প্রথম বলেই ছয় খেয়েছেন। প্রথম দুই ওভারে দিয়েছেন ১৯ রান। উইকেট তো পানইনি, পেতে পারেন বলেও মনে হয়নি। নেদারল্যান্ডস ইনিংসের ১৫তম ওভারে আবার যখন আক্রমণে ফিরলেন, ম্যাচ বাংলাদেশের হাত থেকে প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছে।
৩৬ বলে ৫৬ রান লাগে নেদারল্যান্ডসের। হাতে ৭ উইকেট ৯.৩৩ আস্কিং রেটকে অসম্ভব তো নয়ই, খুব বেশি বলেও মনে করতে দিচ্ছে না। ক্রিকেট ম্যাচে কখনো কখনো এমন সময় আসে, যখন সময় থমকে যায়। যখন সবাই বুঝতে পারেন, এখনই ম্যাচটার ভাগ্য লেখা হয়ে যাবে।
এই ম্যাচে তা রিশাদ হোসেনের তৃতীয় ওভার। আরও নির্দিষ্ট করে বললে শেষ তিন বল। প্রথম তিন বলে ৭ রান দিয়ে দেওয়ার পর তো এই ম্যাচের রং কমলা হয়ে যাওয়াটাই মনে হচ্ছিল ভবিতব্য। বাকি তিন বলেই যা কমলার বদলে সবুজাভ হতে শুরু করল। লেগ স্পিনাররা কেন হীরার মতো দামি, তা বুঝিয়ে দিয়ে তিন বলে রিশাদের ২ উইকেট।
প্রথম উইকেটটি তানজিমের ক্যাচে। চোখে সূর্যের আলো পড়ায় শেষ মুহূর্তে চোখ সরিয়ে নিতে হয়েছে। পড়ে গেছেন মাটিতে। তারপরও ক্যাচ ছাড়েননি। ম্যাচটার দিকে ফিরে তাকালে টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে একেকজন হয়তো একেক কথা বলবেন। তবে তানজিমের এই ক্যাচও অবশ্যই থাকবে এর মধ্যে।
যেমন থাকবে শেষ বলে লিটনের স্টাম্পিংটা। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়েও বড় ভূমিকা ছিল লিটনের দুর্দান্ত কিপিংয়ের। যদিও তা সেভাবে আলোচনায় আসেনি। এদিন যে স্টাম্পিং করেছেন, এককথায় তা ওয়ার্ল্ড ক্লাস।
রিশাদের ওই ওভারই ম্যাচ ঘুরিয়ে দিয়েছে। বাকিটুকু করার মতো বোলার বাংলাদেশের এই দলে আছেন। সবার আগে নাম আসবে মোস্তাফিজের। যাঁর ৪ ওভার থেকে ডাচ ব্যাটসম্যানরা নিতে পেরেছেন মাত্র ১২ রান।
শেষ ওভারের আগেই তাই ম্যাচ শেষ। যখন ম্যাচের ফলের বদলে আলোচনা একটাই—ম্যাচসেরা কি রিশাদ না সাকিব? শেষ পর্যন্ত তা সাকিবই। ক্যারিয়ারে আরও অনেকবারের মতোই দুর্দান্ত এক প্রত্যাবর্তন।
সুপার এইট এখন আর দূরের কোনো স্বপ্ন নয়। বরং খুবই কাছে। আগামী ১৬ জুন (বাংলাদেশে ১৭ জুন) নেপালের বিপক্ষে গ্রুপে বাংলাদেশের শেষ ম্যাচ। এই বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত যে পারফরম্যান্স, তাতে ওই ম্যাচে জয়টাকে নিছক আনুষ্ঠানিকতা বলে ফেলাটায় কোনো বাড়াবাড়ি দেখছি না।
চাপের ম্যাচে দারুণ এক জয়ই শুধু একমাত্র কারণ নয়। বড় একটা কারণ সাকিব আল হাসানের ফিরে আসাও।
সাকিব আল হাসানের ক্যারিয়ারেও খারাপ সময় এসেছে আগে। তবে এই বিশ্বকাপে প্রথম দুই ম্যাচের পারফরম্যান্স ‘সাকিব শেষ’ ‘সাকিব শেষ’ বলে যে রব তুলে দিয়েছিল, এতটা আর কখনো হয়নি। বয়স একটা কারণ, ক্রিকেটের বাইরে নানা কিছু নিয়ে ব্যস্ততাও। প্রথম দুই ম্যাচে প্রায় অদৃশ্য হয়ে থাকার সঙ্গে তাল মিলিয়ে টি-টোয়েন্টি অলরাউন্ডারদের র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ থেকে নেমে গেছেন ৫ নম্বরে। ক্যারিয়ারজুড়ে ‘চাপ’ শব্দটাকে যতই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে আসুন না কেন, এদিন ব্যাটিং করতে নামার সময়ও চাপে ছিলেন না দাবি করলে তা বিশ্বাস করার কোনো কারণ দেখছি না।
