নাজমুলের ‘উড়ন্ত চুমু’র প্রাপক কে
নাজমুল হোসেন তখন ৯৯ রানে ব্যাট করছিলেন। জর্জ ডকরেলের খাটো লেংথের বলটা অফ স্টাম্পের বাইরে থেকে টেনে মিডউইকেটে খেলেই দৌড়ালেন। প্রান্ত বদলের সঙ্গে সঙ্গে সেঞ্চুরি হয়ে গেলেও উদ্যাপন করেননি। আরেকটি রান চুরির সুযোগ ছিল।
লক্ষ্য যেহেতু ৩২০, দলের জন্য ১টি রান কত গুরুত্বপূর্ণ, তা ক্রিকেটারমাত্রই জানেন। নাজমুল তাই উদ্যাপন করলেন দ্বিতীয় রানটি নেওয়ার পর। দৃশ্যটা এমন অসাধারণ কিছু নয়। কিন্তু একটু গভীরে তাকালে জিদের মোড়কবন্দী অসাধারণ একটি বিষয় টের পাওয়া যায়।
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে কাল নাজমুলের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরিটি ছিল দলের জন্য খেলা ইনিংস। হ্যাঁ, সবাই দলের জন্য খেলতেই নামেন। তবু ‘দলের জন্য খেলা ইনিংস’ নাজমুলের ক্ষেত্রে আলাদা করে বলার কারণ আছে। গত চার-পাঁচ বছরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের মধ্যে নাজমুলই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি তির্যক রসিকতা কিংবা কটু কথার স্বীকার হয়েছেন। সে জন্য আমজনতাকে দোষ দেওয়া যায় না। ধারাবাহিকভাবে অধারাবাহিক হয়ে উঠলে কে মুখ বন্ধ রাখবে!
নাজমুল দলের জন্য খেলবেন কি, নিজের ক্যারিয়ার বাঁচানোর রানও তো করতে পারছেন না—ব্যাটিংয়ে দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পজিশনে নামা ব্যাটসম্যানটিকে নিয়ে এমন কথা কম হয়নি। সেই ব্যাটসম্যানটি-ই যখন সেঞ্চুরির নিশ্বাস দূরত্বে গিয়েও দলের কথা ভাবেন, তখন কি অসাধারণ কিছু মনে হয় না!
সেটা অবশ্য মনে হওয়ার ব্যাপার। চোখের সামনে তো আর দেখা যায়নি। কয়েক সেকেন্ড পর যা দেখা গেল, সেটাও অসাধারণ। দ্বিতীয় রানটি নিয়ে ক্রিজ পার হতে না হতেই শূন্যে দুবার লাফ দিলেন নাজমুল। দুবারই বাতাসে কাকে যেন ঘুষি মারলেন! এরপর ব্যাটটাকে পরিবাহী বানিয়ে উড়ন্ত চুমু। সংবাদ সম্মেলনে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, এই চুমু কার প্রতি? উত্তরে নাজমুল যেন সামনে পা নিয়ে ‘ডেড’ ডিফেন্স খেললেন হাসতে হাসতে, ‘এটা বলা যাবে না।’
ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে টানাহেঁচড়া না করাই ভালো। কিন্তু নাজমুল মাঠে যেহেতু দর্শকের সামনে এই অনুভূতি প্রকাশ করেছেন, তাই লোকের মুখও বন্ধ করা যাবে না। মাঠ তো ‘পাবলিক প্লেস’, কথা হবেই।
বাংলাদেশের ক্রিকেট মহলে আলোচনা আছে, নাজমুলের ক্রিকেট-মস্তিষ্ক অনেক পরিণত। তাঁকে কেউ কেউ ভবিষ্যত অধিনায়ক হিসেবেও দেখেন। এখন প্রশ্ন হলো, যে ক্রিকেটার এতটা পরিণত, মাঠে তাঁর উদ্যাপনেও তো কোনো না কোনো বার্তা থাকার কথা। সব সময় যে থাকতেই হবে, তা নয়, কিন্তু বিশেষ মুহূর্ত হলে? যেমন ধরুন ওয়ানডে অভিষেকের পাঁচ বছর পর এই সংস্করণে প্রথম সেঞ্চুরি। এমন মুহূর্তে নাজমুলের সবচেয়ে বেশি কী মনে পড়ার কথা?
নাজমুলের মনের ভেতরে তখন কী চলেছে, সেটা তিনিই ভালো জানেন। তবে ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত এ বাঁহাতির গত ছয় বছরের পথটা দেখে একটি বিষয় আন্দাজ করে নেওয়া যায়। এটাই যে ঠিক, তা নয়, কিন্তু যোগসূত্রগুলো তো মিলে যায়!
ধারাবাহিক হতে না পারায় যে ব্যাটসম্যান দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনায় জর্জরিত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অহর্নিশ পরিহাসের পাত্র, সেই ব্যাটসম্যান ওয়ানডে অভিষেকের পাঁচ বছর পর এই সংস্করণে যখন প্রথম সেঞ্চুরি পান—তখন তো নিন্দুকের কথাই সবার আগে মনে পড়ার কথা!
