আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আম্পায়ারের জীবন বড় নিঃসঙ্গ। ক্রিকেটারদের চেয়েও বেশি। ক্রিকেটাররা তা–ও তো বড় একটা দলের অংশ হয়ে থাকেন। আম্পায়ারদের দলটা তো একেবারেই ছোট। ম্যাচ রেফারিকে যোগ করলেও চার–পাঁচজনের বেশি নয়। এঁদের সবার সঙ্গে সবার খাতির থাকবে, এটা ভাবাও ঠিক নয়। বাইরের কারোর সঙ্গে মেশার আগেও ১০০ বার ভাবতে হয়। লোকটা আবার ফিক্সিং–টিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত নয় তো! আম্পায়ারদের মাঠের বাইরে তাই নিজেদের একটু গুটিয়েই রাখতে হয়।
আন্তর্জাতিক আম্পায়ারের জীবন মানেই তাই নিঃসঙ্গতা। আন্তর্জাতিক আম্পায়ারের জীবন মানে দিনের পর দিন পরিবার থেকে দূরে থাকা। বছরে কত দিন?
রুডি কোয়ের্তজেনকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতেন, ‘২২০ থেকে ২৫০ দিন।’
২০১০ সালে অবসর নেওয়ার পর হেসে বলেছিলেন, ‘এবার উল্টোটা হবে। বছরে ২২০ থেকে ২৫০ দিন আমি পরিবারের সঙ্গে কাটাব।’
প্রায় দেড় যুগ পরিবার–বিচ্ছিন্ন থাকার পর পরিবারের সঙ্গে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু যত দিন বাইরে–বাইরে ছিলেন, তত দিন আর পরিবারের সঙ্গে থাকা হলো না কোয়ের্তজেনের। গাড়ি দুর্ঘটনা অকস্মাৎ শেষ করে দিল তাঁর জীবন।
যখন অবসর নিয়েছিলেন, সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচে আম্পায়ারিং করার রেকর্ড ছিল তাঁর। প্রায় এক যুগ পরও তাঁকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছেন মাত্রই একজন। ১০৮টি টেস্ট ম্যাচে আম্পায়ারিং করেছেন, ২০৯টি ওয়ানডেতে। বিশ্বকাপ ফাইনাল করেছেন, ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়ায় আইসিসি সুপার সিরিজও। ২০০২ সালে নির্বাচিত হয়েছিলেন বিশ্বের সেরা আম্পায়ার। এসব বলার কারণ একটাই। সংখ্যা দিয়েই যা বোঝা যায়, সেটির পক্ষে আরেকটু জোরালো যুক্তি দেওয়া। আম্পায়ার হিসেবে রুডি কোয়ের্তজেন ছিলেন বিশ্বসেরাদের একজন।
মাঠে, মাঠের বাইরে, বিমানবন্দরে, বিমানে, হোটেলে...অসংখ্যবার দেখা হয়েছে রুডি কোয়ের্তজেনের সঙ্গে। ২০০৭ ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপের সময় বারবাডোজ বিমানবন্দরেই বোধ হয় কথাটা বলেছিলাম তাঁকে। ওয়ান টাইম কাপে কফিতে চুমুক দিতে দিতে কী একটা নিয়ে মজা করছিলেন। আমি বললাম, ‘মাঠে আপনাকে দেখলে তো আপনার নামের সার্থকতা প্রমাণিত হয়। এখন তো দেখছি, আপনি মানুষটা অন্য রকম।’
কোয়ের্তজেন কৌতূহলমাখা দৃষ্টি নিয়ে জিজ্ঞাসাসূচক ভুরু নাচালেন। ব্যাখ্যা করে আমি বললাম, ‘আপনার নামের প্রথম অংশ “রুডি”। মাঠে দেখলে আপনাকে খুব “রুড” মনে হয়। মনে হয়, সব সময় রেগে আছেন। অথচ এখন তো দেখছি আপনি খুব মজার মানুষ।’
