চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে আফগানিস্তানকে বয়কটের ডাক, বাস্তবায়ন কি সম্ভব
প্রথমে প্রায় দুই শর কাছাকাছি ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ, এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রীড়ামন্ত্রী। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ বয়কটের আহ্বান জানানো হয়েছে এ দুটি পক্ষ থেকে।
আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি শুরু হতে যাওয়া ৮ দলের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির গ্রুপ পর্বে আফগানিস্তানের সঙ্গে ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচ আছে। দুটি দেশ থেকেই দাবি উঠেছে, আফগানিস্তানে নারী অধিকার খর্ব করার এই সময়ে তাদের ছেলেদের ক্রিকেট দলের সঙ্গে ম্যাচ খেলা উচিত হবে না। ব্রিটিশ রাজনীতিবিদেরা, পরবর্তী সময়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের দপ্তর থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ভার ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের ওপর। আর দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রীড়ামন্ত্রী গায়টন ম্যাকেঞ্জি সিদ্ধান্ত নিতে বলেছেন ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকাকে (সিএসএ)।
প্রশ্ন হচ্ছে, দুটি দেশের সরকারের পক্ষ থেকে আফগানিস্তানের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ম্যাচ বয়কটের যে আওয়াজ উঠেছে, সেটি কি বাস্তবায়ন সম্ভব? দুই দেশের ক্রিকেট বোর্ড ইসিবি ও সিএসএ এ বিষয়ে কী অবস্থান নিতে পারে, ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি-ই কী করতে পারে?
২০১৮ সালে আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডকে (এসিবি) যেসব শর্তে আইসিসির পূর্ণ সদস্যের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল, তার অন্যতম ছিল নারী ক্রিকেট দল রাখতে হবে। ২০২০ সালে ২৫ নারী ক্রিকেটারকে বোর্ডের চুক্তিতে এনে কার্যক্রমও শুরু হয়েছিল। তবে ২০২১ সালের আগস্টে তালেবানরা ক্ষমতায় আসার পর আফগানিস্তানে মেয়েদের ক্রিকেট দল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাসহ মেয়েদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনায় আফগানিস্তানের নারী অধিকার খর্বিত হয়।
এ নিয়ে মানবাধিকার সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের সরকার আফগানিস্তানে তালেবান নীতির সমালোচনা করে আসছে। তারই অংশ হিসেবে ‘নিজেদের করণীয়’ হিসেবে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ না খেলার আলোচনা উঠেছে ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকায়। রাজনৈতিক কারণে ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের ম্যাচ বয়কটের দৃষ্টান্তও আছে।
২০০৩ বিশ্বকাপের যৌথ আয়োজক ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা ও জিম্বাবুয়ে। ওই সময় রবার্ট মুগাবে সরকারের নীতির বিরোধিতার অংশ হিসেবে জিম্বাবুয়েতে খেলতে যায়নি ইংল্যান্ড।
২২ বছর আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে কি?
২০০৩ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের প্রথম ম্যাচ ছিল জিম্বাবুয়ের হারারেতে। ওই সময় যুক্তরাজ্য সরকার ক্রিকেট দলকে জিম্বাবুয়ে ম্যাচ বয়কট করার আহ্বান জানায়। প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার বলেছিলেন, ‘আমরা ক্রিকেট কর্তৃপক্ষকে স্পষ্ট করেই বলেছি, তাদের জিম্বাবুয়েতে যাওয়া উচিত হবে না। আশা করি, তারা আমাদের পরামর্শ আমলে নেবে। তবে যাওয়া না যাওয়ার সিদ্ধান্তের ভার ওদেরই।’
টেলিগ্রাফের খবরে বলা হয়, ওই সময় কেপটাউনের কালিনান হোটেলে জিম্বাবুয়ে সফর নিয়ে বৈঠকে বসেছিল ইংল্যান্ড দল। জিম্বাবুয়ের সঙ্গে যুক্তরাজ্য সরকারের ব্যবসা-বাণিজ্য বহাল থাকলেও ক্রিকেটারদের খেলতে মানা করায় চাপে ছিলেন ক্রিকেটাররা। কিছু খেলোয়াড় কেঁদেও ফেলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত নাসের হুসেইনের নেতৃত্বাধীন দল জিম্বাবুয়েতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
এ ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের ভরসা ছিল, ৭ দলের গ্রুপে এক ম্যাচ ওয়াকওভারের দিলেও পরের ধাপে যেতে সমস্যা হবে না। কিন্তু ইংল্যান্ড তাদের বাকি ৫ ম্যাচের ৩টিতে জিতলেও সুপার সিক্সে জায়গা করতে পারেনি। টেলিগ্রাফ লিখেছে, এ ঘটনার পর ইসিবির তৎকালীন দায়িত্বশীলরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ক্রিকেটারদের খেলা না খেলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিস্থিতিতে ঠেলে দেওয়া হবে না।
তাই এটা স্পষ্ট যে নাসের হুসেইনদের মতো জস বাটলারদের এবার আফগানিস্তান ম্যাচ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে না।
ইসিবি এবার কী চায়, দক্ষিণ আফ্রিকাই–বা কী বলছে?
