চশমা ছাড়া মুশকিলে পড়া ছেলেটির সঙ্গে ওয়ার্নের তুলনা
১১ মাস আগেও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে মাত্র একটি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা ছিল টড মার্ফির। মেলবোর্নের ক্লাব সেন্ট কিলডার হয়ে তখন গ্রেড ক্রিকেট নিয়ে ভাবছিলেন। বছর পেরোনোর আগে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপ খেলা এই অফ স্পিনারের জীবন এখন পাল্টে যাওয়ার পথে। নাগপুর টেস্টে কাল ভারতের বিপক্ষে নিয়েছেন ৫ উইকেট, আজ আরও ২টি মিলিয়ে প্রথম ইনিংসে শিকার ৭ উইকেট। নাথান লায়নের পর তিনিই টেস্ট অভিষেকে ৫ উইকেট নেওয়া অস্ট্রেলিয়ার প্রথম স্পিনার।
টেস্ট অভিষেকে ৫ উইকেট পেতে কেমন লাগে? উত্তরটা মার্ফির মুখ থেকেই শুনুন। কাল দিনের খেলা শেষ হওয়ার পর বলেছেন, ‘গত কয়েকটি দিন খুব ভালো কাটছে। আর অভিষেকে ৫ উইকেট নেওয়া আমার কল্পনাতেই ছিল না।’
সত্যিই, ক্রিকেট কতটা গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা—যে মার্ফি ১১ মাস আগেও ভেবেছেন গ্রেড ক্রিকেট নিয়ে, সেই তিনিই এখন নাগপুরে অস্ট্রেলিয়ার লড়াইয়ে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বোলার। অথচ চোখে চশমা না থাকলে কয়েক মিটারের বেশি দেখতে পান না। ঘরোয়া ক্রিকেটে সতীর্থরা তাই নাম দিয়েছেন ‘গগলস’। আর মাঠের মার্ফিকে দেখলে মনে হতেই পারে অঞ্জন দত্তের গানের সেই লাইন, ‘চশমাটা খুলে গেলে মুশকিলে পড়ি...।’
আসলে মুশকিলে পড়েছেন ভারতের ব্যাটসম্যানরা। যে মুশকিলে ফেলার কথা ২২ বছর বয়সী মার্ফিও ভাবতে পারেননি। এক বছরের কম সময় আগে ডারউইনে ক্লাব ক্রিকেট খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মার্ফি। নির্বাচক টনি ডোডেমাইডে তাঁকে জানান, অস্ট্রেলিয়া ‘এ’ দলের হয়ে শ্রীলঙ্কা সফরে যেতে হবে। মার্ফি তখন ভিক্টোরিয়ার হয়ে শেফিল্ড শিল্ডে মাত্র দুটি ম্যাচ খেলেছেন।
হাম্বানটোটায় গিয়ে মার্ফি শুধু ক্যারিয়ারে নিজের প্রথম শ্রেণির ম্যাচসংখ্যাই বাড়াননি, গলে ডাক পড়ে অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলের নেট অনুশীলনেও। বল করেছেন নেটে। নজরটা সম্ভবত তখনই কেড়েছিলেন। আর অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচকদেরও জহুরির চোখ। টেস্ট অভিষেকে অস্ট্রেলিয়ার সর্বকনিষ্ঠ স্পিনার হিসেবে ৫ উইকেট নিয়ে নির্বাচকদের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতাও প্রমাণ করেছেন মার্ফি।
চোখে চশমা না থাকলে কয়েক মিটারের বেশি দেখতে পান না। ঘরোয়া ক্রিকেটে সতীর্থরা তাই নাম দিয়েছেন ‘গগলস’। আর মাঠের মার্ফিকে দেখলে মনে হতেই পারে অঞ্জন দত্তের গানের সেই লাইন, ‘চশমাটা খুলে গেলে মুশকিলে পড়ি...।’
অফ স্পিনার হিসেবে মার্ফির লাইন–লেংথ কতটা নিয়ন্ত্রিত, তার একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে ক্রিকইনফো। নাগপুর টেস্টে মার্ফির ৬৩ শতাংশ ডেলিভারি ছিল গুড লেংথে। ফুল টস ও একেবারেই খাটো লেংথে করেছেন একটি করে মাত্র দুটি ডেলিভারি। আর ৩৭টি ফুল লেংথ ডেলিভারি থেকে এসেছে মাত্র ২৩ রান, উইকেটও আছে ১টি। তাঁর ‘মেন্টর’ ১১৫ টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নাথান লায়ন কাল পর্যন্ত ৫৯ শতাংশ ডেলিভারি ভালো লেংথে করতে পেরেছেন।