আমার কথা শুনে কোয়ের্তজেনও মজাই পেয়েছেন মনে হলো। নইলে কি আর হাসতেন! মুখে হাসি নিয়েই বলেছিলেন, ‘মাঠে অমন একটা মুখোশ পরে থাকতে হয়। নইলে ক্রিকেটাররা পাত্তা দেবে নাকি!’ বলেই দুষ্টুমি করে চোখ টিপেছিলেন।
রুডি কোয়ের্তজেনের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে কালো দাগটাও লেগেছিল ওই ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপেই। অস্ট্রেলিয়া–শ্রীলঙ্কা ফাইনাল। শেষ ৩ ওভারে ৬৩ রান দরকার, উইকেটে শ্রীলঙ্কার দুই পেসার লাসিথ মালিঙ্গা ও চামিন্ডা ভাস। অস্ট্রেলিয়ার জয় নিয়ে কোনো সংশয়ই নেই। তার চেয়েও বড় কথা, কেনসিংটন ওভালে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। স্টেডিয়ামের পাশের স্ট্রিট লাইট জ্বলে গেছে। প্রেসবক্স থেকে বলই দেখতে পারছি না।
তখন আলোর স্বল্পতায় খেলা বন্ধ হবে কি হবে না, এই সিদ্ধান্তে ব্যাটসম্যানদের মতামতের ভূমিকা ছিল। মাঠের দুই আম্পায়ার আলিম দার ও স্টিভ বাকনর তাই মালিঙ্গা ও ভাসের কাছে জানতে চাইলেন, তাঁরা খেলা চালিয়ে যেতে চান কি না। বল দেখতেই সমস্যা হচ্ছে, তার ওপর জয়ের কোনো আশাই নেই। মালিঙ্গা–ভাস তাই পরাজয় মেনে নিলেন। শুরু হয়ে গেল অস্ট্রেলিয়ার টানা তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়ের উন্মাতাল উৎসব। এর মধ্যেই মাঠে নেমে এলেন চতুর্থ আম্পায়ার বিলি বাউডেন। সেই ফাইনালে রুডি কোয়ের্তজেন টিভি আম্পায়ার। তিনিও এসেছিলেন কি না, ঠিক মনে করতে পারছি না।
মাঠে নেমে আসা একটা বার্তা নিয়ে—খেলা শেষ করতে বাকি ৩ ওভার হতেই হবে। অস্ট্রেলিয়ার জয়োৎসবের মধ্যে ঢুকে আলিম দার যখন রিকি পন্টিংকে তা জানালেন, পন্টিং যত না অবাক, তার চেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ। প্রেসবক্স থেকে আমরা অবশ্য এর কিছুই বুঝতে পারছি না। পরে জেনেছি, আম্পায়াররা বলেছেন, প্রয়োজনে এই ৩ ওভার পরদিন হবে। কিন্তু অর্থহীন এই ৩ ওভার খেলতে আরেক দিন মাঠে আসা! কোনো দলই তাতে রাজি নয়। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো, ম্যাচ আজই শেষ হবে। পন্টিং শুধুই স্পিনারদের দিয়ে বোলিং করাবেন, এই শর্তে খেলতে রাজি হলেন মাহেলা জয়াবর্ধনে। অস্ট্রেলিয়ান স্পিনাররা প্রায় হেঁটে হেঁটে এসে বল করছেন আর শ্রীলঙ্কানরা কোনোমতে তা ঠেকানোর চেষ্টা করছেন। বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো ম্যাচে এমন হাস্যকর দৃশ্য দেখা যাবে, এটা কারও কল্পনাতেও ছিল না।
