‘তিকিতাকা’ খেলছে দক্ষিণ আফ্রিকা
আধুনিক ক্রিকেটে ব্যাটিংয়ের ধরনে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এসব ধরনকে নানা ধরনের টার্ম দিয়ে চেনানো হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে ইংল্যান্ড যেমন লাল বলের ক্রিকেটে ‘বাজবল’ ধারণার প্রয়োগ করে ক্রিকেট দুনিয়া তোলপাড় করে ফেলেছে। এমনকি কলিন্সের অভিধানেও যুক্ত হয়ে গেছে শব্দটি। মজার ব্যাপার হলো, ইংল্যান্ডের নারীদের ক্রিকেটে এই শব্দকেই খানিকটা পাল্টে বলা হচ্ছে ‘জনবল’। ইংল্যান্ড নারী দলের কোচ জন লুইসের নামে এই নামকরণ করেছেন ব্যাটার ন্যাট শিভার–বার্নট।
আফগানিস্তানের ওপেনিং ব্যাটসম্যান রহমানুল্লাহ গুরবাজের ব্যাটিং ধরনকে বলা হচ্ছে ‘গুরবাজবল’। সেই ধারাবাহিকতায় এবার উঠে আসছে ফুটবলও এবং তা দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পর্কিত। নাহ, দক্ষিণ আফ্রিকা অবশ্য ক্রিকেট মাঠে নেমে ফুটবল খেলছে না। সেটা সম্ভবও নয়। ফুটবল খেলার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার আলাদা একটি দলও আছে। অনেক সময় অনুশীলনে যদিও ফুটবল খেলা হয়, তবে এই নামকরণের বিষয়টির প্রেক্ষাপট ভিন্ন।
বিশ্বকাপে এবার দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলছে দক্ষিণ আফ্রিকা। আগে ব্যাট করা কোনো ম্যাচে ৩০০–এর নিচে রান করেনি তারা। নিজেদের এই ব্যাটিংদর্শন মূলত ফুটবল খেলার কৌশল ‘তিকিতাকা’ থেকে নেওয়ার কথা বলছে তারা। ২০০৬ সালের পর থেকে স্পেন ফুটবল দল এবং বার্সেলোনা ক্লাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এই কৌশল। ‘তিকিতাকা’ কৌশলে খেলে ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় আয়োজিত বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় স্পেন। আর পেপ গার্দিওলা এই তিকিতাকা কৌশলে খেলিয়ে বার্সেলোনাকে পরিণত করেছিলেন অজেয় এক দলে। এই কৌশলে সাধারণত বলের দখল বেশির ভাগ সময় নিজেদের কাছে রেখে ছোট ছোট পাসে আক্রমণে গিয়ে গোল আদায়ের চেষ্টা করা হয়। ক্রিকেটের ‘তিকিতাকা’ কৌশল অবশ্য সরাসরি ফুটবলের ‘তিকিতাকা’ থেকে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে না। ক্রিকেটে মূলত দর্শনগত জায়গা থেকে এই কৌশলের আত্মীকরণের কথা বলা হচ্ছে।
সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক এনোখ এনকেউইকে দলের নতুন এই আত্মপরিচয় নিয়ে বলতে গিয়ে বলেন, ‘আমি বার্সেলোনা দলের বড় ভক্ত। আমি তিকিতাকার ভক্ত।’ এ সময় নিজেদের খেলায় তিকিতাকার আত্মীকরণ নিয়ে এনকেউই ব্যাখ্যা করেন, ‘নিজেদের চাপের মধ্যে না রেখে খেলা পুনর্গঠন করা এবং ম্যাচকে সামনে এগিয়ে নেওয়া।’
উদাহরণ হিসেবে এনকেউই বলেন, এ বছরের মার্চে টি–টোয়েন্টিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার ২৫৯ রান তাড়া করে জেতার কথা। যেখানে ওপেনিংয়ে ১৫২ রানের জুটি গড়েন কুইন্টন ডি কক এবং রিজা হেনড্রিকস। পরে দারুণভাবে ম্যাচের ইতি টানেন এইডেন মার্করাম ও হাইনরিখ ক্লাসেন। ম্যাচটি নিয়ে এনকেউই বলেন, ‘কুইনি (ডি কক) ও রিজা যে জুটি গড়েছিল, সেটা আগ্রাসী ছিল কিন্তু বেপরোয়া নয়। তারা দারুণ ক্রিকেটীয় শট খেলেছে। কিন্তু এরপর আমরা দ্রুত উইকেট হারাই। এটি অনেক পজেশন (দখল) হারানো এবং কীভাবে সেটি পুনরায় নিয়ন্ত্রণে নিতে হয় সেটিরই প্রতিফলন।’
