দুজনের নামের শেষেই ‘খান’ আছে। এর বাইরে আর কোনো মিল কি ছিল এত দিন? থাকলেও তা জানা নেই। এখন অবশ্য ইমরান খান আর তামিম ইকবাল খানের মধ্যে আরেকটা বড় মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। সেই মিল অবসর থেকে ফিরে আসায়। যে কারণে সিদ্ধান্ত বদল, মিল আছে সেখানেও।
সেই মিলটা কি আপনি এরই মধ্যে বুঝে ফেলেছেন? তাহলে তো হলোই। না বুঝে থাকলে একটু বুঝিয়ে বলতে হয়। আগের দিন সারা দেশকে আলোড়িত করে অবসরের ঘোষণা দেওয়ার পরদিনই তামিম ইকবালের সিদ্ধান্ত বদলে যাওয়ার কারণ তো এরই মধ্যে জেনে গেছেন বলে অনুমান করি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তামিমকে ডেকে পাঠিয়ে সিদ্ধান্ত বদলাতে নির্দেশ দিয়েছেন। পরে তামিম যা বলেছেন, সেটা খুবই সত্যি। প্রধানমন্ত্রী কোনো কিছু বললে তা না মেনে তো উপায় থাকে না।
ইমরান খানের ঘটনাও তো তা-ই ছিল। অবসর থেকে তাঁর ফিরে আসাও সরকারপ্রধানের অনুরোধে। ইমরানের সঙ্গে তামিমের অন্য মিলটাও নিশ্চয়ই বোঝা গেল। তবে দুটি ভিন্ন ঘটনা তো আর হুবহু এক হয় না। কিছু পার্থক্য থাকেই। এখানেও আছে। তামিমের মতো কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই দুম করে অবসরের ঘোষণা দিয়ে বসেননি ইমরান খান। তাতে রাগ-ক্ষোভ-অভিমান, মানে আবেগেরও বিন্দুমাত্র ভূমিকা ছিল না। ভেবেচিন্তে নেওয়া সেই সিদ্ধান্তে যুক্তিই বেশি প্রাধান্য পেয়েছিল।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৬ বছর কাটিয়ে ফেলার পর (এখানেও দেখছি তামিমের সঙ্গে আরেকটি মিল) ইমরানের মনে হয়েছিল, অনেক হয়েছে, এবার একটু অন্যদিকে মন দেওয়া যাক। যে কারণে ঘোষণা করে দিলেন, ১৯৮৭ বিশ্বকাপই হবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর পদচারণের শেষ সাক্ষী। এই উপমহাদেশে প্রথম বিশ্বকাপ। ইংল্যান্ডের বাইরেও প্রথম। আগের তিনটি বিশ্বকাপই বিলেতে হয়েছে, ইংলিশ গ্রীষ্মের সূর্য সহজে ডুবতে চায় না বলে সেই সুবিধা কাজে লাগিয়ে খেলা হয়েছে ৬০ ওভারের। উপমহাদেশে বেড়াতে আসাতেই না ক্রিকেট বিশ্বকাপ ৫০ ওভারের ম্যাচ হয়ে গেল। পরে একসময় সব এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচই।
লেখাটা যেহেতু মিল খোঁজার, ইমরানের গল্পে আবার যাওয়ার আগে তামিমের সঙ্গে তাঁর আরেকটা মিলের কথা কি বলে নেব! অবসরের ঘোষণা দেওয়ার সময় দুজনই দলের অধিনায়ক। অলরাউন্ডার হিসেবে সর্বকালের সেরাদের একজন, তবে সেটিকেও ছাপিয়ে যায় ইমরানের অধিনায়ক–পরিচয়। তামিম ইকবালের ক্ষেত্রে অবশ্যই তা নয়। তামিমের কথা বললে অধিনায়কত্বের চেয়ে তাঁর ব্যাটসম্যানশিপই আগে চলে আসে। যদিও কৌতূহলভরে দুজনের অধিনায়কত্ব রেকর্ড দেখতে গিয়ে একটু চমকেই গেলাম। ওয়ানডেতে তো দেখছি অঙ্কের হিসাবে তামিম ইমরানের চেয়েও সফল। ১৩৯ ম্যাচের ৭৫টি জিতে ইমরানের সাফল্যের হার যেখানে ৫৩.৯৫; ৩৭ ম্যাচের ২১টি জিতে তামিমের তা ৫৬.৭৫। এটা শুধুই একটা তথ্য, সিরিয়াসলি নেবেন না বলেই আশা করি। অধিনায়ক হিসেবে ইমরান খানের সঙ্গে তাঁর তুলনা করছি শুনলে তামিমের নিজেরই বিরক্ত হওয়ার কথা।
ইমরানের অবসরে ফিরি। শেষের ঘোষণা দেওয়ার পর ইমরানের চাওয়া হতে পারত একটাই। শেষটা যেন বিশ্বকাপ হাতে নিয়ে হয়। তা অবশ্য হয়নি। লাহোরে সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে যায় পাকিস্তান। জয়-পরাজয় তো পরের কথা, ম্যাচ শুরু হওয়ার আগেই সবাই জানত, এটাই পাকিস্তানের মাটিতে ইমরানের শেষ ম্যাচ। হারলে তো শেষই, জিতলেও ফাইনাল খেলতে পাকিস্তান যাবে কলকাতায়। সেই সেমিফাইনালে লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের গ্যালারি প্রায় সারাক্ষণ একটা গানই গেয়ে গেল—কাভি আলবিদা না কেহনা।