এখনো ভাবতে বিস্ময় লাগে, ডাকওয়ার্থ–লুইস মেথডে দ্বিতীয় ইনিংসের কমপক্ষে ২০ ওভার হলেও যে খেলার মীমাংসা হয়ে যায়, রুডি কোয়ের্তজেন তা কীভাবে ভুলে গিয়েছিলেন? আলিম দার–বাকনরের মতো মাঠের অভিজ্ঞ দুই আম্পায়ারই–বা এই ভুলে সায় দিলেন কীভাবে? এমনই কেলেঙ্কারি যে ম্যাচ শেষে দুই অধিনায়কের আগে ম্যাচ রেফারি জেফ ক্রোকে ব্যাখ্যা দিতে চলে আসতে হলো সংবাদ সম্মেলনে। কোয়ের্তজেনকে অবশ্য বড় মূল্যই দিয়ে হয়েছিল এ জন্য। মাস কয়েক পরে প্রথম টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিষিদ্ধ হয়ে থাকলেন তিনি।
আম্পায়াররা ভুল করবেনই। কোয়ের্তজেনও করেছেন। তবে সেই ভুল স্বীকার করতে তাঁর মধ্যে কোনো ইগো কাজ করেনি কখনো। ২০০৭ সালে হোবার্টে কুমার সাঙ্গাকারাকে ভুল করে আউট দিয়ে দিলেন। বল সাঙ্গাকারার কাঁধ ছুঁয়ে হেলমেটে লেগে স্লিপে গিয়েছিল। কোয়ের্তজেন ভেবেছিলেন, গ্লাভসে লেগেছে বল। পরে টিভিতে দেখার পর নিজের ভুল বুঝতে পেরে ‘স্যরি’ বলেছেন সাঙ্গাকারাকে। এটা এত বেশি বিজ্ঞাপিত হতো না, যদি সাঙ্গাকারা তখন ১৯২ রানে না থাকতেন। আর ৮ রান হলেই যে টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ডটি শুধুই ডন ব্র্যাডম্যানের থাকত না।
এসব কারণেই কি মনে রাখবেন রুডি কোয়ের্তজেনকে? অন্যায় হবে। ভালো কারণেও তো খবর হয়েছেন কতবার। ১৯৯৯ সালে সিঙ্গাপুরে ভারত–ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোকাকোলা কাপ ফাইনালের আগে বাজিকরেরা বিপুল অঙ্কের অর্থের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল তাঁর কাছে। কোয়ের্তজেন তা ফাঁস করে দেওয়ার পর তুমুল হইচই।
আপিলে সাড়া দিতে অনেক সময় নিতেন বলে তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল ‘স্লো ডেথ’। দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যান ড্যারিল কালিনান একবার কোয়ের্তজেনের কাছে অনুযোগও করেছিলেন—মারবেন ঠিক আছে, কিন্তু এমন যন্ত্রণা দিয়ে মারবেন কেন?
আপিলে আঙুল তোলায় আম্পায়ারের ‘অনন্তকাল’নেওয়ার কথা বললে প্রথমেই মনে পড়ে স্টিভ বাকনরের কথা। কোয়ের্তজেন অবশ্য তাঁকে অনুসরণ করে অমন করতেন না। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন এর পেছনের গল্পটা। আম্পায়ারিংয়ের শুরুর দিকে দুই হাত শরীরের সামনে রাখতেন। স্ত্রীর আবার তা পছন্দ ছিল না। কোয়ের্তজেন তাই হাত শরীরের পেছনে রাখতে শুরু করেন। তারপর দেখেন, হাত ওখানে স্থির থাকে না। কখনো শরীরের পাশে চলে আসে, কখনো সামনে। সমাধান হিসেবে দুই হাত আঙুলে বেঁধে রাখতে শুরু করেন। আউট দেওয়ার সময় তা ছাড়াতে গিয়েই নাকি অমন দেরি হতো। এর মধ্যে নাটকীয়তা তৈরির কোনো সচেতন চেষ্টা ছিল না। আম্পায়ারিং ছাড়ার পর আত্মজীবনীমূলক যে বইটা লিখেছেন, সেটির নামও ‘স্লো ডেথ’।
রুডি কোয়ের্তজেনের নিজের জীবনে অবশ্য এর উল্টোটাই হলো।