এই ম্যাচটা হেরে গেলে আমাদের ক্রিকেটের জন্য খুব খারাপ হতো
এই ম্যাচটার গুরুত্ব কত, সেটা নিয়ে গতকালই লিখেছিলাম। শুধু বিশ্বকাপে টিকে থাকার জন্য নয়, বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভাবমূর্তির জন্য আজ জিম্বাবুয়েকে হারাতেই হতো। মান রক্ষার ব্যাপার তো ছিলই, বিশ্বকাপে টিকে থাকারও ম্যাচ ছিল এটি।
এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা ম্যাচে সাকিব আল হাসানের কাছেই চাওয়াটা বেশি ছিল। তার ওপর ভরসা করেই ভেবেছিলাম, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ভরাডুবির পরও বাংলাদেশ দল ভালো করবে, ঘুরে দাঁড়াবে। শ্বাসরোধী ম্যাচ হলেও শেষ পর্যন্ত সেটাই হয়েছে।
শেষ বলে যখন ৫ রান দরকার, তখন একটা গল্প মনে পড়ছিল। ২০০৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় এক ত্রিদেশীয় সিরিজের ঘটনা। ভারত ও বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের একটা ম্যাচ ঠিক একই সমীকরণে এসে ঠেকে। শেষ বলে ছক্কা মেরে সেই ম্যাচটা জিতেছিল ভারত। আজ সেটাই মনে পড়ছিল। কিন্তু মোসাদ্দেক স্নায়ুর চাপটা সামলেছে দারুণভাবে। ভালো জায়গায় বল করেছে। মুজারাবানি স্টাম্পড হলো।
এরপর যা হলো, সেটা তো চরম নাটকীয়তা। তখন ওই নো বলটার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। তখন মনে হচ্ছিল, আমরা হয়তো হেরেই যাব। শেষ বলে ৪ রান—এটা তো হয়ে যেতেই পারে। জোরে মারতে গেলে ব্যাটের কানায় লেগে থার্ডম্যান দিয়ে বল বেরিয়ে যেতে পারে। মোসাদ্দেকের কৃতিত্ব, সে চাপটা ভালো সামলেছে।
এতে বাংলাদেশ দলের দারুণ একটা অভিজ্ঞতাও হলো। চাপের মুখে হাল না ছাড়লে যে ভালো ফল আসে, সেই অভিজ্ঞতা। দলের সবাই আত্মবিশ্বাসী ছিল। এটা নিশ্চয়ই তাদের আরও সাহসী করবে।
কিন্তু এই ম্যাচটা যদি আমরা হেরে যেতাম, সেটা অনেকেই নিতে পারত না। এটা আমাদের ক্রিকেটকে অনেক পিছিয়ে দিত। সবারই হৃদয় ভেঙে দিত। খেলোয়াড়, বিসিবি, দর্শক—সবার। ভাগ্য ভালো, সেটা হয়নি।
আজ আমরা অনেক রান করেছি, তা না। কিন্তু আমাদের ব্যাটিংয়ে একটা কাঠামো ছিল। শুরুতে একটা জুটি করতে পেরেছি, যেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমরা যেমনটা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই হয়েছে।
১০ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে ৬৫ রান করেছে। যা পরে আমাদের ১৫০ রানে যেতে সাহায্য করেছে। প্রথম ১০ ওভারের এই ভিত্তিটা এ ক্ষেত্রে কাজে দিয়েছে। হ্যাঁ, আমরা ১০-১৫ রান কম করেছি। যে কারণে ম্যাচটা এত ক্লোজ হয়েছে। আমাদের পঞ্চম বোলার হিসেবে মোসাদ্দেককে ব্যবহার করতে হয়েছে। যেটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। সেদিক থেকে ভাগ্য ভালো, আমরা ১৫০ রান করেও চারজন বিশেষজ্ঞ বোলার নিয়ে উতরে গিয়েছি।
এ ক্ষেত্রে অনেকে হয়তো সাকিবের সমালোচনা করছেন। মোসাদ্দেককে শেষ ওভারে বোলিং করানোর ঝুঁকি কেন নেওয়া হলো, এ আলোচনা হচ্ছে দেখলাম। ব্যক্তিগতভাবে আমার দল নির্বাচনটা ভালো লাগেনি।
আমি মনে করি, পাঁচজন বিশেষজ্ঞ বোলার নিয়ে খেলতে নামা উচিত। তবে আজ যে বোলিং শক্তি ছিল, তাতে সাকিব অন্য কিছু করলে ভালো হতো না।
