মাহমুদউল্লাহ হারতে হারতে কোথায় যেন জিতে যান

অ্যাকশনে মাহমুদউল্লাহ। আরও একটি ফিফটি, আরও একবার বাংলাদেশের হার। কাল রাতে ওয়ার্নার পার্কেবাংলাদেশ ক্রিকেট এক্স হ্যান্ডল

নতমস্তকে ব্যাটিংয়ে নামা, আউট হয়েও নিচু মাথায় ফেরা। হারের পর ফিল্ডিং শেষে মাঠ ছাড়ার সময়ও মাথাটা তাঁর নিচুই থাকে। সম্ভবত মাথা নিচু রাখাটাই তাঁর অভ্যাস। অদৃষ্টের পরিহাসও যেন তা–ই। খুব কম সময়ই মাথাটা উঁচু হয়েছে নিজে পারফরম্যান্স করার পর দলের জয়ে।

কাল রাতে ওয়ার্নার পার্কেও তেমন ছবি দেখা গেল। তৃতীয় ওয়ানডে হেরে ধবলধোলাই বাংলাদেশ। সতীর্থদের সঙ্গে মাঠ ছাড়ছিলেন মাহমুদউল্লাহ, ওই তো নতমস্তকেই।

আরও পড়ুন

অভ্যাস পাল্টানোর উপায় নেই। দল হেরেছে। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স তাই মূল্যহীন। স্রেফ একটা সংখ্যাই। মাহমুদউল্লাহকে দেখে তখন মনে হতে পারে, পৃথিবীতে সবাই সব সময় জেতার জন্য জন্মায় না। কেউ কেউ হারতে হারতেও কোথাও না কোথাও জিতে যান! ক্রিকেট যেহেতু দলীয় খেলা, দল হারলে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের যেহেতু কোনো দাম নেই, তাই কাল রাতে মাহমুদউল্লাহর ৬৩ বলে ৮৪ রানের অপরাজিত ইনিংসটিও স্রেফ একটি সংখ্যাই। যেমনটা তার আগের ম্যাচে ৯২ বলে ৬২, তার আগের ম্যাচে ৪৪ বলে অপরাজিত ৫০। এটুকু পড়তে পড়তে আপনার হয়তো মনে হতে পারে, ক্রিকেট কী নির্মম একটা খেলা!

মাহমুদউল্লাহর কি কখনো কখনো মনে হয়, ক্রিকেট খুব নির্মম খেলা
আইসিসি

অবশ্যই। তবে সবার জন্য সম্ভবত নয়। শুধু মাহমুদউল্লাহদের জন্য। আরও নির্মম ব্যাপার হলো, সেটাও সম্ভবত তাঁর সবচেয়ে পছন্দের সংস্করণে। মাহমুদউল্লাহর ৫০ ম্যাচের টেস্ট ক্যারিয়ার থেমেছে তিন বছর আগে। টি–টোয়েন্টি ছেড়েছেন সর্বশেষ ভারত সিরিজে গত অক্টোবরে। থেকে গেছে শুধু ওয়ানডে, যেটা দিয়ে ১৭ বছরের বেশি সময় আগে তাঁর আন্তর্জাতিক অভিষেক। যে সংস্করণ বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি স্বস্তি নিয়ে খেলে বলে ধারণাও প্রচলিত আছে। প্রশ্ন হলো, সেই সংস্করণ থেকেই মাহমুদউল্লাহ নিজে পারফরম্যান্সের পর জয়ের স্বস্তি কিংবা তুষ্টি নিয়ে মাঠ ছাড়তে পেরেছেন কতবার?

আরও পড়ুন

মাহমুদউল্লাহর ২৩৮ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ব্যাটিং ইনিংস ২০৮টি। সেঞ্চুরি ৪টি, ফিফটি ৩২টি। অর্থাৎ ন্যূনতম ৫০ রানের ইনিংস ৩৬টি। বাংলাদেশের ক্রিকেটের মান বিচারে একদম খারাপ নয়; বরং অতীত ম্যাচগুলোর বিপদ–আপদ ভাবলে বেশ ভালোই। এর মধ্যে তাঁর ১৬টি ন্যূনতম ৫০ রানের ইনিংসে বাংলাদেশ জিতেছে।

