প্রশ্নটা গতকাল করেছিলাম মোসাদ্দেক হোসেনকে। গ্যাবার মিক্সড জোন থেকে যখন তিনি ড্রেসিংরুমে ফিরছেন, জানতে চাইলাম, ‘জিম্বাবুয়েকে হারিয়েও কেন আপনারা এত খুশি?’
কারণটা যে আমরা একেবারেই বুঝতে পারছি না, তা নয়। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সসম্মানে টিকে থাকতে বাংলাদেশের জয়টা খুব দরকার ছিল। সুপার টুয়েলভে এরপর ভারত, পাকিস্তানের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সঙ্গে খেলা। তার আগে জিম্বাবুয়ে কেন, আরও ছোট দলের বিপক্ষে জয়ও বাড়তি টনিক দিতে পারে।
তার ওপর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুপার টুয়েলভে এবার দুটি জয়। জিম্বাবুয়েকে হারাতে না পারলে অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপটাও একের নামতা পড়েই শেষ করত বাংলাদেশ। এখন তো বলা যাচ্ছে, দুইয়ে একে দুই। বৃত্ত ভাঙার একটা আনন্দও তাই আছে।
আর ছোট দল যে কখনো বড় দলকে ছোবল মারে না, তা তো নয়। তার ওপর এই ম্যাচের আবহ সংগীতে আগে থেকেই বাঁচা–মরার সুর। সেখানে জয় বাংলাদেশের জন্য স্বস্তি হবে স্বাভাবিক। কিন্তু স্বস্তি এক জিনিস, আর এ রকম ম্যাচ জিতে দেখিয়ে দেওয়ার মনোভাব প্রকাশ আরেক জিনিস। তাতে দলের আত্মবিশ্বাসটাকেই ঠুনকো মনে হয়। তাহলে কি দলের মধ্যে জিম্বাবুয়ের কাছে হেরে যাওয়ার শঙ্কাই বেশি ছিল!
প্রতিপক্ষের নাম যখন জিম্বাবুয়ে, যেকোনো সংস্করণে তাদের বিপক্ষে জয়টাই স্বাভাবিক ফল বাংলাদেশের জন্য। এটা গত প্রায় দেড় যুগের বাস্তবতা। প্রশাসনিক দুর্বলতা, দুর্নীতি ও আরও অনেক সমস্যায় জর্জরিত জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট এই সময়ে খুব একটা আগায়নি, বরং পিছিয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ এই সময়টাতেই পেয়ে গেছে মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহদের মতো সেরা খেলোয়াড়দের। বাংলাদেশের ক্রিকেটীয় কাঠামো নিয়ে যত প্রশ্নই থাকুক, জিম্বাবুয়ের সঙ্গে পার্থক্য গড়তে তাঁদের মাঠের পারফরম্যান্সই যথেষ্ট হয়েছে। জিম্বাবুয়েও এই সময়ে কিছু ম্যাচে বাংলাদেশকে হারিয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেগুলো ‘অঘটন’ বলেই বিবেচিত।
বিশ্বকাপে সেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয়ই যখন চরম টেনশন তৈরি করে আসে, ম্যাচের শেষ বল পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হয় জেতার জন্য এবং জয়ের পর ক্রিকেটাররা বিরাট কিছু করে ফেলার আনন্দে ভাসতে থাকেন, মানতে একটু কষ্টই হয়। অবশ্য গত বছর ওমান-সংযুক্ত আরব আমিরাতের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও এটাই দেখা গেছে। ওমান আর পাপুয়া নিউগিনিকে হারিয়েই যেন সব পাওয়া হয়ে গিয়েছিল দলটার, ভর করেছিল অতি আত্মবিশ্বাস। মূল পর্বে যার ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
একটা দল যখন বড় হতে চাইবে, দলটাকে প্রতি উপলক্ষে চেষ্টা করে যেতে হবে ছোট ও সমশক্তির প্রতিপক্ষদের সঙ্গে নিজেদের পার্থক্য দৃশ্যমান করে তুলে ধরতে। এসব প্রতিপক্ষকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে না দিলে বড় দলের সামনে বড় কিছুর আত্মবিশ্বাস আসবে কোথা থেকে?