সাকিব তার মূল বোলারদের আগে বোলিং করিয়েছে, কম রান দিয়ে উইকেট নেওয়ার চেষ্টা করেছে। চেষ্টা করেছে, শেষে যেন যথেষ্ট রান হাতে থাকে। এটা সাহসী সিদ্ধান্ত। আর তার ভাবনা একদম পরিষ্কার ছিল। ম্যাচ শেষে শুনলাম, ১৬তম ওভারেই মোসাদ্দেককে শেষ ওভারে বোলিং করার কথা জানিয়ে দিয়েছিল সাকিব।
সাকিব যে পরিকল্পনা ছাড়া কিছু করে না, সেটার প্রমাণ এটা। সব সিদ্ধান্ত হয়তো কাজে দেয় না। কিন্তু এর মানে এই নয় যে সেই সিদ্ধান্তের পেছনে কোনো যুক্তি থাকে না। মোসাদ্দেককে আগে থেকেই বলে দেওয়াটা সেদিক থেকে দারুণ সিদ্ধান্ত ছিল।
সাকিবের আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। সাকিব কিন্তু শেষ ওভারটা নিজে করেনি। সে নিজের বোলিং নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। সে জন্যই হয়তো মোসাদ্দেককে বোলিং দিয়েছে। মোসাদ্দেকও তার ওপর অধিনায়কের আস্থার প্রতিদান দিয়েছে। তার জন্যও কিন্তু কাজটা সহজ ছিল না। কারণ, এমন মুহূর্তে সে এর আগে কখনো বোলিং করেনি। এই স্নায়ুর চাপ সামলে নেওয়া চাট্টিখানি কথা না।
আজকের ম্যাচে যে কজন ভালো করেছে, তাদের মধ্যে দুজনকে নিয়ে সম্প্রতি তুমুল আলোচনা হয়েছে। একজন নাজমুল, আরেক মোস্তাফিজ। এই দুজন ভালো না করলে বাংলাদেশ অনেক আগেই ম্যাচ থেকে হারিয়ে যেত।
নাজমুলের স্ট্রাইক রেট নিয়ে অনেকে হয়তো কথা বলছে। কিন্তু আমি মনে করি, আজ দলের জন্য এটাই দরকার ছিল। আমরা এই বিশ্বকাপে অন্য দলের টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদেরও দেখেছি এভাবে ব্যাটিং করতে। তার ইনিংসের সৌজন্যেই আমরা শুরুতে উইকেট হারাইনি। পরে সে ঠিকই স্ট্রাইক রেটটাকে বাড়িয়ে নিয়েছে ব্র্যাড ইভান্সের এক ওভারেই।
এরপর আফিফ ক্রিজে এসেই দ্রুত রান করেছে। যা সেটা নিয়মিতই করছে। আজকের ম্যাচে এই ছোট ছোট অবদান কাজে দিয়েছে। তবে মোসাদ্দেকের শেষে ব্যাটে–বলে না হওয়ায় ১০-১২ রান কম হয়েছে।
সেটা অবশ্য অনুভূত হতে দিচ্ছে না তাসকিন। প্রতি ম্যাচেই সে নতুন বলে উইকেট এনে দিচ্ছে। মোস্তাফিজ ও তাসকিনের বোলিংয়ে ম্যাচের প্রথম ১২ ওভারে দাপট দেখিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু এরপর ওরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তখন মনে হচ্ছিল উইলিয়ামস ও বার্ল ম্যাচ বের করে ফেলবে।
কারণ, এমন অবস্থা থেকে আমরা প্রচুর ম্যাচ হেরেছি। আজ সেটা হয়নি। দলের সবাই জেতার জন্য খেলছে বলেই সেটা হয়নি। প্রত্যেকে ক্রিকেট মাঠে যা করছে, দলের জয়ের কথা চিন্তা করে করছে। সবার নিজের পারফরম্যান্সকে ম্যাচের ফলাফলের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করছে। ব্যাটিংয়ে না হলেও বোলিংয়ে অন্তত সেটা হচ্ছে।
সাকিবের সেই রানআউটের কথা না বললেই নয়। সাকিবের বয়স ৩৬-৩৭। ফিটনেসের দিক থেকে সে তার সেরা সময় পেছনে ফেলে এসেছে। আজ যেটা করেছে, সেটা ভালো করার অবিশ্বাস্য ইচ্ছাশক্তি না থাকলে সম্ভব না। সেটাই ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট। উইলিয়ামস ওই মুহূর্তে আউট হওয়ার কারণে মোসাদ্দেক শেষ ওভারে জিম্বাবুয়ের বোলারদের বোলিং করতে পেরেছে।
আজকের জয় বাংলাদেশ দলকে সামনের দুটি ম্যাচে চাপমুক্ত হয়ে খেলতে সাহায্য করবে। সাকিবরা এখন পর্যন্ত অনেক চাপে ছিল। কে জানে, চাপমুক্ত হয়ে খেললে হয়তো আরও ভালো করবে বাংলাদেশ!