নাজমুলের জন্য একটি প্ল্যাকার্ড এবং চন্দ্রবিন্দুর সেই গানের লাইন
এই ছবি দেখে কিছু মনে হয়? কোথাও গিয়ে লাগে! এমন কোথাও, যেখানে কেউ নেই, আছে শুধু একটি কল্পিত কাঠগড়া। ছবিটি দেখতে দেখতে হাসতে হাসতে সেখানে কি একবার দাঁড়াতে ইচ্ছা করে? মনে হয়, কেউ এসে জেরা করুক।
জিজ্ঞাসা করুক, ব্যঙ্গ ও তির্যক মন্তব্যে এত দিন যাঁর ছাল-চামড়া তুলে নেওয়া হলো, আজ সে-ই যখন বাংলাদেশকে আগলে রাখছে, তখন কি বুকে সুখের ব্যথা বাজে?
বাজে তো, নাকি? প্রশ্নটি করতেই হচ্ছে। আপাতত মনে হয় বাজছে! নাজমুল আবারও খারাপ খেললে তখন না হয় আবার হবে! ব্যঙ্গ, কটাক্ষ...আরও যা যা আছে কিংবা বানানো যায়। এই সময় তো ট্রলে মেধা বিনিয়োগের। যেমন ধরুন, নাজমুল পরের ম্যাচেই খারাপ খেললে ওপরে যে ছবিটা দেখছেন, সেটাই ধরে হয়তো নতুন ‘মিম’ বানানো হবে। লোকে হাসবে। ভুলে যাবে এখন বুকে বেজে চলা সুখের ব্যথা। কেউ কেউ ফোড়ন কেটে বলতেও পারেন, আরে! অমন ট্রল না করলে কী আর এভাবে ফিরে আসে!
ফিরে আসা—হ্যাঁ, এ কথাটাই। নাজমুলের কাছে পুরো বাংলাদেশের চাওয়া ছিল এটাই। চিরকালের অধৈর্য বাঙালির এমনিতেই ‘ধৈর্য’ শব্দটায় খুব একটা বিশ্বাস নেই, আর কেউ তার পরীক্ষা নেওয়া শুরু করলে তো রক্ষে নেই। সমর্থকদের তাই দোষ দেওয়া যায় না। ব্যবসায় ক্রেতা যেমন ‘লক্ষ্মী’ ক্রিকেটে তেমনি দর্শক; যা খুশি বলতে পারেন। তা মেনে নিয়েই কি অনুরোধটা রাখতে পারেন—ছবিটা একটু মনের চোখে দেখতে পারেন? একটা রূপক কি খুঁজে পাওয়া গেল?
ছবির ঠিক সামনে একদম কেন্দ্রবিন্দুতে যে দর্শকের ‘ব্যাঘ্র’সম হুংকার, ব্যানারটা ঠিক তার পেছনেই। যিনি ধরে আছেন, তাঁর মুখ দেখা যাচ্ছে না। যদি এভাবে ধরে নেওয়া হয়, ব্যানার হাতে মুখ দেখা না যাওয়া সেই সমর্থক বাংলাদেশের অধিকাংশ সমর্থকের প্রতিচ্ছবি। খুব বেশি আপত্তি উঠবে? আচ্ছা, বুঝিয়ে বলা যাক।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ছয় বছর চলছে নাজমুলের। বড় ইনিংস, কার্যকর ব্যাটিংটা যে একদমই করেননি, তা নয়। মাঝেমধ্যে করেছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ‘মাঝেমধ্যে’র খানা নেই। আবার যখন করেছেন, তখনো সেসব ইনিংস ম্যাচের ওই পরিস্থিতির সঙ্গে, সময়ের দাবির সঙ্গে মানানসই ছিল কি না, সে প্রশ্ন উঠেছে।
তাই ট্রলের পর ট্রলে নাজমুলকে জর্জরিত করা হয়েছে। ফেসবুকে ভেসে উঠেছে বাংলা সিনেমার নামকে একটু এদিক-সেদিক করে ‘ট্রল’—শান্ত কেন অশান্ত! প্রচুর হাসির লাইক আর কটাক্ষের মন্তব্য জমা পড়েছে। সেসব দেখে, পড়ে আমরাও বিমল আনন্দ লাভ করেছি। যেন জাতীয় দলে এটাই নাজমুলের একমাত্র দায়িত্ব—খারাপ খেলে মনোরঞ্জন করা!