খেলাটা টেলিভিশনে দেখেছিলাম। গ্যালারিতে রঙিন রুমাল নাচিয়ে নাচিয়ে ওই গান গাওয়ার দৃশ্যটা এত বছর পরও চোখে ভাসে। ক্রিকেটজীবনের ইমরান খান সম্পর্কে যদি আপনার একটুও জানাশোনা থেকে থাকে, তাহলে না বললেও বুঝবেন, কখনো বিদায় না বলার ওই আকুল আবেদনে গ্যালারির নারীকুলের অংশগ্রহণ ও উৎসাহই বেশি ছিল। ইমরান অবশ্য সেই আবেদনে সাড়া দেননি। লাহোরের ওই সেমিফাইনাল শেষে দর্শকদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নিয়ে তিনি বেরিয়ে যান আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে।
ক্রিকেট বোর্ডেরই কেউ হয়তো সরকারপ্রধানের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। সেই সময় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক। তাঁর অনুরোধেই অবসর ভেঙে ফিরে আসতে রাজি হন ইমরান।
তবে তা মাত্র মাস চারেকের জন্যই। ১৯৮৮ সালের মার্চে পাকিস্তান দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যাবে। সেই সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর মানে ক্রিকেটারদের জন্য আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে নির্বাসনের মতো। উপমাটা জুতসই হলো না। গুয়ানতানামো বে কারাগার বললে মনে হয় বেশি বোঝানো যায়। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান পেস কোয়ার্টেটের সামনে পড়ার পর উইকেটকে ব্যাটসম্যানদের যে অনেকটা টর্চার সেলই মনে হতো। ইমরানের ভাষ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানের কোনো ক্রিকেটারই নাকি ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে অধিনায়কত্ব করতে রাজি হচ্ছিলেন না। ইমরান খানকে কি তাহলে ফিরিয়ে আনা যায় না? তা ইমরানকে বললেই তিনি ফিরবেন নাকি! অগত্যা ক্রিকেট বোর্ডেরই কেউ হয়তো সরকারপ্রধানের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। সেই সময় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক। তাঁর অনুরোধেই অবসর ভেঙে ফিরে আসতে রাজি হন ইমরান।
সারা জীবন চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবেসেছেন। ওই প্রমত্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর চ্যালেঞ্জ নেওয়ার ইচ্ছাও ভূমিকা রেখেছিল ইমরানের সিদ্ধান্ত বদলে। সেই চাওয়া পূরণ না হলেও সিরিজ একটা হয়েছিল বটে। ১-১ টেস্টে ড্র সেই সিরিজ পাকিস্তানের পক্ষে ২-১ হয়নি নাকি শুধুই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান আম্পায়ারদের দেশপ্রেমের কারণে। যাক, এটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
‘খান’ পদবি ছাড়াও ইমরান খান ও তামিম ইকবাল খানের মধ্যে আরও দুটি মিল তো এতক্ষণে নিশ্চয়ই পরিষ্কার। পদবি, অবসর থেকে একই পদ্ধতিতে ফেরা, দুজনই অধিনায়ক—এর বাইরেও কি কিছু যোগ হবে? কতভাবেই তো তা হতে পারে। শুধু ক্রিকেটেই যদি থাকি, সেই সুযোগও তামিম ইকবালের সামনে ভালোই আছে। অবসর ভেঙে ফেরার পরই ইমরানের ক্যারিয়ারে বড় দুটি সাফল্য। দুটিই ওয়ানডেতে। ১৯৮৭ বিশ্বকাপে যে ইডেনে ফাইনাল খেলা হয়নি বলে দুঃখ ছিল, ১৯৮৯ সালে সেই ইডেনেই ভিভ রিচার্ডসের বলে ওয়াসিম আকরামের ছক্কায় শেষ হওয়া ফাইনাল জিতে নেহরু কাপ হাতে নিয়েছেন ইমরান। সে সময়কার ৮টি টেস্ট দলের ৬টিই খেলেছিল বলে অনায়াসেই যেটিকে মিনি বিশ্বকাপ বলা যায়। এর তিন বছর পর তো জিতলেন আসল বিশ্বকাপই। সেটিও ‘কামব্যাক’–এর এক অবিশ্বাস্য গল্প লিখে।
অপ্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে এসব? বুঝিয়ে বললে সেই সমস্যা থাকবে না। দেড় মাসের ছুটিতে মন শান্ত করে তামিম ইকবাল যে টুর্নামেন্টে ফিরবেন বলে শুনলাম, সেই এশিয়া কাপকে তো নেহরু কাপের মতো কিছু ধরাই যায়। আর এর কদিন পরই তো বিশ্বকাপ। ইমরানের মতোই ফিরে আসা তামিম ইকবালের বাংলাদেশ যদি এই দুই টুর্নামেন্টে...
থাক, কল্পনাটা একটু হয়তো বল্গাছাড়াই হয়ে যাচ্ছে।