বিজয় দিবসের রাতে বাংলাদেশের মেয়েদের ঐতিহাসিক জয়
২৪ ওভার শেষে ৯২ রান; শীর্ষ ৬ ব্যাটারকে হারিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা তখন ধুঁকছে। আর যাই হোক, যেকোনো পর্যায়ের ৫০ ওভারের ক্রিকেটে এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে ২৫১ রান তাড়া করে জেতা যেকোনো দলের পক্ষে কঠিন ব্যাপার। বাংলাদেশের এই বোলিং লাইনআপের বিপক্ষে কাজটা তো আরও কষ্টসাধ্য।
তবু নিগার সুলতানা কী সিরিয়াস! স্টাম্প মাইক্রোফোনের মাধ্যমে ভেসে আসা কথাগুলোতেই বোঝা যাচ্ছিল, বাংলাদেশ নারী দলের অধিনায়ক এক চুলও ছাড় দিতে নারাজ। প্রায় প্রতিটি বলের আগেই কিছু না কিছু বলছিলেন, ফিল্ডারদের পজিশন ঠিক করে দিচ্ছিলেন, দলকে সাহস জোগাচ্ছিলেন।
এরপর নিগার প্রোটিয়াদের নতুন দুই ব্যাটার এলিজ–মারি মাকর্স ও সিনালো জাফটাকে অন্যরকম পরীক্ষায় ফেলতে চাইলেন। দুই প্রান্তের বোলিংয়েই আনলেন পরিবর্তন—নাহিদা আক্তারের জায়গায় বোলিংয়ে এলেন ফাহিমা খাতুন, রাবেয়া খানের জায়গায় সুলতানা খাতুন। দুই খাতুন (ফাহিমা ও সুলতানা) মিলে ২ ওভারে দিলেন মাত্র ১ রান। তাতেই চাপটা আরও জেঁকে বসল স্বাগতিকদের ওপর, প্রয়োজনীয় রান রেট তরতরিয়ে বেড়ে চলার চাপ।
সেই চাপ থেকে পরিত্রাণ পেতে পরের ওভারে ফাহিমাকে লেট কাট করতে গিয়ে বোল্ড জাফটা। পরের বলেই নাহিদাকে ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন নতুন ব্যাটসম্যান নোনকুলুলেকো এমলাবা। হার নিশ্চিত জেনে অভিষিক্ত মার্কস এরপর মেরে খেলার চেষ্টা করলেন। তাতে শুধু ব্যবধানটাই কমল। দশে নামা মাসাবাটা ক্লাস আউট হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে মার্কস ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে এসে মারতে গিয়ে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে হলেন স্টাম্পড।
ব্যস, নিগারদের আর পায় কে! যিনি যেদিকে পারলেন, আনন্দের আতিশয্যে ছুটতে লাগলেন। উচ্ছ্বাস শেষে একত্রিত হয়ে গেলেন গ্যালারির (আসলে গ্রাস ব্যাংক) দিকে, সেখানে পতপত করে উড়তে থাকল প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়ে আসা লাল–সবুজ পতাকা। করাতালি দিয়ে সেটাকে সাধুবাদ জানালেন নিগাররা। বিজয় দিবসের রাতে এভাবেই চলতে থাকল মেয়েদের ঐতিহাসিক জয়ের উৎসব।
ইস্ট লন্ডনের বাফেলো পার্কে বাংলাদেশের করা ২৫০ রানের জবাবে দক্ষিণ আফ্রিকা থামল ১৩১ রানে। ১১৯ রানের জয়ে তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজে ১–০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল নিগারের দল। নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসে রানের নিরিখে এটাই বাংলাদেশের মেয়েদের সবচেয়ে বড় জয়; আগের বড় জয়টি ছিল এক যুগ আগে বিকেএসপিতে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ৮২ রানে।
এটি দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে বাংলাদেশের মেয়েদের প্রথম ওয়ানডে জয়ও। এই সংস্করণে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে আগের জয় দুটি ছিল মিরপুর ও কক্সবাজারে। আগামী বুধবার পচেফস্ট্রুমে পরের ম্যাচ জিতলেই প্রোটিয়াদের বিপক্ষে প্রথমবার সিরিজও নিজেদের করে নেবে নিগারের দল।