না, সেঞ্চুরি করে সেসব সমালোচনার মোক্ষম জবাব দিতে পারার জন্য নয়। নাজমুলের উদ্যাপনে তার লেশমাত্র বোঝা যায়নি। যেহেতু তিনি নিজে উড়ন্ত চুমুর কারণ ব্যাখ্যা করেননি, তাই কল্পনার রথে চেপে ভাবলে ঠিক এর উল্টোটাই মনে হয়।
সেই যে দুবার লাফ—তা সম্ভবত সমালোচকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। কটু কথার খোঁচায় তাঁর জীবন ‘ভীষ্মের শরশয্যা’র মতো হয়েছিল বলেই তো কাল সেই মুহূর্তে মাটিতে পা পড়েনি। মনের দুঃখকে জিদে রূপান্তর করে নিজেকে ভেঙেচুরে গড়ে উড়তে পারলেন। সেই যে বাতাসে ঘুষি—সেটা সম্ভবত তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম পাঁচ বছরের সব ব্যাটিং-জরার প্রতি।
আর উড়ন্ত চুমু, সেটা সম্ভবত নিন্দুকের জন্য—কথাটা শুনে ভ্রুকুটি জাগতে পারে, নাজমুলের সেঞ্চুরির পর তাঁর প্রতি মনটা একটু নরম থাকলে হতে পারে অনুশোচনাও! তারপরও যদি উড়ন্ত চুমুর হেতু খুঁজতে চান, চোখ রাখুন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লাইনগুলোয়—‘নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো/ যুগ জনমের বন্ধু আমার, আঁধার ঘরের আলো/ সবাই মোরে ছাড়তে পারে বন্ধু যারা আছে/ নিন্দুক সে ছায়ার মতো থাকবে পাছে পাছে/ ...বিনা মূল্যে ময়লা ধুয়ে করে পরিষ্কার/ বিশ্ব মাঝে এমন দয়াল মিলবে কোথা আর?’
পাল্টে যাওয়া এই নাজমুলকে নিয়ে বাংলাদেশের সেসব ‘দয়াল’ সমর্থকদেরও খুশি হওয়ার কথা। ২০১৭ সালে টেস্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক নাজমুলের। পরের বছর ওয়ানডেতে এবং তার পরের বছর অভিষেক টি-টোয়েন্টিতে। তিন সংস্করণ মিলিয়ে তাঁর গত পাঁচ বছরের ব্যাটিং গড়টা খেয়াল করুন। ২০১৭ সালে ১ ম্যাচ খেলে ১৫.০০, পরের বছর ৪ ম্যাচ খেলে ৭.৬০, ২০১৯ সালে ২ ম্যাচ খেলে ৮.০০, ২০২০ সালে ৪ ম্যাচ খেলে ৩৭.৬০।
পাল্টে যাওয়ার হাওয়া লাগতে শুরু করে ২০২১ সাল থেকে। সে বছর টেস্টে দুটি সেঞ্চুরি পান, কিন্তু ব্যাটিং গড় অতটা ভালো ছিল না। ১৪ ম্যাচে ২৪.৮০। গত বছর সেটা আরেকটু কমে, ২৮ ম্যাচে ২৩.১৯।
কিন্তু চোখে লাগার মতো পাল্টে যাওয়াটা বোঝা যাচ্ছে এ বছর থেকে—তিন সংস্করণ মিলিয়ে নাজমুল এ বছর এখন পর্যন্ত খেলেছেন ১৫ ম্যাচ। ৪৪.৮৩ ব্যাটিং গড়ে তুলেছেন ৫৩৮ রান। এর মধ্যে ওয়ানডেতে ৮ ম্যাচে নাজমুলের ব্যাটিং গড় ৫২.৮৫। ৭ ইনিংসে ব্যাট করে ৩৭০ রান তোলার পথে আছে ৩টি ফিফটি ও ১টি সেঞ্চুরি। পরিবর্তনটা বোঝা গেল?
তবে শুধু এ বছর থেকে ধরলে খানিকটা ভুল হয়। গত বছর অক্টোবর-নভেম্বরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান ছিল নাজমুলের। তিনিও যে পারেন, সেই বিশ্বাসটা বোধ হয় তখনই ভিত পেয়ে যায়। কিন্তু নিন্দুকদের মনে তখনো অবিশ্বাস ছিল। অনেকবারই কথা উঠেছে, নির্বাচকদের প্রচ্ছন্ন আশীর্বাদ আছে তাঁর ওপর। চাপা ক্ষোভটা নাজমুল তাই ২০২৩ সালের প্রথম মাসেই উগরে দিয়েছিলেন একটি সংবাদমাধ্যমকে, ‘আমার কাছে মনে হয়, এখন আর প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলি না, পুরো দেশের বিপক্ষে খেলি।’
নাজমুল পরিণত মানসিকতার ক্রিকেটার। আর সে জন্যই ক্ষোভ ঝেড়ে পাল্টেছেন নিজেকে। তাঁর সেই মন্তব্যের পর লিটন দাসই একবার বলেছিলেন, ‘নাজমুল শক্ত মানসিকতার ছেলে। সে অনেক দিন ধরেই এসব (সমালোচনা) ফেস করে আসছে...আপনার যদি জ্বর আসে, তাহলে আপনি এক দিন আপসেট থাকবেন। কিন্তু যখন নিয়মিত হতে থাকবে, তখন মনে হবে, ধুর, এটা আর কী!’
সমালোচনাটা অহর্নিশ ছিল বলেই নাজমুল ভেতরে-ভেতরে নিজেকে পাল্টেছেন। এ সবকিছুই পারফরম্যান্স করতে, ফর্মে ফিরতে। এ বছর সেই ফর্মের দেখা পাওয়ার পর নাজমুলের তাই সবার আগে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদেরই মনে পড়ার কথা।
উড়ন্ত চুমুটা তাই নাজমুল যাঁর প্রতিই ছুড়ে দিন না কেন, গায়ে মাখতে পারেন বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা। কেন, তা বুঝতে যেতে পারেন রবি ঠাকুরের কাছে। তাঁর ‘বিচার’ কবিতার ‘শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে’ লাইনটি একটু ঘুরিয়ে নিলেই বিষয় পরিষ্কার—‘সোহাগ মাখা তারই সাজে শাসন করে যে!’