বিপিএলের আলোচিত পাঁচ: তামিম, সাকিব ও আরও তিন
৪৭ দিন ও ৪৬ ম্যাচের ক্রিকেটযজ্ঞ শেষে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) দশম আসরের পর্দা নামল। বাংলাদেশ ক্রিকেটের তারকা-মহাতারকাদের উপস্থিতি তো ছিলই। আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকা আন্তর্জাতিক ও ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের তারকারাও টুর্নামেন্টকে আলোকিত করেছেন। এর আগে অন্য দুই নামে চেষ্টা করেও ব্যর্থ বরিশাল এবার প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতেছে ‘ফরচুন’ কথাটা গায়ে জড়িয়ে। নানা ঘটন-অঘটনের এবারের বিপিএলের পাঁচ আলোচিত ঘটনা বেছে নেওয়ার চেষ্টা করলে কেমন হয়!
তামিমের প্রত্যাবর্তন
তামিম ইকবালের ফেসবুক পেজটা একবার ঘুরে আসুন। একটা সময় প্রায় প্রতি রাতেই বন্ধুদের সঙ্গে টেপ-টেনিস ক্রিকেট খেলার প্রমাণ পাবেন। টুর্নামেন্টের কয়েক সপ্তাহ আগে ক্রিকেট বলে খেলা শুরু করেন। তারও আগে তামিমের সঙ্গে কী হয়েছে, তা তো সবারই জানা। গত বছরের জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে আচমকা অবসর নিয়েছিলেন। অবসর ভেঙে গত সেপ্টেম্বরে ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের দুটি ম্যাচ খেললেও নানা বিতর্কে খেলা হয়নি বিশ্বকাপ।
বিপিএল দিয়ে প্রতিযোগিতাপূর্ণ ক্রিকেটে ফেরার ঘোষণা দিয়েছিলেন আগেই। কোন তামিম ফিরবেন, সেটাই ছিল প্রশ্ন। সে প্রশ্নের উত্তরটা তিনি দিয়েছেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়ে। ১৫ ম্যাচে ৩ অর্ধশতকে ৩৫ গড় ও ১২৭ স্ট্রাইক রেটে ৪৯২ রান করেছেন ফরচুন বরিশালের অধিনায়ক। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া যাকে বলে, ঠিক তা-ই করেছেন তামিম। অধিনায়ক হিসেবে জিতেছেন বিপিএল ক্যারিয়ারের প্রথম শিরোপা। পেয়েছেন এবারের বিপিএল-সেরার পুরস্কারও। প্রত্যাবর্তন তো একেই বলে!
সাকিবের লড়াই
গত বিশ্বকাপে আঙুলে চোট পাওয়ার পর থেকেই খেলার বাইরে ছিলেন সাকিব আল হাসান। তামিমের মতো সাকিবের জন্যও বিপিএল ছিল ফেরার মঞ্চ। তবে আঙুলের চোট থেকে ফিরলেও চোখের সমস্যা সাকিবকে বিপিএলের শুরু থেকেই ভুগিয়েছে। বিশ্বকাপের সময় ভারতে ডাক্তার দেখিয়েছেন। বিপিএল শুরুর আগে দেশেও। তাতে কাজ না হওয়ায় লন্ডন গিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাতে। গিয়েছেন সিঙ্গাপুরেও। তাতেও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় সাকিব তাঁর দল রংপুর রাইডার্সের হয়ে কয়েকটি ম্যাচ খেলেছেন বোলারের ভূমিকায়।
টুর্নামেন্টের মাঝপথে পুরোদমে ব্যাটিং শুরু করেন সাকিব। সেটিও রীতিমতো মার মার কাট কাট ব্যাটিং। ১৩ ম্যাচের ১১ ইনিংসে ব্যাটিং করে রান করেছেন ২৫৫, স্ট্রাইক রেট ১৫৮। এর সিংহভাগ রানই এসেছে শেষ ৬ ম্যাচে (১৬২.৩৯ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ১৯০ রান)। এ তো গেল ব্যাটসম্যান সাকিবের কথা। ছন্দে ফেরার পর সেরা বোলারদের তালিকায়ও তরতরিয়ে ওপরে উঠে এসেছেন। লিগ শেষ করেছেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৭ উইকেট নিয়ে।
স্থানীয়দের দাপট ও নিষ্প্রভ বিদেশিরা
