অস্ট্রেলিয়া–দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচের ভাগ্য গড়বে যে ৫ লড়াই
মুম্বাইয়ে নিউজিল্যান্ডকে গতকাল ৭০ রানে হারিয়ে বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠেছে ভারত। রোহিত শর্মার দল এখন তাদের শেষ প্রতিপক্ষের অপেক্ষায়। আগামী রোববার আহমেদাবাদের ফাইনালে স্বাগতিকদের প্রতিপক্ষ হতে আজ লড়বে অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা। কলকাতার ইডেন গার্ডেনে দ্বিতীয় সেমিফাইনাল শুরু বেলা ২টা ৩০ মিনিটে।
রেকর্ড পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে আছে ইতিহাস। এ নিয়ে সবচেয়ে বেশি নবমবার সেমিফাইনাল খেলতে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ানরা। ২০১৯ সালে সবশেষ বিশ্বকাপ ছাড়া প্রতিবারই তারা শেষ চারের বাধা টপকাতে পেরেছে।
বিপরীতে দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল হয়ে আছে চিরন্তন দুঃখ। চারবার শেষ চারে উঠলেও একবারও শিরোপার মঞ্চে যেতে পারেনি। ওই চার সেমিফাইনালের মধ্যে দুটি ছিল আবার অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে।
১৯৯৯ সালের সেমিফাইনাল বিশ্বকাপ তো বটেই, ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ম্যাচ হয়ে আছে। বার্মিংহামের এজবাস্টনে অস্ট্রেলিয়ার করা ২১৩ রান তাড়া করতে নেমে দক্ষিণ আফ্রিকাও থেমেছিল ২১৩ রানে। ২ বল বাকি থাকতে ল্যান্স ক্লুজনারের পাগলাটে এক দৌড়ে রানআউট হন বাংলাদেশের সদ্য সাবেক পেস বোলিং কোচ অ্যালান ডোনাল্ড। ম্যাচটি টাই হলেও সুপার সিক্সে মুখোমুখি লড়াইয়ে জেতায় ফাইনালে উঠেছিল অস্ট্রেলিয়া।
২০০৭ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালেও মুখোমুখি হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা। সে ম্যাচে রিকি পন্টিং-গ্লেন ম্যাকগ্রাদের কাছে পাত্তাই পাননি গ্রায়েম স্মিথ-জ্যাক ক্যালিসরা।
বড় ম্যাচগুলোয় স্নায়ুচাপ ধরে রাখতে পারে না বলে দক্ষিণ আফ্রিকার নামটাই হয়ে গেছে ‘চোকার’। সেই তকমা থেকে বেরোতে চাইলে আজ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ‘হতাশাজনক ইতিহাস’কেও হারাতে হবে। প্রথমবার ফাইনালে উঠতে হলে আরও পাঁচ লড়াইয়ে প্রোটিয়াদের জিততে হবে।
এনগিডি বনাম ওয়ার্নার
লুঙ্গি এনগিডির বলে ডেভিড ওয়ার্নারের রেকর্ড খুব একটা সুবিধার নয়। মুখোমুখি ছয় লড়াইয়ে চারবার অস্ট্রেলিয়ান ওপেনারকে আউট করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকান পেসার। চারবারই কাভার অঞ্চলে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেছেন। এনগিডি-জুজু থেকে বেরোতে এবার তাঁর বলে আক্রমণাত্মক খেলতে পারেন ওয়ার্নার, তবে এনগিডির বাউন্সার ও বৈচিত্র্যময় বোলিংয়ের সঙ্গে টেক্কা দেওয়া সহজ হবে না। তবে দলীয় সমন্বয়ের স্বার্থে এনগিডিকে একাদশে না–ও দেখা যেতে পারে। প্রোটিয়ারা যদি দ্বিতীয় স্পিনার হিসেবে কেশব মহারাজের সঙ্গে তাব্রেইজ শামসিকেও খেলায় এবং চমক দেখানো জেরাল্ড কোয়েৎজিও (৭ ম্যাচে ১৮ উইকেট নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকান বোলারদের মধ্যে উইকেটশিকারে শীর্ষে) জায়গা ধরে রাখেন, তাহলে এনগিডিকে এই ম্যাচে দর্শক হয়ে থাকতে হতে পারে।
ডি কক বনাম হ্যাজলউড
অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের মধ্যে ওয়ানডেতে কুইন্টন ডি কককে সবচেয়ে বেশি সাতবার আউট করেছেন জশ হ্যাজলউড। প্রতিবারই ভিন্ন পরিকল্পনায় বোলিং করে ডি কককে উইকেট দিতে বাধ্য করেছেন। তবে প্রতিবারই একটা বিষয় ছিল ‘কমন’—হ্যাজলউডের নিখুঁত লাইন-লেংথ। অফ স্টাম্পের একটু বাইরে বল ফেলে ডি কককে বেশ কয়েকবার বিচলিত করেছেন হ্যাজলউড। ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগ দিয়ে পিকআপ শট খেলতে প্ররোচিত করেও উইকেট নিয়েছেন, তবে মিডউইকেট অঞ্চল দিয়ে ডি কক ঠিকই তাঁর অন্যতম প্রিয় শট খেলে রান পেয়েছেন। আজ ডি ককের বিপক্ষে হ্যাজলউড কোন কৌশল অবলম্বন করেন, সেটার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে।