আজ টেস্টের তৃতীয় দিনেও ৭০ রান নিয়ে বিপজ্জনক হয়ে ওঠা রবীন্দ্র জাদেজাকে তুলে নিয়ে ধারাবাহিকতার প্রমাণ দিয়েছেন মার্ফি। তবে নিজের এই এত দ্রুত উঠে আসা মার্ফিরও জন্যও বিশ্বাস করা কঠিন, ‘গত বছর এ সময়েও আমি রাজ্য দলে ছিলাম না। উন্নতিটা তাই খুব দ্রুতই হয়েছে।’
মার্ফি অফ স্পিনার হলেও তাঁর তুলনা হচ্ছে প্রয়াত কিংবদন্তি লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্নের সঙ্গে। ভ্রুকুটির কিছু নেই। টেস্ট অভিষেকে মার্ফি প্রতিপক্ষের সবগুলো উইকেট নিলেও হয়তো শেন ওয়ার্নের সঙ্গে তাঁর তুলনা অর্থহীন বলে মনে হবে। কিন্তু এই তুলনাটা যদি তাঁর বাবা করেন, তাহলে বুঝে নিতে হবে, সেটি সন্তানের প্রতি ভালোবাসা থেকে। নাগপুরে বিদর্ভ স্টেডিয়ামে মার্ফির কীর্তি গ্যালারি থেকে দেখেছেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। গত বৃহস্পতিবার মার্ফি অস্ট্রেলিয়ার ব্যাগি গ্রিন টুপি পাওয়ার পর এক সাক্ষাৎকারে তাঁর বাবা জেমি মার্ফি বলেছেন, তাঁর সন্তানের মধ্যে ‘শেন ওয়ার্নের অনেক বৈশিষ্ট্য আছে’।
এটা আসলে একজন গর্বিত পিতার অনুভূতি। ওয়ার্ন তর্কযোগ্যভাবে অনেকের চোখেই সর্বকালের সেরা বোলার। তাঁর সঙ্গে একজন সদ্য টেস্ট অভিষিক্তের তুলনা ওঠে কীভাবে!
ওয়ার্নকে কিন্তু কাছ থেকেই দেখেছেন টডের বাবা জেমি। ‘সেভেন নিউজ’ জানিয়েছে, ১৯৯১–৯২ গ্রেড ক্রিকেট প্রিমিয়ারশিপে ওয়ার্নের সঙ্গে খেলেছেন জেমি। তবে টেস্ট অভিষেকে বোলিংয়ের তুলনা টানলে মার্ফি কিন্তু ওয়ার্নের চেয়ে অনেক ভালো বল করেছেন। ১৯৯২ সালে সিডনিতে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেকে ১৫০ রানে ১ উইকেট নিয়েছিলেন ওয়ার্ন।
তবু সর্বকালের অন্যতম সেরা এক ক্রিকেটারের সঙ্গে তুলনা ওঠায় টড মার্ফির একটু অস্বস্তি লাগাই স্বাভাবিক, এমনকি সেই তুলনাটা তাঁর বাবা টানলেও, ‘এটি (তুলনা) শোনার পর অবিশ্বাসে মাথা নাড়িয়েছি। ওয়ার্নের সঙ্গে কোনো মিল আছে কি না, আমি ঠিক নিশ্চিত নই।’ তবে পরিবারকে নাগপুরের গ্যালারিতে পেয়ে খুশি টড মার্ফি, ‘এখানে (ভারতে) আসতে তাদের কয়েকটি দিন খুব ব্যস্ততায় কেটেছে। তবে তারা সব সময়ই আমার অভিযাত্রার অংশ। এখানে তাদের পাওয়াটা সত্যিই বিশেষ ব্যাপার আমার জন্য।’
টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার স্পিনারদের মধ্যে জেসন ক্রেজার চেয়ে ভালো অভিষেক আর কারও হয়নি। সেটিও ১৫ বছর আগে এই নাগপুরেই। ২০০৮ সালে ভারতের বিপক্ষে সে টেস্টে ১২ উইকেট নিয়েছিলেন এই অফ স্পিনার।
এবার ভারতের প্রথম ইনিংসে মার্ফির শিকার ১২৪ রানে ৭ উইকেট। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসে ১৭৭ রানের বিপরীতে ভারত তুলেছে ৪০০ রান। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং ভালো করলে (এই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় অস্ট্রেলিয়া পিছিয়ে ১৮১ রানে) হয়তো আরেকবার বোলিংয়ের সুযোগও পাবেন মার্ফি।
এই টেস্টে ক্রেজাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ আসুক বা না আসুক, ক্যারিয়ার–বিবেচনায় নিশ্চয়ই এগিয়ে থাকতে চাইবেন তিনি। কারণ, ক্রেজার টেস্ট ক্যারিয়ার লম্বা হয়নি। সে বছর ডিসেম্বরেই পার্থে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলা ম্যাচটি ক্রেজার ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ, ধূমকেতুর মতো আর্বিভূত হয়ে হারিয়ে যাওয়ার উদাহরণ মার্ফির সামনেই আছে। প্রশ্ন হলো, নাগপুরে জীবন পাল্টে যাওয়ার পর ক্রেজার ক্যারিয়ার দেখে মার্ফি শিক্ষা নেবেন কি না?