গ্লেন ম্যাক্সওয়েল: গলফ কার্ট দুর্ঘটনা, বিশ্বকাপের অবিশ্বাস্য ইনিংস ও টেস্ট-স্বপ্নের কথা

ম্যাক্সওয়েলের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে গত এক মাস কেটেছে স্বপ্নের মতোরয়টার্স

বিশ্বকাপ জয়ের অভিযান শেষে ভারতের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে দুটি ম্যাচ খেলে দেশে ফেরেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। যেদিন অস্ট্রেলিয়ায় ফিরেছেন, তার পরদিন সকালে ঢুঁ মেরেছিলেন স্থানীয় এক কফি শপে। কাউন্টারে বিল দিতে গিয়ে শুনলেন অন্য একজন তাঁর কফির টাকাটা দিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি একটি খুদে বার্তা রেখে গেছেন। সেটি ম্যাক্সওয়েলকে শুনিয়ে দিলেন কফি দোকানি, ‘অস্ট্রেলিয়ার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ।’

কথাটা শুনে ম্যাক্সওয়েলের মুখে হাসি আর ধরে না! বিশ্বকাপ এবং টি-টোয়েন্টি সিরিজে দুটি অবিশ্বাস্য ইনিংসের পর এখন হয়তো অস্ট্রেলিয়ার অনেকেই ম্যাক্সওয়েলের কফির বিল দিয়ে দিতে চাইবেন। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৬–এ নেমে পায়ে ক্র্যাম্প নিয়ে ২০১ রানের ম্যাচ জেতানো সেই মহাকাব্যিক ইনিংস—শুধু বিশ্বকাপ নয়, ওয়ানডে ইতিহাসেই যা অন্যতম সেরা ইনিংস। ম্যাক্সওয়েলের সেই অতিমানবীয় ইনিংসে সেমিফাইনাল নিশ্চিত হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার। পরে বিশ্বকাপও জিতল। এরপর ভারতের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে ৪৮ বলে অপরাজিত ১০৪—অনেকের মতে এটাও টি-টোয়েন্টির অন্যতম সেরা ইনিংস।

শুধু কি তা–ই, প্রয়োজনের সময়ে নিয়ন্ত্রিত বোলিং এবং দুর্দান্ত ফিল্ডিংয়েও অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ জয়ে দারুণ অবদান রেখেছেন ম্যাক্সওয়েল। অথচ এই খেলোয়াড়কে দেখে কে বলবে, গত বছর পা ভেঙে নেওয়ার পর পুরোপুরি ঠিক না হওয়ায় তা নিয়েই মাঠে নামতে হচ্ছে, লড়তে হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যম ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’–এর সঙ্গে আলাপচারিতায় ম্যাক্সওয়েল নিজের লড়াই, বিশ্বকাপে গলফ কার্ট থেকে পড়ে গিয়ে পাওয়া চোট এবং তারপর পাওয়া বিশ্রাম কাজে লাগানো—এসব নিয়ে কথা বলেছেন। শুধু তা–ই নয়, কথা বলেছেন টেস্ট খেলার আশা নিয়েও। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সাতটি টেস্ট খেলা ম্যাক্সওয়েল ২০২৫ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজকে পাখির চোখ করেছেন।

প্যাট কামিন্স যেভাবে বিশ্বকাপে সতীর্থদের কাছ থেকে সেরাটা নিংড়ে নিয়েছেন, অধিনায়ক হিসেবে কামিন্স নিজেও কৌশলগত যেসব জায়গায় বুদ্ধিমত্তা দেখিয়েছেন, সেসব নিয়েও কথা বলেছেন ম্যাক্সওয়েল। ৩৫ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার জানিয়েছেন, অবসর–পরবর্তী জীবন নিয়ে তাঁর ভাবনা নেই। অন্তত আর্থিক দিক বিবেচনায়। কারণটা সবারই জানা। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট। বিগ ব্যাশের দল মেলবোর্ন স্টারসে সতীর্থরা যেন ভালো পারিশ্রমিক পান, তা নিশ্চিতে ম্যাক্সওয়েল নিজে তাঁর নামের প্রতি সুবিচার করার মতো পারিশ্রমিক নেন না। একই কারণে আইপিএল দল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুতেও প্রায় পাঁচ লাখ ডলার পারিশ্রমিক কম নিয়েছেন।

