‘মানুষ যুদ্ধে নামলে গুলি খাইতে হয়’—চোটের ভয় নিয়ে নাহিদ রানা

রংপুর রাইডার্সের ফাস্ট বোলার নাহিদ রানাছবি: শামসুল হক

পূর্বসূরিদের দিকে তাকালে একটু কি শঙ্কিত হন নাহিদ রানা? বয়সটা যদিও শঙ্কিত হওয়ার নয়, মাত্র ২২ বছর। শুধুই সামনে তাকানোর সময় বলতে পারেন। এই বয়সে তারকাখ্যাতি পেয়ে যাচ্ছেন, বল হাতে তাঁর গতির ঝড় রোমাঞ্চিত করছে ক্রিকেটপ্রেমীদের। শঙ্কাটাও এখানেই, কোনো দিন না আবার গতিটাই বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে তাঁর দিকে!  

বিশ্ব ক্রিকেটে এ রকম পেসার খুব কমই আছেন, যাঁদের চোট–আঘাতে পড়তে হয়নি। চোটে অনেকের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে, কেউ ছন্দ হারিয়েছেন, কেউ আবার সুস্থ শরীরে খেলা চালিয়ে যেতে নিজ বোলিংয়ের অনেক অলংকার ঝেড়ে ফেলেছেন।

বেশি দূরে দৃষ্টি ফেলার দরকার নেই। রানা যদি বাংলাদেশের ক্রিকেটের দিকেই তাকান...মাশরাফি বিন মুর্তজা, তাসকিন আহমেদ, ইবাদত হোসেন, শরীফুল ইসলামের নামগুলো সামনে আসবে।

প্রত্যেকেরই আবির্ভাব গতির ঝড় তুলে এবং প্রত্যেককেই হোঁচট খেতে হয়েছে চোট–আঘাতের গর্তে। তাসকিন–ইবাদতের লম্বা সময় মাঠের বাইরে থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছে। দুই হাঁটুতে সাতবার অস্ত্রোপচারের ধকলে মাশরাফির টেস্ট ক্যারিয়ার তো অকালেই শেষ হয়ে গেল!

চোটের কারণে তাসকিন ও ইবাদতকে লম্বা সময় মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছে
ছবি: ফেসবুক

২০২২–২৩ মৌসুমে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক রানার। গত বছরের মার্চে টেস্ট অভিষেক। তার মানে জাতীয় দলে আসার এখনো এক বছরও পুরো হয়নি। ৬ টেস্ট আর ৩ ওয়ানডের ক্যারিয়ার মাত্র। আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টিতেও অবশ্য তাঁকে নামিয়ে দেখার ইচ্ছা আছে কোচ ফিল সিমন্সের। তবে এখন পর্যন্ত রানার টি–টোয়েন্টি বলতে বিপিএল।

এবারের বিপিএলে রানা পাঁচ ম্যাচে ৯ উইকেট নিয়েছেন। আজ সিলেটে ঢাকা ক্যাপিটালসের বিপক্ষে ২১ রানে ৩ উইকেট পেয়ে হলেন ম্যাচসেরা। ম্যাচ–পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তাঁর উৎফুল্লতার মধ্যেও একটা বিনয়ী ভাব লক্ষ করা গেল, যেটা রানার স্বভাবজাত। তবে এই তরুণকেই আবার চরম দুঃসাহসী মনে হলো চোট–আঘাতের ভয় দেখানো এক প্রশ্নে।

প্রশ্নটা ছিল পেস বোলার মানেই তো চোটের শঙ্কা। তিনি কীভাবে সেই চোট এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন? বিসিবির পাশাপাশি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটেও দলের কাছ থেকে সেই সেবা পান তো? নাহিদের উত্তরের প্রথমাংশ, ‘প্রথমে যেটা বললেন যে ইনজুরি। ধরেন, মানুষ যুদ্ধে নামলে গুলি খাইতে হয়। ক্রিকেট খেলতে আসলে ইনজুরিতে পড়বই।’

একজন ফাস্ট বোলারের এটুকু সাহস না থাকলে তিনি আর ফাস্ট বোলার কেন! ঘণ্টায় ১৪৮–১৪৯ কিমি যার বলের নিয়মিত গতি, বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে যিনি কিনা ১৫০ কিমির ওপর গতি তুলে উইকেটটাকে অনেকবারই এক্সপ্রেসওয়ে বানিয়েছেন, ঠুকঠুকে বোলিং তিনি করবেন না, এটাই স্বাভাবিক। গতির সীমা পেরিয়ে যাওয়াটাই বরং এমন বোলারদের নেশা হয়ে থাকে।

নাহিদ রানা নিয়মিত ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার গতিতে বল করছেন
ছবি: প্রথম আলো

সমস্যা হলো জাতীয় দলে আসার পর নাহিদ রানা যে রকম ম্যাচ খেলছেন, সে রকম আগে খেলেননি। না, কয়টা ম্যাচ খেললেন সে হিসাব মেলানোর দরকার নেই। টেস্ট, ওয়ানডে মিলিয়ে ৯টি ম্যাচ এমন কিছু নয়। আর ঘরোয়া ক্রিকেটে তো খেলবেনই। বলা হচ্ছে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটে যে চাপটা নিতে হয়, সেটির কথা। তা–ও একজন ফাস্ট বোলার হিসেবে।