আফগানিস্তান ম্যাচ বয়কটের জন্য ১৬০ জনের বেশি রাজনীতিবিদের আহ্বান–সংবলিত চিঠি পাওয়ার পর এ নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় ইসিবির প্রধান নির্বাহী ইয়ান গোল্ড বলেছেন, ইংল্যান্ডের একার নয়, এ ব্যাপারে আইসিসির সব সদস্যদেশেরই একমত হয়ে কিছু করা উচিত, ‘ইসিবি অবশ্যই তালেবান শাসনে আফগান নারী ও কন্যাশিশুদের প্রতি আচরণের কঠোর নিন্দা জানায়। আফগানিস্তান যে নারীদের ক্রিকেট খেলতে দিচ্ছে না, সে কারণে ইসিবি দেশটির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলা থেকে বিরত আছে। তবে কোনো একটি দেশের একাকী প্রতিবাদের চেয়ে আইসিসি যদি সবাইকে নিয়ে কিছু করে, সেটিই বেশি কার্যকর হবে।’
নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আইসিসির ভূমিকা রাখা উচিত বলে মন্তব্য এসেছে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের মুখপাত্রের কাছ থেকেও।
দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রীড়ামন্ত্রী তাঁর দেশের ক্রিকেট বোর্ডকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘আফগানিস্তানের বিপক্ষে ক্রিকেটীয় সূচির প্রতি ক্রিকেট সাউথ আফ্রিকা সম্মান দেখাবে কি না, ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে এটা আমার ওপর নির্ভর করে না। এই সিদ্ধান্তের ভার যদি আমার ওপর থাকত, তাহলে নিশ্চিত করেই এমনটা (আফগানিস্তানের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার খেলা) হতো না।’
এ বিষয়ে সিএসএ প্রেসিডেন্ট রিহান রিচার্ডস যা বলেছেন, তাও ইসিবির মতোই, ‘আমরা মনে করি, (এ ব্যাপারে) আইসিসির সব সদস্যের কাছ থেকে আরও একীভূত ও সম্মিলিত পদ্ধতির অনুসরণ আরও বেশি কার্যকর হবে। সিএসএ আফগানিস্তানে নারী ক্রিকেটকে সমর্থন করে এবং দেশটিতে অর্থপূর্ণ পরিবর্তন হয়, এমন একটি সমাধান খুঁজে পেতে আইসিসি ও অপরাপর সদস্যদের সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনা চালিয়ে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
আইসিসি কী করতে পারে?
নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে আফগানিস্তান ম্যাচ বয়কটে আইসিসির সমর্থন থাকার সম্ভাবনা কার্যত শূন্য। প্রথমত, টুর্নামেন্ট খুব কাছে, এক মাস সময় বাকি। এমনিতেই ভারতের পাকিস্তান সফরে না যেতে চাওয়া নিয়ে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি বড় জটিলতায় পড়েছিল। এখন আরেকটি জটিলতা তৈরির অর্থ নেই। দ্বিতীয়ত, আইসিসি কখনো একটি দলের বিপক্ষে ম্যাচ বয়কট সমর্থন করে না। ২০০৩ বিশ্বকাপের সময় যেমন করেনি, ১৯৯৬ বিশ্বকাপেও (শ্রীলঙ্কায় যায়নি অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ) করেনি।
এখন আফগানিস্তান বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিলেও সেটি হবে সময় নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে। এখানে নেতৃত্বের ব্যাপার আছে। আইসিসির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে জয় শাহ, যিনি কিছুদিন আগেও ভারতের ক্রিকেট বোর্ড বিসিসিআইয়ের সচিব ছিলেন। জয় শাহ শুধু ক্রিকেট প্রশাসকই নন, রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিও। তাঁর বাবা অমিত শাহ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ভারত সরকার এখন পর্যন্ত তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি না দিলেও দেশটির পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি গত বুধবার আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মৌলভী আমির খান মুত্তাকীর সঙ্গে দুবাইয়ে বৈঠক করেন, যা তালেবান সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক উন্নয়নের ইঙ্গিত দেয়। আর আফগানিস্তানের ক্রিকেট উন্নয়নে ভারতের যথেষ্ট সহায়তাও ছিল অতীতে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মন্তব্য প্রতিবেদনে ভেঙ্কটা কৃষ্ণা লিখেছেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সমীকরণ বলছে, আফগানিস্তানকে নিষেধাজ্ঞায় ভারত ও আইসিসি চেয়ারম্যান জয় শাহ সমর্থন দেবেন না।