আইপিএলে কোটিপতি নমনের দুই ইচ্ছা; বাড়ি করা ও প্রয়াত কোচের এতিম বাচ্চার ভরণপোষণ
আইপিএলের সৌজন্যে অনেক ক্রিকেটারেরই স্বপ্নপূরণ হয়েছে, হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। নমন ধীর তেমনই একজন। এবার আইপিএল নিলামে আরটিএম কার্ড (রাইট টু ম্যাচ) ব্যবহার করে ৫ কোটি ২৫ লাখ রুপিতে কিনে তাঁকে দলে ফিরিয়েছে মুম্বাই ইন্ডিয়ানস। ২৪ বছর বয়সেই কোটিপতি হওয়ার পর কি করবেন নমন? ‘ভালো দেখে একটি বাড়ি বানাব’—ভারতের সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন নমন।
নিলামে নমনকে কেনার দৌড়ে ছিল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু, দিল্লি ক্যাপিটালস, রাজস্থান রয়্যালস ও পাঞ্জাব কিংস। কিন্তু গত মৌসুমে খেলা ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্লাবটিতেই শেষ পর্যন্ত ফিরতে পারলেন। তবে নমনের কল্পনাতেও ছিল না, নিলামে তাঁর দাম এতটা উঠবে, ‘আমার হৃদয় ধুকপুক করছিল। গত বছর মুম্বাইয়ের হয়ে ভালো একটি মৌসুম কেটেছে। আশা ছিল যে আইপিএলে চুক্তি পাব, কিন্তু এত অর্থকড়ি পাব সেটা আমার দূরতম কল্পনায়ও ছিল না।’
সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফিতে পাঞ্জাবের হয়ে রাজকোটে খেলার সময় সংবাদমাধ্যমটিকে এসব কথা বলেছেন নমন।
নমন কিন্তু ক্রিকেটের খুব সহজ পথে উঠে এসে কোটিপতি হননি। পাঞ্জাবের ফরিদকোট থেকে উঠে আসা এই ব্যাটসম্যান তাঁর রাজ্যের অনূর্ধ্ব-১৬ দলে খেলার পরের চার বছর কোনো দলে সুযোগ না পাওয়ার পর ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন দেখা বাদ দিয়েছিলেন। ২০২২ সালে কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আবেদন করেছিলেন নমন।
সেই দিনগুলো স্মরণ করে নমন বলেছেন, ‘পাঞ্জাবের অর্ধেক মানুষই কানাডায় চলে যেতে চায় এবং আমিও ছিলাম তাদের একজন। ২০২২ সালের শুরুতে আমি ক্রিকেট প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম। আমার বোন কানাডার এডমন্টনে থাকে, আমি সেখানে চলে যেতে চেয়েছিলাম। বাবা বলেছিলেন, নিজেকে (ক্রিকেটে) আর একটি বছর দাও। এরপর ২০২২ সালের ডিসেম্বরে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক হয় আমার। এক বছর পর ২০২৩ সালে মুম্বাই ইন্ডিয়ানস আমাকে দলে নেয়।’
ফরিদকোটে নমনের বাবা নরেশ একটি কেমিস্টের দোকানের কর্মী। এবার আইপিএল নিলামের পর রাতারাতি সেলিব্রিটি বনে গেছেন নরেশ। গত দুই ধরেই প্রচুর ফোন কল আসছে তাঁর। স্থানীয় সংবাদকর্মীরা ভিড় জমিয়েছেন কেমিস্টের দোকানে নরেশের সঙ্গে কথা বলতে। নমন এ নিয়ে মজা করে বলেছেন, ‘ধীর সাহেব এখন ছবি তুলতে এবং সাক্ষাৎকার নিতে ব্যস্ত।’
