কলকাতার ট্রেন থেকে ওয়াংখেড়ের সেমিফাইনালে শামি
মোহাম্মদ শামি তখন ১৬ বছরের কিশোর। বিরাট সব দুঃসাহস উঁকি দেওয়ার সেই বয়সে (২০০৬ সাল) কলকাতার ট্রেন ধরেছিলেন শামি। লক্ষ্য? ক্রিকেটার হবেন। কিন্তু সে লক্ষ্যের পিছু ছুটতে গিয়ে ভাগ্য তাঁকে কোথায় অধিষ্ঠিত করবে—এ নিয়ে তখন শামির বাবা তৌসিফ আহমেদ কিংবা তাঁর কোচ বদরুদ্দিনের কোনো ধারণাই ছিল না!
ভারতের উত্তর প্রদেশের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ট্রায়ালে বারবার চেষ্টা করেও শামির জায়গা হয়নি। কোচ বদরুদ্দিন তখন শামির পরিবারকে বুঝিয়েছিলেন, তাঁর ‘ছাত্র’কে কলকাতায় গিয়ে ক্রিকেট ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ দেওয়া হোক। বদরুদ্দিনের মনে হয়েছিল, কলকাতার শামি ক্রিকেটে যে সময়টা কাটাবে, সেটি হবে তাঁর শেখার অভিযান। এরপর সে আরও ভালো ক্রিকেটার হয়ে উত্তর প্রদেশে ফিরে নিজের ভাগ্যকে ঘষামাজা করতে পারবে।
ভারতের সংবাদমাধ্যম ‘নিউজ১৮’কে এ নিয়ে বদরুদ্দিন বলেছেন, ‘কলকাতা থেকে ফোন পাই যে একটি ক্লাবে খেলোয়াড় প্রয়োজন। শামির বাবাকে বুঝিয়েছিলাম, তার ছেলে সেখানে গেলে ভালোই করবে এবং ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখার এখনই সময়। এক বছর অন্য কোথাও খেলে নিজেকে প্রস্তুত করুক। এরপর দরকার হলে সে ফিরে আসবে।’
শামির সেই পথচলা এখনো শেষ হয়নি। ভারতের হয়ে ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অভিষেকের পর এখন দলে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উইকেটশিকারিদের একজন শামি। এবার বিশ্বকাপের কথাই ধরুন, সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি অ্যাডাম জাম্পা ২২ উইকেট পেতে যেখানে খেলেছেন ৯ ম্যাচ, শামির সেখানে ৫ ম্যাচেই শিকার ১৬ উইকেট! স্ট্রাইক রেটও অবিশ্বাস্য—১২.০০! বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্তত ২০ উইকেট নেওয়া বোলারদের মধ্যে শামির স্ট্রাইক রেটই সেরা (১৬.৩)।
আজ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালেও তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকবে ভারত। এবার বিশ্বকাপে খেলা ৫ ম্যাচের মধ্যে দুটিতে (শ্রীলঙ্কা ও নিউজিল্যান্ড) পেয়েছেন ৫টি করে উইকেট। ৪ উইকেটও পেয়েছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে।
২০১৫ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলেছেন শামি। সেটি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। এবার খেলবেন ঘরের মাঠে, ঘরের দর্শকদের সামনে। প্রেরণার সঙ্গে তাঁকে ঘিরে প্রত্যাশাও তাই বেশি হওয়াই স্বাভাবিক।
শামির কলকাতা–অভিযানে ফেরা যাক। তখন কলকাতার ডালহৌসি অ্যাথলেটিক ক্লাবের সভাপতি ছিলেন তপন চাকি। দলের জন্য তিনি একজন বোলার খুঁজছিলেন। সেই স্মৃতিচারণা করে তপন চাকি ‘নিউজ১৮’কে বলেছেন, ‘উত্তর প্রদেশ থেকে আসা চার ক্রিকেটারের মধ্যে দুজনকে বেছে নিয়েছিলেন আমাদের তখনকার কোচ সীমান্ত হাজরা। সে (শামি) ছিল তাদের একজন। আমরা সব রকম প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তাকে দলে নিই।’
ডালহৌসি ক্লাবে যোগ দেওয়ার কল্যাণে শামি কলকাতার বিখ্যাত ময়দানেও খেলেছেন। আর কলকাতার ক্রিকেটে দ্বিতীয় বিভাগ থেকে ডালহৌসি ক্লাবকে প্রথম বিভাগে তুলে শামি নিজের জাতটাও বেশ ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তপন চাকি জানিয়েছেন, শামি তখন উইকেটের পর উইকেট নিতেন আর তাঁকে বলতেন, ‘তপনদা ভাববেন না।’