এবারের আসরে সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক ও উইকেটশিকারির তালিকায় স্থানীয় খেলোয়াড়দের জয়জয়কার। বিদেশি তারকারা সেই অর্থে দাপট দেখাতে পারেননি। এর বড় কারণ অবশ্য বিদেশিদের আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকা। বড় তারকাদের কেউই পুরো টুর্নামেন্ট খেলতে পারেননি। ব্যাটিংয়ে শীর্ষ পাঁচের তালিকায় সেরা পাঁচ ব্যাটসম্যানের সবাই বাংলাদেশের। ৪৯২ রান করে তামিমের এই তালিকার শীর্ষে থাকার কথা তো আগেই বলা হলো। এরপরই আছেন তাওহিদ হৃদয়।
গতবারের বিপিএলে প্রথম নিজেকে চিনিয়েছিলেন। ১৪০.৪১ স্ট্রাইক রেটে করেছিলেন ৪০৩ রান। এবার তাওহিদ হৃদয় ছাড়িয়ে গেছেন সেই সাফল্যকেও। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের এই ব্যাটসম্যান ১৪ ইনিংসে ১৪৯.৫১ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ৪৬২ রান। পেয়েছেন ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরিও।
কুমিল্লার অধিনায়ক লিটন দাসের বিপিএল ছিল দুই রকম। শুরুর ৫ ম্যাচে মাত্র ৩৭ রান, বিপিএল শেষে ৩৯১। যার মানে, শেষ ৬ ম্যাচে করেছেন ২৫৪ রান। আরেক ওপেনার তানজিদ হাসান ক্যারিয়ারের প্রথম টি-টোয়েন্টি শতকসহ ১৩৫ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ৩৮৪ রান। মুশফিকুর রহিমও আছেন শীর্ষ পাঁচে। করেছেন ৩৮০ রান, যদিও স্ট্রাইক রেট মাত্র ১২০।
উইকেটশিকারিদের তালিকায়ও স্থানীয়দের দাপট। ১২ ম্যাচে ২২ উইকেট নিয়ে শীর্ষে শরীফুল ইসলাম। ১৭ উইকেট নিয়ে সাকিব দুই নম্বরে, তিনে ও চারে আছেন শেখ মেহেদী হাসান (১৬) ও মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন (১৫)। সেরা পাঁচে একমাত্র বিদেশি চট্টগ্রামের হয়ে খেলা ওমানের পেসার বিলাল খান। ১৩ ম্যাচ খেলে তাঁর শিকার ১৫ উইকেট।
অভিজ্ঞতার জয়
২০ ওভারের খেলায়ও অভিজ্ঞতার মূল্য কতটা, এবারের বিপিএলে তার আরও একটি প্রমাণ পাওয়া গেল। বিপিএল চ্যাম্পিয়ন ফরচুন বরিশাল দলটি সাজানোই হয়েছিল অভিজ্ঞতার দিকে তাকিয়ে। অধিনায়ক তামিম ইকবাল তো ছিলেনই; মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহর মতো অভিজ্ঞরা খেলেছেন এ দলে।
বিদেশি ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রেও অভিজ্ঞদের প্রাধান্য দিয়েছে দলটি। শোয়েব মালিক, আহমেদ শেহজাদের মতো অভিজ্ঞরা এই দলে খেলেছেন। শেষে যোগ দিয়েছেন টি-টোয়েন্টির আরেক অভিজ্ঞ সৈনিক ডেভিড মিলার, যা চাপের মুহূর্তে বরিশালকে অন্যদের তুলনায় এগিয়ে রেখেছে।
চার লিগের সঙ্গে বিপিএলের লড়াই
বিপিএল যখন শুরু হয়, তখন অস্ট্রেলিয়ায় বিগ ব্যাশ টি-টোয়েন্টি লিগ শেষের পথে। দক্ষিণ আফ্রিকায় এসএ২০ শুরু হয় বিপিএলের সপ্তাহখানেক আগেই। আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের টি-টোয়েন্টি লিগ আইএল টি-টোয়েন্টি শুরু হয় বিপিএল শুরুর দিনই (১৯ জানুয়ারি)। বিপিএলের মাঝপথেই শুরু হয়ে যায় পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল)। একই সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টি-টোয়েন্টি লিগ হওয়ায় বিপিএল দলগুলো বিদেশি খেলোয়াড়দের পুরো টুর্নামেন্টের জন্য পায়নি।
প্রায় পুরো টুর্নামেন্টেই খেলোয়াড়রা ছিলেন আসা-যাওয়ার মধ্যে। যে কারণে দলগুলোকে প্রতিনিয়ত নতুন সমন্বয় খুঁজতে হয়েছে। এ নিয়ে টানা দুই মৌসুম দলগুলোকে এই চ্যালেঞ্জ সামলাতে হয়েছে। আগামী মৌসুমেও প্রায় একই সময়ে বিপিএল হওয়ার কথা। বুঝতেই পারছেন, বিদেশি ক্রিকেটার নিয়ে আরও চারটি লিগের সঙ্গে বিপিএলের এই টানাটানি আগামী মৌসুমেও চলবে।