২০২১ সালে এক পঞ্জিকাবর্ষে এক হাজার রান করে হইচই ফেলে দেন। এবারও মৌসুম শুরু করেছেন জাতীয় ক্রিকেট লিগে সর্বোচ্চ ৪৪২ রান করে। দুই বছর ধরে তাই রানের ভেলায় ভাসছেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান জাকির হাসান। তবু জাতীয় দলের স্বপ্নের দরজাটা খুলছিল না। এমনকি ভারত ‘এ’ দলের বিপক্ষে বাংলাদেশ ‘এ’ দলের সিরিজেও শুরুতে তিনি ছিলেন ব্রাত্য। তৌহিদ হৃদয় চোটে পড়ায় প্রথম চার দিনের ম্যাচের আগের দিন ডাক পড়ে ২৪ বছর বয়সী জাকিরের।
সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ভারতীয়দের বিপক্ষে জাকির খেলেছেন ম্যাচ বাঁচানো ১৭৩ রানের অবিশ্বাস্য ইনিংস। তখন নিশ্চয়ই জাকিরও ভাবেননি ভারত ‘এ’ দলের বিপক্ষে শুধু নয়, অল্প কয়েক দিনের মধ্যে তাঁর ডাক পড়বে ভারতের বিপক্ষে প্রথম টেস্টের দলে। তামিম ইকবাল চোট থেকে সেরে না ওঠাতেই কপাল খোলে জাকিরের। কক্সবাজারে ‘এ’ দলের হয়ে জাকিরের ম্যারাথন ইনিংসটি মাঠে বসে দেখেছিলেন নির্বাচক আবদুর রাজ্জাক। টেস্ট ক্রিকেটের জন্য যে জাকির প্রস্তুত, সে উপলব্ধি তাঁর হয় তখনই। কাল প্রথম আলোকে রাজ্জাক বলছিলেন, ‘জাকিরকে দেখে মনে হয়েছে সে বেশ ভালো অবস্থায় আছে। আমাদের মনে হয়েছে এখনই তাঁকে সুযোগ দেওয়ার সঠিক সময়।’
২০১৬ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে খেলা জাকিরকে ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখেছেন রাজ্জাক নিজেও। ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিংয়ে দ্রুত রান তোলার জন্যই বেশি পরিচিতি ছিল তাঁর। ‘টি-টোয়েন্টি হিটার,’ ‘৩৬০ ডিগ্রি ব্যাটসম্যান’—জাকিরের নামের পাশে এসবও তাই বসে যায়। মেরে খেলার সামর্থ্যের কারণে ২০১৮ সালে জাতীয় দলের হয়ে টি-টোয়েন্টি অভিষেকও হয়ে যায় তাঁর। কিন্তু বাদ পড়ে যান শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এক ম্যাচে খারাপ করে।
এর পর থেকে জাকিরের চেষ্টা নিজেকে টি-টোয়েন্টি ব্যাটসম্যান হিসেবে গড়ে তোলার। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উল্টো দৃশ্যপট থেকে প্রায় হারিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই জাকির পথ খুঁজে পান জাতীয় দলের সাবেক সহকারী কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের শরণাপন্ন হয়ে। তাঁর সঙ্গে কাজ করে ব্যাটিংয়ে কিছু কৌশলগত পরিবর্তন এনেছেন, নিজেকে পরিণত করেছেন ‘রান-মেশিনে’।
সদ্য টেস্ট দলে সুযোগ পাওয়া ছাত্রকে নিয়ে বেশ আশাবাদী সালাউদ্দিন, ‘কৌশলগত অনেক উন্নতি করেছে ও, বিশেষ করে ডিফেন্সে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কঠিন জগতে ডিফেন্সটা ঠিক থাকতে হয়। সে এখন জানে বড় রান করার প্রক্রিয়াটা কেমন। গত এক বছরে মনে হয় ১০-১২টা সেঞ্চুরি আছে জাকিরের। ডাবল সেঞ্চুরিও আছে দুটি। ঠিক সময়ই তাকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে।’
জাকিরের পরিবর্তন অবাক করেছে রাজ্জাককেও, ‘একজন ব্যাটসম্যানকে খেলা বদলে ফেলার কথা বলাটা সহজ। কিন্তু সেটা করে দেখানো কঠিন। জাকিরের নিজেকে এভাবে বদলে ফেলা বিরাট ব্যাপার। আগে ৪০-৪৫ রান করে আউট হয়ে যেত। এখন সেঞ্চুরি হচ্ছে, বড় সেঞ্চুরি। রানের ক্ষুধাটা ওর অনেক বেশি।’
জাকিরের মধ্যে নেতৃত্বগুণও আবিষ্কার করেছেন কেউ কেউ। জাতীয় ক্রিকেট লিগে গত মৌসুম থেকে সিলেট বিভাগকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। গতবার তাঁর অধিনায়কত্বেই সিলেট দ্বিতীয় স্তরের চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এবারও জাতীয় লিগে রানার্সআপ হয়েছে জাকিরের সিলেট। অমিত হাসানের সঙ্গে জাকির নিজেও ব্যাটিংয়ে নির্ভরতা দিয়েছেন দলকে। সেটা মনে করেই রাজ্জাক বলছিলেন, ‘কেউ দায়িত্ব নিয়ে রান করলে আমাদেরও সুবিধা। এ ধরনের ক্রিকেটারদের দলে নিতে কোনো দোটানা থাকে না। একটা দলকে টেনে তোলা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়।’
জাকিরের টেস্ট দলে ডাক পাওয়া বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের জন্যও একটা সুখবর। ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো খেললে জাতীয় দলে ডাক পাওয়া যায়, এই বিশ্বাস যে হারিয়েই যাচ্ছিল ক্রিকেটারদের মধ্য থেকে!