শামি সে সময় ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গলের (সিএবি) বর্তমান সভাপতি দেবব্রত দাসের নজরে পড়েন। তিনি খেয়াল করেছিলেন, ছেলেটির গড়ন পেসারদের মতো না হলেও জোরে বল করতে পারে এবং পিচে বলের সিম ফেলতে ভুল করে না। দেবব্রত দাস দেরি না করে শামিকে টাউন ক্লাবে নিয়ে নেন এবং নিজের বাড়িতে থাকতে দেন, ‘তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বাসা কোথায়? উত্তরে বলেছিল, মোরাদাবাদ। জানতে চাই, কলকাতার হয়ে খেলবে? রাজি হলেও বলেছিল থাকার জায়গা নেই। এরপর তাকে নিয়ে নিই। বাসায় শুরুতে একটু আপত্তি উঠলেও ক্রিকেটের তো কোনো ধর্ম কিংবা জাতপাতভেদ নেই।’
দেবব্রত দাস জানিয়েছেন, শামি তখন নিজের প্রতিশ্রুতি পূরণে কঠোর অনুশীলন শুরু করেন। নেটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বোলিং করতেন। দাস প্রতিদিন খাবারের জন্য তাঁকে ১০০ রুপি এবং মৌসুমে ৭০ হাজার রুপি করে দিতেন। ভারত জাতীয় দলে শামি এখন যা উপার্জন করেন, সে তুলনায় ওই অর্থ সামান্যই। কিন্তু শামি তখন কঠোর পরিশ্রমে নিজেকে নিবেদন করেছিলেন বলেই দেবব্রত দাস খাঁটি হীরা চিনতে পেরেছিলেন, ‘শামি ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা। তার পেস বোলিংয়ের তত্ত্ব এবং খেলার প্রতি আবেগ বর্ণনাতীত ব্যাপার। (বোলিংয়ের সময়) তার কবজির পজিশন খ্যাতিমান কোচদেরও অবাক করে দেয়। তখনই বুঝেছিলাম, এই ছেলে যে সুযোগ পাওয়ার যোগ্য, সেটা তাকে দিতেই হবে।’ শামিকে নিয়ে দাস মজার এক স্মৃতিচারণাও করলেন। একবার এক ম্যাচে শামিকে ‘চার বিরিয়ানি’ খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। শামি ডাবল হ্যাটট্রিক করে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন!
শামির কোচ বদরুদ্দিন জানিয়েছেন, বল হাতে তাঁর এই নিখুঁত কবজির অবস্থানের পেছনে কাজ করছে খেলাটির প্রতি তাঁর আগ্রহ। বদরুদ্দিনের ব্যাখ্যা, ‘তার বোলিং অ্যাকশন কিংবা অস্ত্রভান্ডারের সেরা নিদর্শন হলো কবজির অবস্থান ও সিম। কবজির ওপর তার নিয়ন্ত্রণ অবিশ্বাস্য। একটি পরামর্শ তাকে দিয়েছিলাম, পুরোনো বল বাড়ি নিয়ে যেতে বলেছিলাম। খাটিয়ায় শুয়ে দেয়ালে বল মেরে মেরে কবজির অবস্থান ঠিক করতে বলেছিলাম। সে প্রতি রাতেই এই চর্চাটা করত।’
বল দেয়ালে মারা নিয়ে একটি মজার ঘটনাও বললেন বদরুদ্দিন, ‘ব্যাপারটি এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে একদিন তার বাবা এসে অভিযোগ করল, শামি দেয়ালে বল মারা বন্ধ করছে না। তাতে দেয়ালের এক পাশে লাল লাল দাগ পড়েছে এবং খুব সমস্যা হচ্ছে। এরপর শামিকে ওটা কমাতে বলি এবং এভাবেই সে (বল ছাড়ার সময়) কবজির অবস্থানটা নিখুঁত করে ফেলে। এসব কিছুর পেছনে রয়েছে তার কঠোর পরিশ্রম ও খেলার প্রতি আগ্রহ। ক্রিকেটের জন্য সে এমন পাগলামিই করেছে।’
দেবব্রত দাস মোহনবাগানে যোগ দেওয়ার পর কপাল খুলতে শুরু করে শামির। সাবেক রঞ্জি খেলোয়াড় ও তখন নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান সম্বরণ ব্যানার্জিকে গিয়ে ধরেন দাস। শামিকে একবার সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ করেন। বাকিটা ইতিহাস। মাত্র ১৫টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচেই নিজের জাত চিনিয়ে ভারত জাতীয় দলে জায়গা করে নেন। মাঝের এই ১০ বছরে চোট ছাড়াও পারিবারিক সমস্যায় ভুগেছেন শামি। কিন্তু যখন বোলিং করতে নেমেছেন, কবজির অবস্থান ঠিক রাখতে এতটুকু ভুল হয়নি। অর্থাৎ ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসাটা সব সময় একই রকম থেকেছে। শামির মানসিক শক্তি নিয়ে ব্যাখ্যাও দিয়েছেন বদরুদ্দিন ও দেবব্রত দাস।
বদরুদ্দিনের যুক্তি, ‘দাম্পত্য জীবনটা ভেঙে যাওয়া এবং তারপর মুখোমুখি হওয়া কঠিন সময় তাকে মানসিকভাবে শক্তিশালী করে তুলেছে। ক্রিকেটে মনোযোগ আরও বাড়িয়েছে। তার কাছে একটি ব্যাপারই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—দেশের জন্য খেলা।’ দাসও সুর মেলালেন বদরুদ্দিনের সঙ্গে, ‘ক্রিকেটের বাইরে কোনো কিছু নিয়ে তার প্রতিক্রিয়া নেই। একটি কাজেই তার সব মনোযোগ—বলটা নিয়ে স্টাম্পে আঘাত হানা।’