আমির–ইমাদ কি তাহলে আফ্রিদি হতে চান
সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘রসগোল্লা’ গল্পের চরিত্র ঝান্ডুদার সঙ্গে কারও দেখা হলে বলার উপায় ছিল না—তিনি বিদেশে যাচ্ছেন, না ফিরে আসছেন। ক্রিকেটের ঝান্ডুদা বলতে পারেন শহীদ আফ্রিদিকে।
একটা সময় এমন হয়ে গিয়েছিল যে আফ্রিদিকে মাঠে খেলতে দেখে বোঝার উপায় ছিল না—কবে তিনি অবসর ভেঙে ফিরেছেন, আবার কবেই বা অবসরে যাবেন! নেট দুনিয়ার মহাকাশ চষে আর আফ্রিদির ক্যারিয়ার ঘেঁটে যে তথ্য পাওয়া গেল, ক্রিকেট খেলাটার মহান এই অবসরবিদ জীবনে পাঁচবার অবসর নিয়েছেন, ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে চূড়ান্তভাবে অবসর নেওয়ার আগে চারবার তা ভেঙেচুরে একাকার করেছেন!
অবসর শব্দটি ভেঙেচুরে ছাতু বানানোর এমন কাণ্ড একবার–আধবার আফ্রিদির দুই পূর্বসূরি জাভেদ মিয়াঁদাদ ও ইমরান খানও এক–আধবার করেছেন। ইমরান খান তো পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়া–উল–হকের অনুরোধে অবসর ভেঙে ফিরে দেশকে বিশ্বকাপও জিতিয়েছেন।
আফ্রিদির মতো অভ্যাস না বানিয়ে ফেললেও অবসর ভাঙার কাজটি ওয়েস্ট ইন্ডিজের কার্ল হুপার, ইংল্যান্ডের কেভিন পিটারসেন, শ্রীলঙ্কার ভানুকা রাজাপক্ষে, ইংল্যান্ডের মঈন আলী বা ভারতের জাভাগাল শ্রীনাথও করেছেন। কম্মোটি করার মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন বাংলাদেশের তামিম ইকবালও। এক দিনের মধ্যেই সিদ্ধান্ত বদলে সংক্ষিপ্ততম অবসরের রেকর্ড যাঁর অধিকারে।
তা হঠাৎ করে অবসর–অবসর খেলা নিয়ে এত কথা কেন? উপলক্ষ দুজন পাকিস্তানি ক্রিকেটার। ইমাদ ওয়াসিম ও মোহাম্মদ আমির—এই দুজন যেভাবে অবসর নেওয়া আর অবসর ভাঙার খেলায় নেমেছেন, তাতে মনে হতেই পারে, এঁরা কি আফ্রিদির রেকর্ড ভাঙার পরিকল্পনা করে এগোচ্ছেন!
সদ্য দ্বিতীয়বারের মতো সাবেক হওয়া আমির প্রথম অবসর শব্দটি মুখে আনেন ২০১৯ সালে, টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় বলে দেন পাকিস্তানের ফাস্ট বোলার। পরের বছর ডিসেম্বরে বিদায় বলে দেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকেই। এর আগে ২০১০ সালে স্পট ফিক্সিংয়ের দায়ে জেল খাটায় লম্বা একটা অবসর জীবন তাঁর আগেই কাটানো হয়ে গিয়েছিল।
ইমাদ প্রথমবার অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন ২০২৩ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর। আমির ও ইমাদ, দুজনেই অবসর ভাঙার ঘোষণা দেন এ বছরের মার্চে। ফিরে এসে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলেছেন, কিন্তু এখন আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিয়েছেন। কে জানে, কবে আবার বলবেন, থুক্কু, আমরা আবার পাকিস্তান দলে খেলতে চাই।
শচীন টেন্ডুলকার বলুন বা বিরাট কোহলি অথবা আফ্রিদি বা আমির—অনেক ক্রিকেটারকেই বলতে শোনা গেছে একটি কথা; ক্রিকেট খেলাটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভালোবাসা। সেই ভালোবাসাকে একবার ছেড়ে দেওয়া, আবার কাছে টেনে নেওয়া; এমন ছেলেখেলা করায় কী কারণ নিহিত থাকতে পারে?
লাইলি–মজনু, শিরি–ফরহাদ, ইউসুফ–জোলেখার প্রেমকাহিনির দিকে তাকালে কী দেখবেন? কখনো পরিবারের রক্তচক্ষু, কখনো দ্রোহ, কখনো বঞ্চনা বা অভিমানে টুটেছে বন্ধন। কিন্তু প্রেম বা ভালোবাসার বিনাশ কারও মন থেকেই কখনো হয়নি।
তেমনি করে মিয়াঁদাদ প্রথমবার অবসর নিয়েছিলেন দল থেকে বাদ পড়ার অভিমানে। আফ্রিদি বারবার অবসরে গেছেন ক্ষোভে, আমিরও তা–ই; তাঁদের ক্ষোভ ছিল কখনো পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তা, কখনো কোচ বা নির্বাচকদের বিরুদ্ধে। ইমাদের গল্পটাও অনেকটাই তা–ই। কিন্তু অভিমান, হতাশা বা ক্ষোভের কারণে ক্রিকেট ছাড়লে কী হবে, খেলাটির প্রতি ভালোবাসার বিনাশ তো হয়নি!
কবির সুমনের ‘জাতিস্মর’ গানের ওই দুটি কলির মতো আফ্রিদি–আমির–ইমাদদের মনে হয়তো সুর বাজে—‘বার বার আসি আমরা দু’জন, বার বার ফিরে যাই/ আবার আসব, আবার বলব, শুধু তোমাকে চাই।’
এখানে ‘তোমাকে’ মানে যে ক্রিকেট, তা মনে হয় বলার দরকার নেই।