পাকিস্তানের সাবেকদের সমালোচনা শুনে আসছেন আরও কম বয়স থেকে।

সমাধান বের করতে সাইম শরণাপন্ন হয়েছিলেন তাঁর শৈশবের কোচ মোহাম্মদ মাসরুরের। তিনি এখন পাকিস্তানের ফিল্ডিং কোচ। সাইমকে ঋষভ পন্তের উদাহরণ দিয়েছিলেন মাসরুর। ২০১৯ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে পন্ত আড়াআড়ি শট খেলে আউট হওয়ার পর অনেক সমালোচনা শুনতে হয়েছিল। কিন্তু এই পাঁচ বছরে পন্ত নিজের খেলার ধরন না পাল্টেও সফল।

দারুণ ছন্দে আছেন সাইম আইয়ূব
ইনস্টাগ্রাম

চলতি অস্ট্রেলিয়া–পাকিস্তান ওয়ানডে সিরিজ শুরুর আগে এ নিয়ে ভারতের সংবাদমাধ্যম ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’কে মাসরুর বলেছিলেন, ‘তার জন্য ঋষভ পন্তের উদাহরণ ছিল। এমন সব শট খেলে আউট হচ্ছিল এবং ভারতের পণ্ডিতেরাও ছুড়ে ফেলেছিলেন তাকে। টেম্পারমেন্ট এবং অপরিণামদর্শিতার সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন আক্রমণাত্মক ক্রিকেটই ঋষভ পন্তের শক্তির জায়গা।’

সাইম এসব সমালোচনার মধ্যেই কিন্তু পাকিস্তান টিম ম্যানেজমেন্টের সমর্থন পেয়েছেন। নইলে অস্ট্রেলিয়া সফরে দলে সুযোগ পেতেন না। আর সুযোগ পেয়েই সম্ভবত বিশ্বের সেরা বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে ইনিংসটি যেভাবে খেললেন, তা মনে থাকবে অনেকেরই। ৬ ছক্কা ও ৫ চারের মার ছিল। প্যাট কামিন্সকে পুল করে ছক্কা মেরেছেন, স্টার্ককে পিক আপ শটে এবং অ্যাডাম জাম্পাকে কবজির জোরে। মাসরুর বলেছেন, ‘মাইকেল ভন ও অ্যাডাম গিলক্রিস্ট তাকে সফল দেখতে চায়। এই ছেলেটি বিশেষ। আমাদের তার ওপর আস্থা রাখতে হবে এবং পরিণত হতে সময় দিতে হবে।’

আরও পড়ুন

সাইমের টেস্ট অভিষেক এ বছর জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। এবার অস্ট্রেলিয়ায় তাঁর তৃতীয় সফর। প্রথমবার গিয়েছিলেন ২০১৮ সালে পাকিস্তান অনূর্ধ্ব–১৬ দলের অধিনায়ক হিসেবে। মাসরুর সেই সময় স্মরণ করে বলেছেন, ‘মেলবোর্নে আমরা ২৬০‍+ রান তাড়া করছিলাম। মনে আছে সাইম ১৫০ করেছিল। ওইটা একটা ইনিংস ছিল।’

করাচিতে স্কুল টুর্নামেন্টে সাইমকে চোখে পড়ে মাসরুরের। সেই টুর্নামেন্টের প্রধান অতিথি ছিলেন তিনি। সাইমের বাবা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন, ছেলেকে ক্রিকেটার বানাতে চাননি। কিন্তু বাবাকে অনেক চেষ্টায় রাজি করিয়ে সাইমকে রশিদ লতিফ ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করান মাসরুর, ‘সে পেশাদার (ফ্যামিলি অব প্রফেশনালস) পরিবার থেকে এসেছে, যেখানে পড়াশোনার গুরুত্ব বেশি এবং তার বাবা চেয়েছিলেন, ছেলে একাডেমিক পর্যায়ে সফল হোক। তার বাবাকে রাজি করাতে আমাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।’

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৬ ছক্কা মেরে আলোচনায় সাইম আইয়ুব
ইনস্টাগ্রাম

সাইমের যে বিষয়টি মাসরুরের সবচেয়ে ভালো লাগে, খুব অল্প বয়স থেকেই পেস ও বাউন্স সামলাতে পারেন, ‘সে কাট ও পুল খুব ভালো খেলে। সব ধরনের আধুনিক স্ট্রোকই তার ঝুলিতে আছে। একবার সেট হয়ে গেলে বড় স্কোর করে। তার অধিনায়কত্বে করাচি দুবার অনূর্ধ্ব–১৬ জিতেছে, এই দুই মৌসুমেই চারটি সেঞ্চুরি করেছে।’

অথচ পাকিস্তানের বেশির ভাগ তরুণের মতো সাইম শুরুতে পেসার হতে চেয়েছিলেন। এমনকি অনূর্ধ্ব–১৯ পর্যন্ত উঠে আসার আগে দলের হয়ে ব্যাটে ও বলে ওপেন করতেন সাইম। মাসরুরের ভাষায়, ‘সে ছিল সুইং বোলার। এটাও বলতে হবে, বেশ ভালোও ছিল। মিডিয়াম পেসে হয়তো পাঁচ ওভার করত, এরপর অফ স্পিন।’

আরও পড়ুন

অ্যাডিলেডে গতকালের ওয়ানডে স্মরণ করতে পারেন। তিন ওভার স্পিন বোলিং করেছেন সাইম। অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যান অ্যারন হার্ডিকে ক্যারম বলে ঝামেলায়ও ফেলেছেন। ধারাভাষ্যকক্ষ থেকে গিলক্রিস্ট তখন তাঁকে শচীন টেন্ডুলকারের সঙ্গেও তুলনা করেছেন, ‘সে এমন কেউ, যে ডানহাতির বিপক্ষে লেগ স্পিন ও বাঁহাতির বিপক্ষে অফ স্পিন করতে পারে। সর্বশেষ শচীন টেন্ডুলকারকে আমি এমন কিছু করতে দেখেছি।’

ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলার সময় নিজের বোলিংয়ে ক্যারম বল যোগ করেন সাইম। তবে মাসরুর মনে করেন তাঁর আরও উন্নতির প্রয়োজন, ‘এখন আরও দক্ষতা যোগ করতে হবে। ক্যারম বল ছাড়াও সে আরও কিছু বৈচিত্র নিয়ে কাজ করছে। বোলিংয়ে সে কার্যকর হলেও এখনো উন্নতির অনেক জায়গা আছে।’

সে তো বটেই। ছেলেটির বয়স যে মাত্র বাইশ। সামনে তো গোটা ভবিষ্যৎটাই পড়ে আছে!