ইনিংসের তখন মাত্র চতুর্থ ওভার, ২৩ রানে পড়ে গেছে বাংলাদেশের প্রথম ২ উইকেট। অতীতে আরও অনেকবারের মতো আবারও সাকিব চাপ জয় করার ‘সহজ’ পথটাই বেছে নিলেন। টি-টোয়েন্টিতে আগের ১৯ ইনিংসে কোনো হাফ সেঞ্চুরি ছিল না। ব্যাটিং করার সময় এত অস্বচ্ছন্দও এর আগে কখনো লাগেনি। ব্যাটিং দেখে সাকিবকে চেনা গেল অনেক দিন পর। অপরাজিত ৬৪ রানের ইনিংসটিই শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের পারানির কড়ি।
এই ম্যাচের আগেই নাজমুল হোসেন বলেছেন, অধিনায়ককে যে প্রতিদিনই ভালো খেলতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। তা তো অবশ্যই । তবে প্রতিদিনই না হলেও মাঝেমধ্যে মনে হয় ভালো খেলা উচিত। টানা ব্যর্থ হলে কথা উঠবেই, এমন আউট হলে তো আরও বেশি।
অসময়ে রিভার্স সুইপ মেরে আউট হওয়া মানেই অবধারিতভাবে মাইক গ্যাটিংকে মনে পড়ে যাওয়া। ব্যাটসম্যান যদি অধিনায়ক হন, তাহলে তো আরও বেশি। অ্যালান বোর্ডারের প্রথম বলেই গ্যাটিংয়ের ওই আত্মঘাতী রিভার্স সুইপের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য ছিল। ওই শটের কারণেই ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিততে ইংল্যান্ডকে আরও ৩২ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে বলে অনেকের বিশ্বাস।
কোথায় বিশ্বকাপ ফাইনাল আর কোথায় এই ম্যাচ! তার চেয়েও বেশি মনে রাখতে বলি সময়টা। ১৯৮৭ সালে রিভার্স সুইপ মানে রীতিমতো দুঃসাহস, আধুনিক ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানকে যা মারতে জানতেই হবে। তারপরও নাজমুলের ওই রিভার্স সুইপ চোখে লাগার কারণ, যে সময়ে তা মারতে গেছেন।
ইনিংসের তখন মাত্র দ্বিতীয় ওভার, নিজে খেলছেন তৃতীয় বল। ম্যাচটাও কি! বিশ্বকাপ ফাইনালের সঙ্গে অবশ্যই তুলনা চলে না, তবে বাংলাদেশের জন্য এই ম্যাচের গুরুত্বও তো ‘ফাইনাল’-এর চেয়ে খুব একটা কম ছিল না। জিতলেই সুপার এইটে উঠে যাওয়া একরকম নিশ্চিত। বাংলাদেশ না জিতলে নাজমুলের ওই রিভার্স সুইপ নিয়ে নিশ্চিত আরও অনেক কথা হতো।
জয়ের পর তা ভুলে যাওয়াই ভালো। বিশেষ করে আধুনিক টি-টোয়েন্টি যেখানে ব্যাটসম্যানদের যা ইচ্ছা তা-ই করার স্বাধীনতা দেয়।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১৫৯/৫ (সাকিব ৬৪*, তানজিদ ৩৫, মাহমুদউল্লাহ ২৫, জাকের ১৪*; মিকেরেন ২/১৫, দত্ত ২/১৭)।
নেদারল্যান্ডস: ২০ ওভারে ১৩৪/৮ (এঙ্গেলব্রেখট ৩৩, বিক্রম ২৬, এডওয়ার্ডস ২৫, লেভিট ১৮; রিশাদ ৩/৩৩, তাসকিন ২/৩০, মাহমুদউল্লাহ ১/৬, মোস্তাফিজ ১/১২, তানজিম ১/২৩)।
ফল: বাংলাদেশ ২৫ রানে জয়ী।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ: সাকিব আল হাসান।