আরও পড়ুন

ম্যাক্সওয়েল এসব ব্যাপারই বুঝিয়ে বললেন, ‘আমি ১০-১২ বছর মিলিয়ে খুবই ভাগ্যবান। কারণ, আইপিএল আমার ভালো পরিচর্যা করেছে, আমাকে আর্থিকভাবে এমন অবস্থানে নিয়ে গেছে, ক্রিকেট ছাড়ার পর আমাকে সম্ভবত কাজ করা নিয়ে ভাবতে হবে না।’ তাঁর যুক্তি, ‘এটা মানসিকভাবে খুব স্বস্তির যে অন্য কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি লিগে খেলতে হবে না। সময়টা অন্য কাজে লাগানো যায়।’

বিশ্বকাপে ম্যাক্সওয়েল ছিলেন দারুণ ছন্দে
রয়টার্স

২০১৭ সালে চট্টগ্রামে বাংলাদেশের বিপক্ষে সর্বশেষ টেস্ট খেলেছিলেন ম্যাক্সওয়েল। গত বছর শ্রীলঙ্কা সফরে অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট দলে আরেকটু হলেও জায়গা পেয়ে যেতেন। তবে ম্যাক্সওয়েল অস্ট্রেলিয়ায় এখনো টেস্ট খেলার সুযোগ পাননি। ৭ টেস্টের মধ্যে একটি আবুধাবিতে, বাকি ৬টি টেস্টই খেলেছেন উপমহাদেশে। টেস্ট খেলার আশায় থাকা ম্যাক্সওয়েল এ নিয়ে শোনালেন অপেক্ষার কথা, ‘এটা পরিষ্কার যে আমি উপমহাদেশের কন্ডিশনে ভালো খেলি, যেটা ২০১৩ সালে প্রথম সফর থেকেই হচ্ছে। গত বছর শ্রীলঙ্কা সফরে থাকার অর্থ হলো তারা (নির্বাচকেরা) এখনো এই সংস্করণে আমাকে বিবেচনায় রেখেছেন। সেটা লাল বলে ১ ম্যাচ খেলি আর ৩০ ম্যাচ খেলি, আমি এখনো বিবেচনায় আছি। সে জন্যই ২০২৫ শ্রীলঙ্কা সফর নিয়ে আশায় আছি, টেস্ট খেলার আশা ছাড়তে চাই না।’

আরও পড়ুন

ক্রিকেটের পাশাপাশি গলফ খেলতেও পছন্দ করেন ম্যাক্সওয়েল। বিশ্বকাপে আহমেদাবাদের একটি গলফ কোর্সে সতীর্থদের নিয়ে খেলতে গিয়েছিলেন। এক রাউন্ড খেলার পর গলফ কার্টে চড়ে ক্লাব হাউস থেকে টিম বাসের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। এ সময় হঠাৎ ভারসাম্য হারিয়ে চলন্ত কার্টের পেছন দিক থেকে পড়ে গেলে মাথায় আঘাত পান ম্যাক্সওয়েল। কনকাশন প্রটোকলে সাত দিন বিশ্রাম নিতে হয়েছে। তাতে ম্যাক্সওয়েলের আঘাত পাওয়া পা-টাও পেয়েছে বিশ্রাম।

গত দুই বছরের মধ্যে একাধিকবার দুর্ঘটনায় পড়েছেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল
রয়টার্স