সেদিন ডি কক, হেনড্রিকস ও রাইলি রুশো মাত্র ১৩ বলের মধ্যে আউট হয়ে গিয়েছিলেন। ফলে বিনা উইকেটে ১৫২ রান থেকে ১৯৩ রানে ৩ উইকেট হারায় প্রোটিয়ারা। দ্রুত ৩ উইকেট হারালেও এর মধ্যে তিনটি চার ও চারটি ছক্কায় প্রয়োজনীয় রান রেট ধরে রাখতে পেরেছিল। যে কারণে ইনিংসের পুনর্গঠন বা বলের দখল নেওয়াও সহজ হয়েছে। এনকেউই বলেন, ‘এইডেন আর ক্লাসেন কোনো চার–ছক্কা ছাড়া ৭ বল খেলে ফেলেছিল, কিন্তু এরপরও তারা এমন অবস্থানে ছিল, যেখান থেকে আক্রমণে যেতে পারত। যেভাবে আমরা অপেক্ষা না করে ঘুরে দাঁড়িয়েছি, যেভাবে আমরা চেষ্টা করেছি এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দখলে নিয়েছি, তা আমাদের মানসিকতাকে তুলে ধরে। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে না দেওয়া, ম্যাচ জেতার সুযোগ তৈরি করা এবং সেটা জিতে নেওয়াই হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য।’
নিজেদের খেলার এই ধরনকে আরও একটি প্রতীকী শব্দবন্ধ দ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন এনকেউই, যেটি হচ্ছে ‘আর্টিস্টিক হান্টার’ বা শৈল্পিক শিকারি। সেটি কেমন, এনকেউই তা ব্যাখ্যা করেন এভাবে, ‘পরিস্থিতির সঙ্গে আমরা শৈল্পিক হওয়ার কথা বলি, যা কিনা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে খুবই সৃজনশীল হওয়ার কথা বলে। কিছু কিছু খেলোয়াড়কে দেখা যায়, নির্দিষ্ট কিছু কাজে নিজেদের মতো করেই খুব ভালো। শৈল্পিক হওয়া মানে বিচক্ষণ হওয়াও বোঝায়। আর একই সঙ্গে আমাদের শিকারি মানসিকতাও আছে, যা মূলত আক্রমণাত্মক এবং আরও বেশি আগ্রাসী হয়ে নিজেদের রক্ষার কথা বলে। সংক্ষেপে যাকে আমরা বলি: আর্টিস্টিক হান্টার বা শৈল্পিক শিকারি।’
খেলার এই ধরন কিংবা কৌশলের কথা প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে সবাইকে জানাল দক্ষিণ আফ্রিকা দল, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় ‘প্রোটিয়া ফায়ার’–এর কথা। দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় ফুল ‘প্রোটিয়া’ প্রথম ফুটেছিল জঙ্গলে আগুন লাগার পর। এই ফুলকে প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করে দক্ষিণ আফ্রিকা দলকে মাঠে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য উৎসাহিত করা হতো। এর অর্থ এটাও যে তাদের ঘুরে দাঁড়াতেই হবে এবং এ কারণেই সম্ভবত এনকেউইকে বলেছেন, ‘আমাদের সব সময় দেখা হয়েছে রিঅ্যাক্টর হিসেবে।’
নতুন কৌশলের উদ্দেশ্য কিন্তু এর বিপরীত। দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে কীভাবে ব্যাটিং করেছে, তা খতিয়ে দেখলেই এটি বোঝা যাবে। প্রথম ছয় ব্যাটসম্যান রান করার নতুন পদ্ধতি ও জায়গা খুঁজে পেয়েছেন। ডি কক যেমন মন্থরগতিতে শুরু করতে দ্বিধা বোধ করেন না। টেম্বা বাভুমা আবার আগ্রাসী ব্যাটিং করেন। ফন ডার দুসেন কাজ করেন সুইপ শট দিয়ে।
মার্করাম আবার তুলনামূলকভাবে আগ্রাসী। ক্লাসেনও নিয়মিত বড় শটে খেলা এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। ডেভিড মিলার আবার স্ট্রাইক রোটেট করায় বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন। আর নিচের দিকে মার্কো ইয়ানসেনসহ অন্যরা যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে ব্যাটিংয়ের কাজ করছেন। রানতাড়ায় চাপের মুখে কীভাবে রানের গতি সচল রাখতে হবে, তা–ও তারা করার চেষ্টা করছে। এটা যে সব সময় কাজ করছে, তা অবশ্য নয়।
কিন্তু পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে তারা সেটি করে দেখিয়েছে। এর অর্থ কীভাবে চাপ সামলাতে হয়, দক্ষিণ আফ্রিকা তা কিছুটা হলেও শিখেছে। হ্যাঁ এটাও ঠিক যে আগে ব্যাট করার সময়ই এই কৌশলের সেরা রূপটা দেখা যায়। এখন নিজেদের শৈল্পিক শিকারি রূপটা আর দুটি ম্যাচে মাঠে নেমে ঠিকঠাক বাস্তবায়ন করতে পারলে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপাটা প্রোটিয়াদের হাতে ওঠা একেবারেই অসম্ভব নয়।