ইংল্যান্ড এবার বাংলাদেশ সফরে আসার পর সেই ‘দায়িত্ব’ পাল্টেছে। বলা ভালো, নাজমুল নিজেই পাল্টেছেন। সেরা সময় কাটিয়েছেন ক্যারিয়ারের। ওয়ানডে সিরিজে দুটি ফিফটির পর টি-টোয়েন্টি সিরিজে ৩০ বলে ৫১, ৪৭ বলে ৪৬* ও ৩৬ বলে ৪৭ *। কাল তারকাচিহ্নিত শেষ ইনিংসটি খেলার সময় মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে এ ছবি তোলা হয়। ব্যানার হাতে অদৃশ্য সেই দর্শককে কেন এই অধিকাংশ সমর্থকের প্রতিচ্ছবি বলা হচ্ছে, তা নিশ্চয়ই এখন ধরে ফেলেছেন?
লোকে ভুল করলে কিংবা কেউ ভুল ধরিয়ে দিলে মাথাটা আপনাই হেঁট হয়ে আসে। মুখ দেখাতে ইচ্ছে করে না। ব্যানার হাতে অদৃশ্য সেই দর্শক কি রূপক অর্থ তারই প্রতিচ্ছবি নয়? আন্দাজ করাটা দোষের কিছু নয় যে, ব্যানার উঁচিয়ে মুখটা লুকিয়ে সেই দর্শক যদি হেসে থাকেন, সেটুকুই বুকে সুখের ব্যথা—নাজমুলকে নিয়ে যা এখন গোটা বাংলাদেশের বুকেই বাজার কথা! আর প্রাপ্তি?
সামনে দাঁড়িয়ে হুংকার ছাড়া বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রতীক ‘বাঘ’—ইংল্যান্ড যা শুনে মিইয়ে গেল।
এই প্রাপ্তির পেছনেও কিন্তু আছে ক্ষোভের উদ্গিরণ। সেদিনের তারিখটাও ছিল ‘অপয়া’—মানে ‘আনলাকি থার্টিন’। গত ১৩ জানুয়ারি একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নাজমুল বলেছিলেন, ‘আমি এ কথাটা বলতে চাই না। কিন্তু খুব সত্য কথা। আমার কাছে মনে হয় এখন প্রতিপক্ষ দলের বিপক্ষে খেলি না, পুরো দেশের বিপক্ষে খেলি।’ শেষ কথাটি বুঝতে না পারলে কিংবা এই নাজমুলকে দেখার আনন্দে স্মৃতিকে ‘গোল্ড ফিশ মেমোরি’ বানিয়ে ফেললে আরেকটু বুঝিয়ে বলা যায়—বাংলাদেশ দলের এ ব্যাটসম্যান বুঝিয়েছিলেন, তিনি প্রতিপক্ষ নয় নিজ দেশের বিপক্ষেই খেলেন! আর সেটি তার মনে হয়েছে সমালোচনার নির্মম কশাঘাতে।
দাসপ্রথা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের লেখিকা হ্যারিয়েট বিচার স্টোর অমর বই ‘অ্যাঙ্কেল টমস কেবিন’ বইয়ের মূল চরিত্রে টমের ধৈর্য ধরতে ধরতে একসময় বিস্ফোরণ ঘটেছিল। ক্রিকেটের সঙ্গে দাসপ্রথার কোনো সম্পর্ক নেই। খালি চোখে তাই মনে হয়। তবে এখন ফলনির্ভর দুনিয়ায় প্রত্যাশার চাপে সম্পর্কটা মাঝেমধ্যে মনের অগোচরেই এমন হয়ে যায়। এমনিতে সবাই মানেন, ক্রিকেট গোল বলের খেলা, আজ ছক্কা তো কাল ফক্কা! কিন্তু নিজের দলের খেলোয়াড় মাঠে নামলে কথাটা ভুলে যাই সবাই। আর কেউ যদি ধারাবাহিকভাবে অধারাবাহিক হন, তাহলে তো দাসপ্রথার সেসব চরিত্রের মতোই মর্মান্তিক পরিস্থিতি হয়। কিন্তু কেউ ঘুরে দাঁড়ালে?
তখন কিন্তু দাসপ্রথা নয় ‘বুকে আয় ভাই’ পরিবেশের উদ্ভব ঘটে এবং চন্দ্রবিন্দু ব্যান্ডের ওই গানের লাইনগুলো মনে পড়ে—
‘বলতে পারিনি তার যেটুকু যা ভাষা ছিল
কেঁপে ওঠা চোখের পাতায়
তারপর ভোরবেলা ডিঙিয়েছি চৌকাঠ ভয়ানক সতর্কতায়
এভাবেও ফিরে আসা যায়!’