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে নরেশ এ নিয়ে বলেছেন, ‘এটা স্বপ্নের মতো। (নিলামের পর) একদিন কেটে যাওয়ার পরও নিজের শরীরে চিমটি কাটছি। আমি এই দোকানের সামান্য এক কর্মী।’ ছেলেকে নিয়ে নরেশ সেই সব দাহকালের দিনগুলোও স্মরণ করলেন, ‘স্কুলে গিয়ে আমি ওকে ক্রিকেট অনুশীলনের জন্য নিয়ে যেতাম। প্রিন্সিপাল ম্যাম বললেন “ধীর স্যার, আপনি ওর ক্যারিয়ার নষ্ট করছেন। ভারত তো দূরের ব্যাপার, ফরিদকোট থেকে কেউ কখনো পাঞ্জাবের প্রতিনিধিত্বও করেনি।” কথাগুলো যখন প্রায়ই শুনতাম, তখন একদিন নমনকে বলেছিলাম, “টিভিতে যখন তোমার ছক্কা মারা দেখাবে, তখন এসব বিদ্রূপ করতালিতে পরিণত হবে।’”
নরেশ গত ২০ বছর ধরে কেমিস্টের দোকানে কাজ করছেন। মাসিক বেতন ১০ হাজার রুপি। নরেশ জানিয়েছেন, ১৪ বছর আগে তাঁর বেতন আরও কম ছিল। এর মধ্যেই ছেলেকে ক্রিকেটে নামালেন কীভাবে, সেই গল্পও বলেছেন নমন, ‘১৪ বছর আগে (বেতন) আরও কম ছিল। নমনের স্কুলশিক্ষক নানা (ধর্ম পাল শেঠি) সবকিছুর দায়িত্ব নিয়ে তাকে ক্রিকেট খেলতে দিতে বলেছিলেন। কাজটা কঠিন ছিল। আমার দুটি মেয়েও ছিল, এখন তারা বিবাহিত। একজন কানাডায় থাকে, অন্যজন অস্ট্রেলিয়ায়। তবে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এটা বলতেই হবে, ক্রিকেট খুব ব্যয়বহুল খেলা। সে রঞ্জি ট্রফিতে খেলা শুরুর পর পরিস্থিতির উন্নতি হয়।’
গত দুই বছরে নমনের ক্যারিয়ার উঠে এসেছে। এর মধ্যে দুজন প্রিয় মানুষকেও হারিয়েছেন তিনি। তাঁর নানা এবং শৈশবের কোচ গগন সিধু, এ নিয়ে নমন বলেন ‘দুজনের চলে যাওয়া আমার ওপর খুব প্রভাব ফেলেছিল। নানু তার জীবনটা কাটিয়ে গেছেন, আশির কোটায় বয়স হয়েছিল। কিন্তু গগন ভাইয়ের বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৬। পরিবারও বেশি দিনের না।’ নমন এরপর বলে যান, ‘তিনি আমাকে সব শিখিয়েছেন। তিনি অনেকটাই ছিলেন আমার বড় ভাইয়ের মতো। পাঞ্জাব-১৯ দলে জায়গা না পাওয়ার পর তিনি আমার হয়ে লড়েছিলেন। তার সন্তানের বয়স খুব কম, যার দায়িত্ব এখন আমার। আমি তার দেখাশোনা করতে চাই। তার বড় ভাই হতে চাই, যেমনটা তার বাবা ছিলেন আমার কাছে।’
মুম্বাইয়ের ড্রেসিংরুম নিয়েও কথা বলেছেন নমন, ‘প্রথমবারের মতো মুম্বাইয়ের টিম বাসে ওঠার পর স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। হার্দিক পান্ডিয়া, সূর্যকুমার যাদব, রোহিত শর্মারা আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো বরণ করে নিয়েছিলেন। মুম্বাইয়ের ড্রেসিংরুমে একটি ব্যাপার শিখেছিলাম, সবাই আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। রোহিত ভাই একবার আমাকে বলেছিলেন “দেখ, এখানে সবারই দক্ষতা আছে। তোমার টেম্পারামেন্ট বাকিদের চেয়ে তোমাকে আলাদা করবে।”’
ফরিদকোটে ফেরা যাক। নমনের বাবা নরেশ এখন দ্বিধায়। শত শত স্মৃতিবিজড়িত পুরোনো বাড়িতেই থাকবেন নাকি নতুন একটা কিনবেন, ‘জানি না কী করব। দুই মেয়েদের বাবা হিসেবে এই বাড়ির সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক। সিদ্ধান্তটা আমি আমার ছেলেকেই নিতে দেব।’
ছেলে কী সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন, সেটা আপনি জানেন।