ঐতিহাসিক জয়ের রাতে বলতে গেলে রেকর্ডের বন্যা বইয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ নারী দল। আজ টস হেরে আগে ব্যাটিংয়ে নেমে ৩ উইকেট হারিয়ে তোলা ২৫০ রানই নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আগের সর্বোচ্চ ছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে ৭ উইকেটে ২৩৪; যা গত বছর নিউজিল্যান্ডের হ্যামিল্টনে ওয়ানডে বিশ্বকাপে করেছিল।
তিনে নামা মুর্শিদা খাতুনের অপরাজিত ৯১ রানের ইনিংসে ভর করে ওয়ানডেতে নিজেদের সর্বোচ্চ সংগ্রহের এই রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশ। মুর্শিদার এই ইনিংসটাও জায়গা করে নিয়েছে রেকর্ডের পাতায়। বিদেশের মাটিতে এটিই যে কোনো বাংলাদেশি নারীর ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ! তিনে নামা কোনো ব্যাটারেরও সেরা ইনিংস এটি। আর সব মিলিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
এ তালিকায় সবার ওপরে আছেন ওপেনার ফারজানা হক। গত জুলাইয়ে মিরপুরে ভারতের বিপক্ষে ফারজানা উপহার দিয়েছিলেন ১০৭ রানে ইনিংস, যা বাংলাদেশের মেয়েদের ওয়ানডে ইতিহাসে একমাত্র শতকেরও কীর্তি।
সেই ফারজানাকে সঙ্গে নিয়েই আজ বাংলাদেশকে দারুণ শুরু এনে দেন শামীমা সুলতানা। উদ্বোধনী জুটিতে দুজন করেন ৬৬ রান। ১৫তম ওভারে শামীমা আউট হলে নামেন মুর্শিদা। তখন থেকে ইনিংসের শেষ পর্যন্ত টিকে ছিলেন তিনি। ওপেনার ফারাজানা, অধিনায়ক নিগার ও স্বর্ণা আক্তারের সঙ্গে গড়েন তিনটি মূল্যবান জুটি।
শেষ ওভারে মাত্র এক বল খেলার সুযোগ পেয়েছেন মুর্শিদা, শেষ ওভারে তিন ওভারে স্ট্রাইক পেয়েছেন সাতবার। আরও কয়েকটি বল খেলার সুযোগ পেলে দ্বিতীয় বাংলাদেশি নারী ব্যাটার হিসেবে ওয়ানডে শতকও পেতে পারতেন। সেটা না হলেও আরেকটি রেকর্ড ঠিকই গড়েছেন মুর্শিদা। তাঁর ৯১ রানের মধ্যে ৪৮ রানই এসেছে বাউন্ডারি থেকে, যা কোনো বাংলাদেশি নারী ব্যাটারের বাউন্ডারি থেকে আসা সর্বোচ্চ রান। আগের সর্বোচ্চ ছিল সালমা খাতুনের। ২০১৩ সালে আহমেদাবাদে ভারতের বিপক্ষে তাঁর ৭৫ রানের ইনিংসের ৪৪ রান এসেছিল ১১টি চারের সৌজন্যে।
বাংলাদেশের শক্তিশালী বোলিং বিভাগের বিপক্ষে রান তাড়া করতে নেমে দাঁড়াতেই পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রোটিয়া মেয়েদের আসা–যাওয়ার মিছিলের শুরুটা হয়েছিল অধিনায়ক লরা ভলভার্টকে দিয়ে, শেষটা মার্কসকে দিয়ে। তৃতীয় উইকেটে আনেকে বোশ ও সুনে লুসের গড়া দলীয় সর্বোচ্চ ৪১ রানের জুটি আর অভিষিক্ত মার্কসের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ৩৫ রান যা একটু মান বাঁচিয়েছে। নয়তো ঘরের মাঠে হয়তো ১০০ রানের গণ্ডিটুকুও পেরোতে পারত না প্রোটিয়ারা। শুরু আর শেষের মাঝেও রয়েছে মিল। সুলতানার বলে ভলভার্ট আর নাহিদার বলে মার্কসকে স্টাম্পিং করেন অধিনায়ক নিগার।
এমন বিজয়ের রাত নিশ্চয় বারবার ফিরে পেতে চাইবেন বাংলাদেশের মেয়েরা।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
বাংলাদেশ নারী দল : ৫০ ওভারে ২৫০/৩
(মুর্শিদা ৯১*, নিগার ৩৮, ফারজানা ৩৫; এমলাবা ১/৩৭, টাকার ১/৪৩, মার্কস ১/৪৩)
দক্ষিণ আফ্রিকা নারী দল : ৩৬.৩ ওভারে ১৩১
(মার্কস ৩৫, লুস ৩১, বোশ ১৬; নাহিদা ৩/৩৩, ফাহিমা ২/১৬, রাবেয়া ২/২৪, সুলতানা ২/৩২)
ফল : বাংলাদেশ নারী দল ১১৯ রানে জয়ী।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ : মুর্শিদা খাতুন।
সিরিজ : তিন ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশ নারী দল ১–০ ব্যবধানে এগিয়ে।