আরও পড়ুন

ক্রিকেট ম্যাচ একজন স্পিনার বা একজন ব্যাটসম্যানের তুলনায় একজন পেসারের শরীরকেই দ্রুত ক্লান্ত করে তোলে। অল্প সময়ে অনেক বেশি চাপ নিতে হয় পেসারদেরই। শরীরের নির্দিষ্ট জায়গায় বারবার বেশি চাপ নেওয়া, সেটাও পেসারদের ঘাড়েই। রানার মতো লম্বা রানআপের গতিময় বোলারদের ভয় থাকে ত্রুটিপূর্ণ ল্যান্ডিং আর ফলোথ্রুতে শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারানোরও। লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়া, সাইডস্ট্রেইন, পিঠ বা কাঁধের চোট—এসবের সঙ্গে তাই তাদেরই পরিচয় ঘটে বারবার।

মোটকথা একজন ফাস্ট বোলারের রানআপের শুরু থেকে বল ডেলিভারি দেওয়া পর্যন্ত পথটাকে আপাতদৃষ্টিতে যত সরলই মনে হোক না কেন, আসলে তা নয়। সেই পথের অনেক বাঁক, বাঁকে বাঁকে দুর্ঘটনার শঙ্কা।

সঙ্গে আছে খেলার চাপ। সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটে একজন বোলারের প্রতিটি বলই নিখুঁত করার চেষ্টা থাকে। একটা বল একটু খারাপ হলে পরেরটা যেন আরও বেশি নিখুঁত হয়। প্রতি মুহূর্তে প্রতিপক্ষ এবং নিজের সঙ্গেও চ্যালেঞ্জ জয়ের লড়াই। সেই চাপ নিতে গিয়ে ক্লান্তি আসাটা স্বাভাবিক। আজকের কথাই ধরুন। ৯ দিনের মধ‍্যে ৫ ম‍্যাচ খেলার ধকলের কারণেই হয়তো অন‍্য ম‍্যাচের তুলনায় তাঁর বোলিংয়ে গতি কম ছিল। ১৪০ কিমি এর ওপর ডেলিভারি ছিল হাতে গোনা। কিছু বল ছিল ১৩৫ কিমি এর কম গতিরও।

বিপিএলের ৯ দিনের মধ্যে ৫ ম্যাচ খেলেছেন নাহিদ রানা
ছবি: রংপুর রাইডার্স

সমস্যা হলো অন্য অনেক ক্রিকেটারের মতো নাহিদ রানা সর্বোচ্চ বয়সভিত্তিক পর্যায়ে খুব বেশি খেলেননি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের এই ক্রিকেটার বিসিবির রাডারে প্রথম আসেন অনূর্ধ্ব–১৮ পর্যায়ে রাজশাহী বিভাগীয় দলে সুযোগ পেয়ে। বয়সভিত্তিক পর্যায় থেকেই রানার বলের প্রাণ গতি, কিন্তু শুরুর দিকে লাইন–লেংথে বেশ গড়বড় ছিল। যে কারণে জায়গা পাননি ২০২২ সালের যুব বিশ্বকাপ দলে। পেরে ওঠেননি রিপন মণ্ডল, আশিকুজ্জামান, মুশফিক হাসানদের সঙ্গে দৌড়ে। ওই পর্যায়ে তাই খুব বেশি প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলতে পারেননি, খেললেও বেশি চাপ নিতে হয়নি।

আবার গতি আছে বলেই জাতীয় দলে আসার প্রতিযোগিতায় রানা ছাড়িয়ে যান সবাইকে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের কোচদের সহায়তায় লাইন–লেংথে উন্নতি এসেছে এখন। বোলিংয়ের পুরোনো দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে ‘রানা এক্সপ্রেস’ বাংলাদেশের ফাস্ট বোলিং শক্তিকে দেখাতে শুরু করেছেন আরও সম্পদশালী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা। সে কারণেই তাঁকে নিয়ে বাড়তি সতর্কতার প্রয়োজন।

আরও পড়ুন

‘গুলি’ খেতে ভয় না পাওয়া নাহিদ রানা অবশ্য বলেছেন, এই সতর্কতা তাঁর মধ্যে আছে, ‘যেটা মেইনটেইনের কথা বলছিলেন...ফিটনেস, এগুলো সব নিজে মেইনটেইন করছি। আর বিসিবি যেসব শিডিউল দিয়েছে, ওগুলো মেনে কাজ করার চেষ্টা করছি।’

ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ খেলে আসার পর বিশ্রাম পেয়েছেন রানা। বিপিএলে রংপুর রাইডার্সের হয়ে খেলছেন। এখানে যেমন ফিজিও–ট্রেনারদের পরামর্শ পাচ্ছেন, একই সঙ্গে ফিটনেসের ব্যাপারে জাতীয় দলের ফিজিও–ট্রেনারের সঙ্গেও যোগাযোগ রেখে চলেছেন।

বিপিএলের জন্য ফিটনেস ট্রেনিং এবং ম্যাচ খেলার পরিকল্পনা করে দিয়েছে বিসিবি। তাঁর ওপর চোখও রাখা হচ্ছে জাতীয় দল থেকে। রানাই বলেন, ‘বিসিবি বলছে এখন পর্যন্ত আমার বোলিং ঠিক আছে এবং আমিও অনুভব করছি যে শরীর ঠিক আছে।’

ঢাকা ক্যাপিটালসের বিপক্ষে আজ ম্যাচসেরা হয়েছেন নাহিদ রানা
ছবি: প্রথম আলো

যুদ্ধে নামলে গুলি খেতে হবে জানা কথা। সে জন্যই গুলি সহ্য করার জন্য শরীরটাকে প্রস্তুত রাখতে হয়। রানার মতো গতি–যোদ্ধাদের মূল মন্ত্রই হওয়া উচিত—সুস্থ শরীর, জোরে বোলিং।