পিছিয়ে থাকা দলগুলোকে বাংলাদেশের ভাবতে হবে ছোট ছোট গতিরোধক, যেখানে না থেমেও দুরন্ত গতিতে পথ পেরিয়ে যাওয়া যায়। তার মধ্যেও মাঝেমধ্যে হোঁচট খেতে হবে। তবে সেই ভয়ে আগে থেকে রক্তচাপ বাড়িয়ে নেওয়া মানে কোথাও না কোথাও আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি রয়ে গেছে। হয় সামর্থ্যে, নয়তো মানসিকতায়।
গ্যাবায় সেটাই মনে হলো। জিম্বাবুয়ে যেন বাংলাদেশের কাছে আবার বড় প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। আমরা আবারও তাদের বিপক্ষে টেনশনে পড়ে যাচ্ছি। জিম্বাবুয়ের সঙ্গেও জিততে হয় টানটান উত্তেজনার ম্যাচ খেলে। এরপর যখন জয় আসে, আমরা আনন্দের প্রশান্ত মহাসাগরে সাঁতার কাটতে থাকি। মনে হয়, বিশ্বকাপে সব পাওয়া হয়ে গেছে। নেদারল্যান্ডসের পর জিম্বাবুয়ে, মূল পর্বে দুই ম্যাচ জয়ের কোটা পূরণই ছিল লক্ষ্য।
নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ জয়ের পর তাসকিন আহমেদ বলেছিলেন, সময়টা উদ্যাপনের। জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে মোসাদ্দেকও বললেন, এটা নাকি অনেক বড় অনুপ্রেরণা তাঁদের জন্য। তবে এসব তাসকিন, মোসাদ্দেকের ব্যক্তিগত দর্শন নয় বলেই মনে হয়। পুরো দলই হয়তো এখন এভাবে ভাবে। বড় কোনো স্বপ্ন নেই। ছোটদের হারিয়েই চলে আসছে বড় তৃপ্তি।
কিন্তু ক্রিকেটারদের তো এই উপলব্ধি থাকা উচিত যে জিম্বাবুয়ে অনেক আগেই বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর মর্যাদা হারিয়েছে এবং সেটা তাঁদেরই কৃতিত্বে। তাহলে তাঁরাই কেন এখন আবার অতীতে ফিরে গিয়ে বলবেন, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয়ও বড় অনুপ্রেরণা!
মোসাদ্দেক এই কৌতূহলের জবাবে যেটা বলেছেন, সেটি আরও একবার বাংলাদেশের ক্রিকেটের পিছিয়ে পড়ার ছবিটাই সামনে এনেছে। তাঁর কথা, ‘জিম্বাবুয়ে এখন অনেক ভালো দল। অনেক এগিয়েছে তারা। ওরা পাকিস্তানকেও হারিয়েছে। তাদের হারানোটা বিশ্বকাপের পরের ম্যাচগুলোতে দলের আত্মবিশ্বাস বাড়াবে।’
হ্যাঁ, জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট আসলেই অনেকটা এগিয়ে গেছে। আমরা সে রকম এগুতে পারিনি বলেই দুই দলের ব্যবধান কমে আসছে। পেছন থেকে এগিয়ে এসে তারা আবার আমাদের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে। তারা পাকিস্তানকে ১ রানে হারিয়েছে। আর আমরা দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১০৪ রানে হেরেছি।
জিম্বাবুয়ের জাতীয় দলটাকে সাফল্যের পথে নিয়ে আসার দায়িত্ব বর্তেছে সাবেক অধিনায়ক হ্যামিল্টন মাসাকাদজার ওপর। মূলত তিনি ডিরেক্টর অব ক্রিকেটের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই মনে হচ্ছে, জিম্বাবুয়ে তাদের হারানো গৌরব ফিরে পেতে সচেষ্ট। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গেও অবশ্য অনেক সাবেক ক্রিকেটার ও অধিনায়ক আছেন। তাঁরা তাঁদের পরের প্রজন্মকে কোন মন্ত্রে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছেন, কে জানে।
বাইরে থেকে দেখে যে উপলব্ধিটা আসে, সেটা অবশ্য ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব আশাবাদী হতে উৎসাহ দেয় না। বাংলাদেশের ক্রিকেট যেন টাইমমেশিনে চড়ে ফিরে যাচ্ছে ফেলে আসা দিনে, যখন জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে উৎসব হতো। আন্তর্জাতিক ম্যাচ জয়ের তৃপ্তির ঢেঁকুর উঠত। আমরা এখন আবার সেই আগের মতো জিম্বাবুয়ে, নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে ‘মোটিভেশন’ পেতে শুরু করেছি।
এই ‘মোটিভেশন’ দিয়ে যদি সত্যি সত্যি ভারত, পাকিস্তানকে কাঁপানো যায়, তাহলে ক্রিকেটাররা অবশ্যই হাততালি পাবেন। আর যদি জিম্বাবুয়ে-নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে সাদামাটা জয়ের বিপরীতে বিশ্বকাপটা হয়ে ওঠে বড় প্রতিপক্ষের কাছে শুধু বড় হারেরই প্রদর্শনী, বুঝতে হবে—টাইমমেশিন আসলেই ব্যাকগিয়ারে চলতে শুরু করেছে।