পাকিস্তান ক্রিকেটের বড় সমস্যা: রাজনীতি, পক্ষপাত, ক্রিকেট–অজ্ঞতা
সর্বশেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপ ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ—দুটি টুর্নামেন্টেই প্রথম পর্ব থেকে বিদায় নেয় পাকিস্তান ক্রিকেট দল। দলটি এ বছর এখন পর্যন্ত জিতেছে মাত্র একটি সিরিজ; সেটাও শক্তি-সামর্থ্য-র্যাঙ্কিংয়ে তাদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে থাকা আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে।
জুনে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পর নিজেদের মাঠে বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছিল পাকিস্তান। কিন্তু দেশটির ক্রিকেটে সুদিন ফেরা দূরে থাক, বাংলাদেশের বিপক্ষে ২-০ ব্যবধানে ধবলধোলাই হয়েছে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাবর আজম-শাহিন আফ্রিদিদের সাম্প্রতিক শোচনীয় পারফরম্যান্সের কারণ হিসেবে পাকিস্তানের খেলাধুলায় রাজনৈতিক প্রভাবকে দায়ী করা হচ্ছে। বিশেষ করে ক্রিকেটে সাফল্যের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হিসেবে স্বজনপ্রীতিকে দেখা যাচ্ছে, যা এরই মধ্যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
গত সপ্তাহে বাংলাদেশের কাছে সিরিজ হারের পর টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ের আটে নেমে গেছে পাকিস্তান, যা ১৯৬৫ সালের পর তাদের সর্বনিম্ন অবস্থান। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ২০২৩-২০২৫ চক্রের পয়েন্ট তালিকাতেও আটে নেমে গেছে দলটি। পাকিস্তানের জন্য ঘরের মাঠও যেন পরের মাঠ হয়ে উঠেছে। নিজেদের মাটিতে সর্বশেষ ১০ টেস্ট জয়হীন থাকা সে কথাই বলছে।
বর্তমানে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মহসিন রাজা নাকভি, যিনি একই সঙ্গে দ্বিতীয়বারের মতো পূর্ণকালীন মেয়াদে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করছেন। দেশটি সব সময় জঙ্গি হামলার শঙ্কায় থাকে। ফলে নাকভিকে বেশির ভাগ সময় মন্ত্রণালয় সামলানোর কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। ক্রিকেট সংগঠক হিসেবেও তাঁর কোনো নাকডাক ছিল না।
পিসিবির চেয়ারম্যান পদটাও যেন সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী চাকরিগুলোর একটি হয়ে উঠেছে। পূর্ণকালীন ও অন্তর্বর্তীকালীন মিলিয়ে নাকভি গত ২২ মাসের মধ্যে বোর্ডের পঞ্চম চেয়ারম্যান!
শুধু বোর্ডের শীর্ষ পদেই নয়; মাঠেও অনেক রদবদল এসেছে। গত দুই বছরে পাকিস্তান দলে ৪ জন প্রধান কোচ, ৩ জন অধিনায়ক দেখা গেছে। ঘরোয়া ক্রিকেটের বিভিন্ন সংস্করণেও অনেক বদল এসেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রাজনীতিবিদদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই পাকিস্তান ক্রিকেটে এমন অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। যেটার সরাসরি প্রভাব পড়েছে খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সে।
পিসিবির সাবেক মিডিয়া ম্যানেজার ও ক্রিকেটবিষয়ক সাংবাদিক আহসান ইফতিখার নাগি বার্তা সংস্থা এএফপি বলেন, ‘এটা (রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ) দলের পারফরম্যান্সে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে। বোর্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা ও দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা থাকলে তা মাঠের পারফরম্যান্সকে প্রতিফলিত করবেই।’
সাংবাদিক নাজাম শেঠি তিন দফা পিসিবির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর মতে, এটি কর্মভারহীন পদে পরিণত হয়েছে এবং কারও পরিচয়কে চাকচিক্যভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্যই করা হয়েছে, ‘সেনানায়ক, বিচারক ও আমলাদের শুধুমাত্র খেলার প্রতি ভালোবাসা থেকে (পিসিবির চেয়ারম্যান হিসেবে) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। খেলা সম্পর্কে তাঁদের কোনো জ্ঞান নেই। আবার অনেক ক্ষেত্রে (সাবেক) ক্রিকেটারদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা নেই।’
বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে পাকিস্তান সর্বশেষ বড় সাফল্য পেয়েছে ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে। সে বছর ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতে হারিয়ে শিরোপা জেতে পাকিস্তান। এরপর আইসিসি আয়োজিত আসরে তাদের সেরা সাফল্য হয়ে আছে ২০২২ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে রানার্সআপ হওয়া। দলটি নিজেদের মাটিতে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির পর আর কোনো টেস্ট জিততে পারেনি।
বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে পাকিস্তান ধবলধোলাই হওয়ার পর থেকে পিসিবি চেয়ারম্যান মহসিন নাকভি ও তাঁর নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদের বোর্ড ব্যবস্থাপনা নীতি নিয়ে সমালোচনা চলছে। দেশটির সংসদ ও সংবাদমাধ্যমে তাঁকে পদত্যাগের আহ্বানও জানানো হয়েছে।
পাকিস্তানের দৈনিক এক্সপ্রেস ট্রিবিউন লিখেছে, ‘১৯৯৮ সাল থেকে পাকিস্তানে যত শাসক এসেছেন, সবাই তাঁদের বাছাই করা ও পছন্দের ব্যক্তিকে পিসিবির চেয়ারম্যান পদে বসিয়েছেন যেন তাঁরা নিজেদের মতো করে খেলাটি চালাতে পারেন। ক্রিকেটকে ধ্বংস করার জন্যই এমনটা করা হয়েছে। পদে বসার পর তাঁরা আসলে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁদের প্রাথমিক লক্ষ্য থাকে পদ আঁকড়ে ধরে থাকা এবং দেশের ক্রিকেটের ক্ষতি করে মোটা অঙ্কের অর্থ উপার্জন করা।’
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে নাকভির দ্বৈত দায়িত্ব (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পিসিবি চেয়ারম্যান) নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সংবাদ চ্যানেল এআরওয়াইকে সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের ঘনিষ্ঠ সহযোগী রানা সানাউল্লাহ খান। নাকভির পক্ষে সমর্থন কমে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে রানা সানাউল্লাহ বলেছেন, ‘দুটি দায়িত্বই তাঁকে পূর্ণকালীন মেয়াদে পালন করতে হচ্ছে। এরপরও তিনি চালিয়ে যাবেন কি না, সিদ্ধান্ত তাঁর।’
পাকিস্তানের বর্তমান জনসংখ্যা ২৪ কোটির বেশি। দেশটিতে ক্রিকেটই সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা এবং এই খেলাই তাদের সমাজের সব বিভাজন দূর করে। সেখানে ক্রিকেটারদের জাতীয় বীর মনে করা হয়, নামীদামি ব্র্যান্ড তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করে। যেদিন বড় ম্যাচ থাকে, সেদিন পথঘাট একদম ফাঁকা হয়ে যায়।
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে অনেক সাফল্য পেয়েছেন। ইমরানের নেতৃত্বেই ১৯৯২ সালে বিশ্বকাপ জেতে পাকিস্তান। খেলোয়াড়ি জীবনে পাওয়া ঈর্ষণীয় সাফল্যের পর তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ইমরান। সেই তাঁকেই সর্বশেষ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে তিনি কারাবন্দী।
বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তান টেস্ট সিরিজে ধবলধোলাই হওয়ার পর কারাগার থেকেই বিবৃতি দিয়েছেন ৭১ বছর বয়সী ইমরান খান। বিবৃতিতে তিনি দাবি করেন, তাঁকে আটকে রাখা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ এবং একই কারণে দেশটির ক্রিকেটও এমন দুরবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ন্যায্য কথা বলতে তাঁকে বাধা দেওয়া হচ্ছে বলেও দাবি করেন ইমরান।
বিবৃতিতে ইমরান বলেন, ‘একটি জাতি তখনই ধ্বংস হয়, যখন অযোগ্য ও দুর্নীতিগ্রস্ত লোকদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসানো হয়। ক্রিকেটের মতো একটি কৌশলগত খেলাতেও (বোর্ডে) পছন্দের লোককে শীর্ষ পদে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। মহসিন নাকভির যোগ্যতা কী?’
ইমরান খান এ ধরনের বিবৃতি দিলেও তাঁর সময়েও পিসিবিতে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছিল। ইমরানের ইচ্ছাতেই তাঁর সাবেক সতীর্থ রমিজ রাজাকে বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয়েছিল। এ ছাড়া ঘরোয়া ক্রিকেটেও তিনি হস্তক্ষেপ করেছিলেন।
মোট কথা, স্বজনপ্রীতি, পক্ষপাতিত্ব ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাকিস্তানে একটি রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইমরান খান নির্বাচনের দুর্নীতিবিরোধী প্রচারাভিযানে নেমেছিলেন। এরপর শক্তিশালী সামরিক সংস্থার সহায়তায় ক্ষমতায় এসেছিলেন।