সেদিনের ঘটনা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ান তারকা বলেছেন, ‘কী ঘটেছে—সবাই জানে। মাথায় আঘাত পাওয়ার কিছু স্মৃতি হারিয়েছি। ব্যাপারটা অদ্ভুত। ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করেও কিছু মনে করতে পারিনি। যতটুকু মনে আছে, সেটা ছিল দিনের ঘটনা এবং আমি দিনের খেলা নিয়ে কিছু বলছিলাম।’ এরপরের ঘটনা মনে নেই ম্যাক্সওয়েলের। যেটুকু মনে আছে সেটুকু তাঁর মুখেই শুনুন, ‘পরে যেটুকু মনে আছে—বাসে মাথাটা ধরে বসে ছিলাম। নিজের জীবন থেকে কিছু স্মৃতি হারানোর ব্যাপার একটু ভীতিকরই। চিকিৎসক এবং ফিজিওর কাছ থেকে খণ্ড খণ্ড অংশ শুনেছি। তাঁরা অন্য কার্টে প্রায় ৮০ মিটার পেছনে ছিলেন। তাঁরাই সবার আগে ছুটে এসে আমাকে জানান কী ঘটেছে। এটা ছিল খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আমি যেটা বলতে পারি, এর চেয়ে যে খারাপ কিছু হয়নি সেটা আমার সৌভাগ্য।’

আরও পড়ুন

সেই দুর্ঘটনায় ম্যাক্সওয়েলের মাথার পেছনের অংশে একটু কেটে যায়। হোটেলে ফিরে মেডিকেল স্টাফদের দিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন। ম্যাক্সওয়েল জানিয়েছেন, তখন মেডিকেল স্টাফ তাঁকে ‘কিছু প্রশ্ন করেন কিন্তু তাতে মন বসাতে পারিনি।’ ম্যাক্সওয়েলের মুখেই পুরোটা শুনুন, ‘ঘটনাটা নিয়ে আমি আবেগহীন হয়ে পড়েছিলাম। কারণ, কিছু মনে করতে পারিনি। এটা মনে হয়নি যে বড় কিছু হয়েছে। কারণ, ঠিক কী ঘটেছিল আমার মনে নেই। নিজেকে কিছুটা অসহায়ই মনে হয়েছিল। তবে ঘটনাটা মনে সেভাবে দাগ কাটেনি। সেটা সম্ভবত কনকাশনের (মাথায় আঘাত) পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। চিকিৎসকও সেটাই ধারণা করেন।’

মাথায় আঘাতজনিত বিশ্রাম থেকে উঠে আফগানিস্তানের মুখোমুখি হয়েছিলেন ম্যাক্সওয়েল। সে ম্যাচে ডান পায়ে ক্র্যাম্প (পেশিতে টান) নিয়েও অবিশ্বাস্য ইনিংসে জিতিয়েছিলেন দলকে। তা নিয়ে এই তারকা বললেন, ‘আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে (দুর্ঘটনা) এ নিয়ে তেমন ভাবিনি। বিশ্বকাপের ছন্দে ফেরার চেষ্টা করেছি। নেদারল্যান্ডস ম্যাচে যেখানে থেমেছিলাম, সেখান থেকে শুরুর চেষ্টা করেছি, মিডল অর্ডারে যেটা সবচেয়ে ভালো পারি, সেটাই করার চেষ্টা করেছি।’

আরও পড়ুন

আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে অধিনায়ক প্যাট কামিন্সের সঙ্গে ১৭০ বলে অবিচ্ছিন্ন ২০২ রানের জুটি গড়েছিলেন ম্যাক্সওয়েল। এই জুটিতে কামিন্সের অবদান ৬৮ বলে ১২। ম্যাক্সওয়েল জানিয়েছেন, কামিন্স তাঁকে মজা করে ওই ইনিংস নিয়ে খোঁচাও মেরেছেন, ‘সে রসিকতা করে বলেছে, তার স্ট্রাইক রেট চিরকালের জন্য খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু সত্যিটা হলো পরিসংখ্যান আপনাকে অর্ধেকটা বলবে। কিন্তু আমার চোখে এটা অন্যতম সেরা ইনিংস। গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস, যেটা দলের বাকিদের (মানসিকতা) দেখিয়ে দিয়েছে “আমি মনস্থির করেছি যে দলের জন্য (উইকেট) কামড়ে পড়ে থাকব।’