মহারাজ বনাম ম্যাক্সওয়েল
সেমিফাইনালের আগে সুখবর পেয়েছেন কেশব মহারাজ। ভারতের মোহাম্মদ সিরাজকে সরিয়ে ওয়ানডে বোলারদের র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে উঠে এসেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার এই বাঁহাতি স্পিনার। সংবাদ সম্মেলনে প্রোটিয়া কোচ রব ওয়াল্টার মহারাজকে বলেছেন শিল্পী। মহারাজকে নিয়ে ওয়াল্টার কেন এ কথা বলেছেন, সেটা এবারের বিশ্বকাপে তাঁর পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এখন পর্যন্ত ১৪ উইকেট নিয়েছেন তিনি। মাঝের ওভারগুলোয় প্রতিপক্ষের রানের গতি শ্লথ করতেও বড় অবদান রেখেছেন। যখনই দরকার পড়েছে, ব্রেক থ্রু এনে দিয়েছেন। এর চেয়েও বড় ব্যাপার তাঁর ইকোনমি রেট। এবারের বিশ্বকাপে কমপক্ষে ৫০ ওভার বোলিং করেছেন, এমন বোলারদের মধ্যে ভারতের কুলদীপ যাদবের (৪.৩২) পরই মহারাজের ইকোনমি রেট সবচেয়ে কম (৪.৩৭)। আফগানিস্তানের বিপক্ষে অতিমানবীয় ইনিংস খেলে অস্ট্রেলিয়াকে সেমিফাইনালে তোলা গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকেও এবারের বিশ্বকাপে আউট করেছেন মহারাজ। লক্ষ্ণৌতে হওয়া প্রথম পর্বের সেই ম্যাচে মহারাজের ৮ বল থেকে মাত্র ১ রান নিতে পেরেছিলেন ম্যাক্সওয়েল। আজও ম্যাক্সওয়েলকে নিশ্চয়ই দ্রুত ফেরাতে চাইবেন মহারাজ।
ক্লাসেন/ মিলার বনাম জাম্পা
টুর্নামেন্টে স্পিনারদের মধ্যে অ্যাডাম জাম্পার উইকেট সবচেয়ে বেশি (২২টি), তবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার এই লেগ স্পিনারের রেকর্ড ভালো নয়। প্রোটিয়াদের বিপক্ষে ওয়ানডেতে ১৭ ম্যাচে ১৯ উইকেট নিয়েছেন ৪৬.৭৮ বোলিং গড়ে। ইকোনমি রেটও বেশি ৬.০৯। সাম্প্রতিক সময়ে হাইনরিখ ক্লাসেন-ডেভিড মিলারদের সামনেই বেশি ভুগেছেন। লক্ষ্ণৌতে দুই দলের সবশেষ দেখায় ১০ ওভারে দিয়েছেন ৭০ রান। বিশ্বকাপ শুরুর কয়েক দিন আগে দ্বিপক্ষীয় সিরিজের একটি ম্যাচে দিয়েছিলেন ১১৩; যা কিছুদিনের জন্য ওয়ানডে ইতিহাসের সবচেয়ে খরচে বোলিংয়ের বিব্রতকর রেকর্ড হয়েছিল। ওপরের দিকের ব্যাটসম্যানরা ভালো শুরু এনে দিতে পারলে মিলার ও ক্লাসেন আজও জাম্পার ওপর চড়াও হতে পারেন। ইডেন গার্ডেনের বাউন্ডারি ছোট হওয়ায় মিলার-ক্লাসেনের মিস হিটগুলোও ছক্কা হয়ে যেতে পারে। তবে ইডেনের উইকেট স্পিনারদের সহায়তা করে থাকলে জাম্পা হতে পারেন বড় হুমকি। ক্লাসেনকে তিনবার আউট করার সুখস্মৃতিও আছে তাঁর।
দুই দলের ডেথ বোলিং
এবারের বিশ্বকাপে দুই দলই ডেথ বোলিং নিয়ে বেশ ভুগেছে। অস্ট্রেলিয়ার সমস্যাটা শুরু হয়েছে আরও আগে, সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকেই। প্রোটিয়াদের বিপক্ষে সবশেষ ওয়ানডে সিরিজের ৩ ম্যাচেরই শেষ ১০ ওভারে ‘বেদম মার’ খেয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান বোলাররা। ম্যাচ ৩টিতে শেষ ১০ ওভারে রান দিয়েছেন যথাক্রমে ৯৬, ১৭৩ ও ১১৩! এমনকি মুম্বাইয়ে আফগানিস্তানও শেষ পাঁচ ওভারে তুলেছিল ৬১ রান। যদিও লক্ষ্ণৌতে দুই দলের সবশেষ দেখায় শেষ দিকে দারুণ বোলিং করেছেন মিচেল স্টার্ক-প্যাট কামিন্সরা। ওই ম্যাচে শেষ ১০ ওভারে তাঁরা দিয়েছিলেন ৭৩ রান। ডেথ বোলিংয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার সমস্যাটা আবার অন্য জায়গায়। প্রোটিয়া বোলাররা শেষ ১০ ওভারে স্টাম্প টু স্টাম্প বল খুব কমই করতে পেরেছেন। বেশির ভাগ সময়ই ওয়াইড–ইয়র্কার দিতে চেয়েছেন। সেটা করতে গিয়ে উইকেট তো পানইনি, উল্টো কখনো ফুলটস আবার কখনো অফ স্টাম্পের অনেক বাইরে দিয়ে ওয়াইড দিয়ে বসেছেন। অতিরিক্ত রান মানেই অতিরিক্ত বোলিং। ওভারে সেই বাড়তি বল করতে গিয়ে খেয়েছেন বাউন্ডারি। ফাইনালে উঠতে গেলে এই ভুল শোধরাতেই হবে প্রোটিয়া বোলারদের।