সেই ১৬ ইনিংসের মধ্যে ২টি সেঞ্চুরি—২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১০৩ ও ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে কার্ডিফে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেই মহাকাব্যিক ১০২*। পাশাপাশি তাঁর ১৪টি ফিফটি হয় দলের বিপদে, নয় তো ইনিংস যতটা সম্ভব টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। তাতে জিতেছে বাংলাদেশই। নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছা করছে, ফিফটিগুলো কোন কোন দলের বিপক্ষে? কারণ, ফেসবুকে এমন আলোচনা প্রায়ই দেখা যায়, অমুক ব্যাটসম্যান বড় দলগুলোর বিপক্ষে পারেন কিংবা পারেন না! তমুক ব্যাটসম্যান শুধু ছোট দলের বিপক্ষে পারেন, এসব আরকি।

হিসাব যদি তিন সংস্করণ মিলিয়ে করা হয়, তাহলেও মাহমুদউল্লাহর নতমস্তক জোর করেও টেনে তোলা যায় না। তাঁর খেলা ১৬৮ ম্যাচে জিতেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ইনিংসসংখ্যা ১৪২। ৫টি সেঞ্চুরি, ২০টি ফিফটি। তবে হারের পাল্লাই ভারী।

সে যাহোক, মাহমুদউল্লাহর এই ১৪ ফিফটির মধ্যে ৪টি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, ৩টি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে, ২টি আফগানিস্তানের বিপক্ষে এবং ১টি করে ইংল্যান্ড, ভারত, স্কটল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। মাহমুদউল্লাহর যে ৮৪ ইনিংসের ম্যাচে বাংলাদেশ জিতেছে, সেখানে তাঁর স্ট্রাইক রেট ৮২.৪২।

আরও পড়ুন

এবার হারের প্রসঙ্গে আসা যাক। জয়ের পরিসংখ্যান দেখে বোঝা যায়, মাহমুদউল্লাহর ন্যূনতম ৫০ রানের ৩৬টি ইনিংসের মধ্যে ২০টিতেই হেরেছে বাংলাদেশ। তার মধ্যে সেঞ্চুরি ২টি, ফিফটি ১৮টি। দুটি সেঞ্চুরির একটি ২০১৫ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অপরাজিত ১২৮, আরেকটি তুমুল সমালোচিত—গত বছর বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার ৩৮২ রান তাড়া করতে নেমে তাঁর ১১১ বলে ১১১। দলের হার প্রায় নিশ্চিতের সময়ও তাঁর সেঞ্চুরি উদ্‌যাপন বেশ সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। এই মাহমুদউল্লাহও কিন্তু অচেনা নন। ম্যাচের ভাগ্য একদিকে, আর চাপের মুখে মাহমুদউল্লাহর ব্যাটের গতি অন্যদিকে—এমন উত্তর–দক্ষিণও কিন্তু দেখা গেছে।

যেমনটা হয়তো খুঁজে পেতে পারেন তাঁর এই ১৮টি ফিফটির ইনিংসেও। যেখানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তাঁর ফিফটি ৫টি, দুটি করে জিম্বাবুয়ে, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ১টি আফগানিস্তানের বিপক্ষে। মাহমুদউল্লাহর যে ১২২ ইনিংসের ম্যাচে বাংলাদেশ হেরেছে, সেখানে তাঁর স্ট্রাইক রেট ৭৪.৫৫।

ক্যারিয়ারের শেষ দিকে এসে ওয়ানডে ভাগ্য আরও নির্মম হয়েছে তাঁর প্রতি
প্রথম আলো

একই হিসাব যদি তিন সংস্করণ মিলিয়ে করা হয়, তাহলেও মাহমুদউল্লাহর নতমস্তক জোর করেও টেনে তোলা যায় না। তাঁর খেলা ১৬৮ ম্যাচে জিতেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ইনিংসসংখ্যা ১৪২। ৫টি সেঞ্চুরি, ২০টি ফিফটি। তবে হারের পাল্লাই ভারী। মাহমুদউল্লাহর খেলা ২৪৬ ম্যাচে হেরেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ইনিংসসংখ্যা ২৭৯। সেঞ্চুরি ৪টি, ফিফটি ৩৪টি।

