টি-টোয়েন্টি ব্যাটিং: বাংলাদেশ নারী দলের যেখানে দরকার অনেক উন্নতি
অস্ট্রেলিয়া সিরিজ থেকেই বাংলাদেশ নারী দলের ব্যাটিংয়ের টপ অর্ডারের ব্যর্থতা ছিল আলোচনায়। ভারতের বিপক্ষে টপ অর্ডারে একটু উন্নতি হলেও সেই ১২০ রানের চক্রেই ঘুরপাক খাচ্ছে দল। মাঝের ওভারগুলোয় দ্রুত উইকেট হারিয়ে যে চাপ চলে আসছে, সেটি থেকে বেরিয়ে ১৪০-১৫০ রানের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না নিগার সুলতানার দল।
বোলাররা লড়াইয়ের চেষ্টা করছেন বটে, কিন্তু যথেষ্ট পুঁজি তাঁদের এনে দিতে পারছেন না ব্যাটাররা। দলের পক্ষ থেকেও এ নিয়ে হতাশা আর উদ্বেগের কথাও শোনা যাচ্ছে। সিরিজের তৃতীয় ম্যাচের পর দলের প্রতিনিধি হয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসা রাবেয়া খান যেমন ভারতের সঙ্গে নিজেদের পার্থক্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তারা ফ্রি খেলতে পারছে। আমরা পারছি না।’ সেটা না পারার কারণ হিসেবে দ্রুত উইকেট পড়ে যাওয়ার চাপের কথাই বলা হচ্ছে।
উইকেট পড়ে গেলে মোমেন্টাম নষ্ট বা ছন্দপতন হয় ঠিকই; তবে ১২০ বলের ম্যাচে উইকেট হারানোর সে ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া উচিত দ্রুতই। সেখানেই আসে সামর্থ্যের প্রশ্ন। পুরুষ দল বা নারী দল—এমনিতে টি-টোয়েন্টি ঠিক বাংলাদেশের পছন্দের সংস্করণ নয়। পাওয়ার হিটিং বলুন বা বাউন্ডারি মারার সামর্থ্য—অন্য দলগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ নারী দল বেশ পিছিয়ে। দলের পারফরম্যান্সে যা প্রভাব ফেলছে সরাসরি।
২০২৩ সালের শুরু থেকে আইসিসির পূর্ণ সদস্যদেশগুলো আগে ব্যাটিং করে যেসব ম্যাচ জিতেছে, সেখানে গড় স্কোর ১৪৫ রানের মতো। তবে বাংলাদেশ প্রায়ই পুড়ছে আরও ২০-৩০টি রান বেশি করতে না পারার আফসোসে।
ওভারপ্রতি রান তোলার কথাই যেমন ধরুন। ২০২৩ সালের শুরু থেকে বাংলাদেশ ২৪টি টি-টোয়েন্টি খেলে প্রতি ওভারে তুলেছে ৫.৪১ রান। এ সময়ে কমপক্ষে ১০টি ম্যাচ খেলেছে, এমন দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২৬ নম্বরে। এখানে তাদের ওপরে আছে এবারই প্রথম বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব খেলতে আসা ভানুয়াতুর মতো দলও।
স্বাভাবিকভাবেই সহযোগী দেশগুলোর প্রতিপক্ষের বোলিং আক্রমণ বিবেচনায় আনতে হবে। তবে আইসিসির পূর্ণ সদস্যদেশগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশই সবচেয়ে পিছিয়ে।
টি-টোয়েন্টিতে রান তুলতে বাউন্ডারি বড় একটা পার্থক্য গড়ে। ২০২৩ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ছক্কা মেরেছে ১৭টি, আইসিসির পূর্ণ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে তাদের চেয়ে পিছিয়ে শুধু নিউজিল্যান্ড। মেয়েদের ক্রিকেটে ছক্কার সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই পুরুষদের তুলনায় কম। কিন্তু চার মারার দিক থেকেও বাংলাদেশ পিছিয়ে।
একই সময়ে বাংলাদেশ আইসিসির পূর্ণ সদস্যদেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম ২০৪টি চার মেরেছে, শীর্ষে থাকা অস্ট্রেলিয়া যেখানে মেরেছে এক ম্যাচ কম খেলেই ৪০৪টি চার। এ সিরিজে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ভারত ২৫ ম্যাচে মেরেছে ৩২৭টি চার।
ফলে ব্যাটারদের গড় স্ট্রাইক রেটেও বাংলাদেশ সবচেয়ে পিছিয়ে। এ সময়ে বাংলাদেশ ব্যাটারদের গড় স্ট্রাইক রেট মাত্র ৮২.০৭। এ মুহূর্তে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে খেলা শ্রীলঙ্কা-আয়ারল্যান্ডের ব্যাটাররাও যেখানে এ সময়ে ১০০-এর ওপর গড় স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করেছেন।
বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ব্যাটিংয়ের দুর্দশার ক্ষেত্রে দেশের মাটিতে উইকেটের ধরনের প্রসঙ্গ প্রায়ই সামনে চলে আসে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়া সিরিজে মিরপুরের উইকেটগুলোও ছিল বেশ ব্যাটিং সহায়ক, যেটি বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধি হয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসা ব্যক্তিরাও স্বীকার করেছেন। একই অবস্থা সিলেটে ভারতের বিপক্ষে সিরিজেও।