কামিন্সের প্রশংসা করে ম্যাক্সওয়েল আরও বলেছেন, ‘প্যাট সাধারণত ওভাবে ব্যাট করে না। সে বল মারতে পছন্দ করে। বিভিন্ন সময়ে সেটা করেও দেখিয়েছে। কিন্তু নিজের এই ইচ্ছাকে দূরে সরিয়ে এভাবে ভাবা “আমি লেগে থাকব”—আমি সে জন্য চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব এবং টুর্নামেন্টজুড়ে সে যত ত্যাগ স্বীকার করেছে, সেটা দলের জন্য এবং আমার জন্য। সে এমন একজন, যাঁর সঙ্গে আপনি খেলতে চাইবেন, সে জিতুক এটা চাইবেন।’

বিশ্বকাপে দ্রুততম শতকের রেকর্ড গড়েন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল
রয়টার্স

ম্যাক্সওয়েল বিশ্বকাপ জয়ের পর বিশেষ একটি মুহূর্ত নিয়েও কথা বলেছেন। বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে সতীর্থদের সঙ্গে উদ্‌যাপনের আগে মঞ্চে ভারতের প্রেসিডেন্ট নরেন্দ্র মোদির জন্য অপেক্ষা করছিলেন কামিন্স। বিষয়টি ম্যাক্সওয়েল কীভাবে দেখেন, সেটি তাঁর মুখেই শুনুন, ‘ম্যাচ–পরবর্তী অনুষ্ঠানের ভিডিওগুলো দেখা ছিল মজার। মোদির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সে মঞ্চেই দাঁড়িয়ে ছিল। প্রায় ১০ মিনিটের মতো। ট্রফি হাতে নিয়ে দলের বাকিদের আসার অপেক্ষায় ছিল।’ ম্যাক্সওয়েল এরপর ব্যাখ্যা করেন, ‘সে (কামিন্স) আসলে ব্যাপারটি খুব ভালোভাবে সামলেছে। খুব বেশি উদ্‌যাপন করেনি, নাচেওনি। সবাই কিন্তু তার মতো এভাবে পরিস্থিতি সামলাতে পারত না।’

আরও পড়ুন

ম্যাক্সওয়েল কামিন্সকেই বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার সেরা খেলোয়াড় বলে মনে করেন, ‘পরিসংখ্যান হয়তো তা বলবে না। কিন্তু সে আমাদের টুর্নামেন্টসেরা খেলোয়াড়। সেটা (বিশ্বকাপের) বিভিন্ন পর্যায়ে সে যে প্রভাবটা রেখেছে, সে জন্য। জুটিগুলো দেখুন, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে যে প্রভাবটা...দরকারের সময় উইকেট এনে দিতে পারে।’

অধিনায়কের প্রশংসায় ম্যাক্সওয়েল এখানেই থামেননি, ‘এসব ছোটখাটো ব্যাপার যখন পেছন ফিরে তাকিয়ে ভাবি, অসাধারণ লাগে। গোটা টুর্নামেন্টে সে কতটা ভালো ছিল, সে জন্য প্রাপ্য প্রশংসাটা সে পেয়েছে বলে আমার মনে হয় না। বিষয়টি শুধু ব্যাটিং-বোলিং নিয়ে নয়। এগুলো অনেকগুলো ব্যাপারের সম্মিলন, যেখানে সে অবদান রেখেছে। এগুলো নিয়ে ভাবলেই মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।’

ম্যাক্সওয়েলের মুখের এই হাসি সম্ভবত আরও কিছুদিন থাকবে।