আরও পড়ুন

ওয়ানডে ভাগ্য ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসে আরও নির্মম হয়েছে তাঁর প্রতি। গত বছর থেকে মাহমুদউল্লাহ এই সংস্করণে ন্যূনতম ৫০ রানের ইনিংস খেলেছেন ৬টি। সব কটিতেই হেরেছে বাংলাদেশ। গত বছর অক্টোবরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেই ১১১–এর ফল তো বলাই হলো। সেই বিশ্বকাপেই পাকিস্তানের বিপক্ষে তাঁর ৫৬ রানের ইনিংসেও হেরেছে বাংলাদেশ। এ বছর নভেম্বর শারজায় তৃতীয় ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে তাঁর ৯৮ বলে ৯৮ রানেও ভাগ্য পাল্টায়নি। তারপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে কাল শেষ হওয়া সিরিজে তিন ম্যাচেই ন্যূনতম ৫০ রানের ইনিংস খেলেছেন। সিরিজের ফল আপনার জানা।

এটাও নিশ্চয়ই জানা, সিরিজটি যেখানে হলো, সেই ওয়ার্নার পার্কে ওয়ানডেতে মাহমুদউল্লাহর চেয়ে বেশি রান নেই কারও। ৮ ইনিংসে ২৪৮ রান করা (৮২.৮৪ স্ট্রাইক রেট) ক্রিস গেইলের মতো ‘দানো’ও তাঁর পেছনে! সেখানে মাহমুদউল্লাহর ৬ ইনিংসে ১৭০.৫০ গড়ে ৩৪১ রান। ৯৫.৭৮ স্ট্রাইকরেট। ফিফটি ৫টি। অপরাজিত ছিলেন ৪বার। কিন্তু জয়ের স্বাদ পেয়েছেন মাত্র দুবার।

পরিসংখ্যান ছাপিয়ে সবচেয়ে বড় ব্যাপারটি হয়তো অন্য কিছু। ৩৮ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পরও আমরা তাঁর ব্যাটে ভরসা রাখতে বাধ্য হচ্ছি। অন্য ভাষায়, তিনিই বাধ্য করছেন।

মাহমুদউল্লাহর ১৭ বছরের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে তাকালে দেখা যায়, এ বছরই তাঁর স্ট্রাইক রেট ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ (৯৫.১৯)। স্ট্রাইক রেট নিয়েও একসময় কথা শোনায় সংগত কারণে পরিসংখ্যানটি উপস্থাপন করা। স্ট্রাইক রেটের প্রসঙ্গই যেহেতু উঠল, দলে মাহমুদউল্লাহর ভূমিকাতেও একবার তাকাতে হবে। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ ৭৪বার ছয়ে ব্যাটিংয়ে নেমেছেন—যেটা আসলে ম্যাচ শেষ করে আসার পজিশন। পরিস্থিতি বুঝে ব্যাট করারও জায়গা, দ্রুত রান তোলা তো বটেই। ম্যাচের গতিপ্রকৃতি বুঝে তিন ভূমিকায় মাহমুদউল্লাহ কখনো পেরেছেন, কখনো পারেননি।

তবু মাহমুদউল্লাহ—নামটি শুনলে সবার আগে কোন ছবিটি ভেসে ওঠে?

দ্রুত কয়েকটি উইকেট হারিয়ে চাপে বাংলাদেশ। মাহমুদউল্লাহ ক্রিজে এসে ইনিংস মেরামত করে স্কোরটা ভদ্রস্থ কিংবা লড়াকু চেহারা দিয়েছেন। কিংবা কখনো কখনো জিতিয়েও দিয়েছেন।

পরিসংখ্যান সেই ছবিকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অস্বীকার করলেও যে ছাপ তিনি ফেলেছেন, সেটি মুছে ফেলা প্রায় অসম্ভব। আর সে ছাপটাই আসলে দলের হারে তাঁর নিজের কোথাও না কোথাও জিততে যাওয়ার ক্যানভাস! না হলে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ছক্কার রেকর্ডটি তাঁর হয় না। এটাও তো দলকে জেতানোর চেষ্টার তথাকথিত সেই ‘ইনটেন্ট’! কিন্তু এসব পরিসংখ্যান ছাপিয়ে সবচেয়ে বড় ব্যাপারটি হয়তো অন্য কিছু। ৩৮ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পরও আমরা তাঁর ব্যাটে ভরসা রাখতে বাধ্য হচ্ছি। অন্য ভাষায়, তিনিই বাধ্য করছেন।

সেই খেলার শেষে হার–জিত যা–ই থাক, তাঁর লড়াইটুকু না থাকলে তো অনেক আব্রুই খসে পড়ত, তাই না!