স্বাভাবিকভাবেই খেলোয়াড়দের শারীরিক গঠন, বেড়ে ওঠার সঙ্গে টি-টোয়েন্টির পাওয়ার ব্যাটিংয়ের একটা সম্পর্ক আছে। বিসিবির পক্ষ থেকে সেদিকে নজর দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। গত বছর জাতীয় দলের প্রধান ফিজিক্যাল পারফরম্যান্স কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ইয়ান ডুরান্টকে।
এর আগে ইংল্যান্ড নারী জাতীয় দলের হয়ে প্রায় ১০ বছর কাজ করেছেন ডুরান্ট। স্ট্রেংথ অ্যান্ড কন্ডিশনিং নিয়ে কাজ করা এ কোচের লক্ষ্য বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়দের আরও শক্তিশালী করে তোলা, যেটি তাঁদের আরও ভালো অ্যাথলেট হিসেবে গড়ে তুলে সহায়তা করবে ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিংয়েও।
ব্যাটিংয়ের ক্ষেত্রে তাঁর কাজের ধরন কী হবে, সম্প্রতি বিসিবিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ডুরান্ট সেটি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, ‘আমরা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠার লক্ষ্যে জিমে কাজ করছি। আমার কাজ হচ্ছে তাদের মানদণ্ড ঠিক করে দেওয়া, চ্যালেঞ্জ জানানো। তারা ভালোভাবে সাড়া দিয়েছে। পরের কথা হচ্ছে, ব্যাটাররা কীভাবে ব্যাকফুট থেকে ফ্রন্টফুটে ওয়েট ট্রান্সফার করছে, এরপর কীভাবে ব্যাটের মাঝে বল লাগাচ্ছে। যাতে হাত থেকে শক্তি আসে। এর পরের দিকটি হচ্ছে টাইমিং ও সমন্বয়ের অনুশীলন। প্রথমটি একেবারে নিখাদ শক্তির ব্যাপার। দুটি এরপর দারুণভাবে মিলে যাবে।’
ডুরান্ট আসার পর থেকে নিজেদের মানসিকতা বদলের ব্যাপারটি টের পাচ্ছেন দলের সিনিয়র ব্যাটার ও ওপেনার মুর্শিদা খাতুন। তাঁর মতে, ‘আগে আমি স্কোয়াট (একধরনের ব্যায়াম) করতাম ৪০ কেজি দিয়ে, এখন ৬০ কেজি দিয়ে করি। সে ভারসাম্য নিয়ে কাজ করায়, এমনকি মানসিকতা নিয়েও। আগে যেমন শট খেলতে গেলে একটু দ্বিধা কাজ করত, আমি ছক্কা মারতে পারব কি না। (বলটা বাউন্ডারি পর্যন্ত) যাবে কি যাবে না। এখন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মেরে দিতে পারি।’
গত মে মাসে জাতীয় দলের সঙ্গে যোগ দেওয়া ডুরান্টের কাজ যে এখনো বেশ বাকি, সেটি বলাই যায়। আগামী অক্টোবরে দেশের মাটিতে হতে যাওয়া বিশ্বকাপে ভালো কিছু করতে গেলে দলের ব্যাটিংয়ের যে বেশ ভালো একটা উন্নতি দরকার, সেটি নিশ্চিতই।
আজ প্রকাশিত সূচিতে বাংলাদেশ আছে দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দলের সঙ্গে একই গ্রুপে। ২০২৩ সালের পর থেকে ওভারপ্রতি রানের দিক দিয়ে শীর্ষে থাকা অস্ট্রেলিয়ার (৮.১৯) পরই আছে ইংল্যান্ড (৮.১২) ও দক্ষিণ আফ্রিকা (৭.২৪)। সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজও বাংলাদেশের চেয়ে ভালোই এগিয়ে (৬.৩৫)।
অবশ্য বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়েরা ডুরান্টের কাজে বেশ সাড়া দিচ্ছেন বলেই জানিয়েছেন তিনি। বিশ্বকাপের ব্যাপারটি ভাবনায় আছে তাঁরও, ‘আমি প্রায় ১০ বছর ইংল্যান্ডে নারী জাতীয় দলের হয়ে কাজ করেছি। আমি তাদের শারীরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী হতে সহায়তা করেছি। এখানে প্রায় এক বছর আছি। চার–পাঁচ মাস বাকি আছে বিশ্বকাপে। দ্রুত এগোতে হবে। আমাদের “ইমপ্যাক্ট পারফরম্যান্স” দরকার।’
বিশ্বকাপে ভালো কিছু করার আশা মুর্শিদারও, ‘আমরা বাঙালি, ভাত খেতে পছন্দ করি। (ডুরান্ট) বলেছে শর্করা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে রাখতে। আমিষ বেশি খেতে বলছে। সামনে এশিয়া কাপ আছে। উন্নতির চেষ্টা করব। (এরপর) বিশ্বকাপ যেহেতু নিজেদের দেশে, চেষ্টা করব দেশবাসীকে সেরা খেলাটা উপহার দিতে।’