টেন্ডুলকারের ১৫৯২১ ছাড়িয়ে যেতে রুটকে যা করতে হবে
এ রেকর্ড কোনো দিন ভাঙবে না!
২০১৩ সালের নভেম্বরে শচীন টেন্ডুলকার যখন ১৫৯২১ টেস্ট রান, ৫১ টেস্ট সেঞ্চুরি নিয়ে দুই যুগের বর্ণাঢ্য আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারকে বিদায় জানালেন, বেশির ভাগ মানুষই এমনটা ভেবেছিলেন।
না ভেবে উপায়ও ছিল না। সবচেয়ে বেশি টেস্ট রান ও সেঞ্চুরিতে টেন্ডুলকারের সবচেয়ে কাছে যিনি ছিলেন, সেই জ্যাক ক্যালিসও পিছিয়ে ছিলেন যোজন–যোজন দূরত্বে। ওই বছরেরই ডিসেম্বরে ক্যালিস টেস্টকে বিদায় জানিয়ে দেওয়ায় টেন্ডুলকারের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বলতে কেউ ছিলেন না। এরপর যে দুজন কিছুটা সম্ভাবনা জাগিয়েছিলেন, সেই কুমার সাঙ্গাকারা ও অ্যালিস্টার কুকও ক্যারিয়ার শেষ করেন টেন্ডুলকারের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেই।
এখন সাঙ্গাকারা আর কুক আশা দেখছেন আরেকজনকে নিয়ে। তিনি জো রুট। বিশ্ব ক্রিকেটের ‘ফ্যাবুলাস ফোর’–এর অন্যতম রুট শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সদ্য সমাপ্ত লর্ডস টেস্টের দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি করেছেন। পরশু ১০৩ রানের ইনিংসটি দিয়ে ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টেস্ট সেঞ্চুরির সংখ্যায় তিনি ছাড়িয়ে গেছেন কুককে। ৩৪টি সেঞ্চুরি করে শীর্ষে ওঠা রুটকেই ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান মানছেন কুক।
আর সাঙ্গাকারা মনে করছেন রুট যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন, তাতে শুধু জাতীয় রেকর্ড নয়; বিশ্ব রেকর্ডই করে ফেলবেন। তাঁর কথা, টেন্ডুলকারের সর্বাধিক টেস্ট রান ও সেঞ্চুরির বিশ্ব রেকর্ডটা রুট নিজের করে নিতে পারেন। ইংল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার ও ধারাভাষ্যকার ডেভিড লয়েডও সাঙ্গাকারার সুরে সুর মিলিয়েছেন।
টেস্টে রুটের সাম্প্রতিক ফর্মই সাবেকদের এমনটা ভাবতে বাধ্য করছে। এখন পর্যন্ত ১৪৫ ম্যাচে ২৬৫ ইনিংসে ৫০.৯৩ গড়ে ৩৪ সেঞ্চুরিতে ১২৩৭৭ রান করেছেন রুট। টেন্ডুলকার ২০০ ম্যাচে ৩২৯ ইনিংসে ৫৩.৭৮ গড়ে ৫১ সেঞ্চুরিতে ১৫৯২১ রান নিয়ে ক্যারিয়ারের ইতি টেনেছেন। রান সংখ্যায় ভারতীয় কিংবদন্তিকে টপকে যেতে ইংলিশ ব্যাটসম্যানের দরকার আরও ৩৫৪৫, সেঞ্চুরি করতে হবে আরও ১৮টি।
টেন্ডুলকার তাঁর শেষ টেস্ট খেলেছেন ৪০ বছর ৭ মাস ছুঁই ছুঁই বয়সে। রুটের বয়স এখন মাত্র ৩৩ বছর ৮ মাস। বয়স বিবেচনায় আরও প্রায় ৭ বছর টেস্ট খেললে অনায়াসেই টেন্ডুলকারের বিশ্ব রেকর্ড দুটি নিজের করে নেওয়ার কথা রুটের। চোটমুক্ত ও ফর্মের তুঙ্গে থাকলে আরও আগেই (বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ২০২৫–২৭ চক্রেই) তা হয়ে যেতে পারে।
বয়সের সঙ্গে টেস্টে রুটের ব্যাটিং ধার ও দায়িত্বশীলতা যেন সমানুপাতিকভাবে বাড়ছে। ক্রিকেটের বনেদি এই সংস্করণে ৩৪ সেঞ্চুরির অর্ধেকই (১৭টি) তিনি করেছেন গত ৩ বছরে। এ সময়ে তাঁর ব্যাটিং গড় ক্যারিয়ার গড়ের চেয়েও বেশি; ৫৬.৯২। ২০২১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত রান করেছেন সর্বোচ্চ ৪৫৫৪।
রুট সর্বশেষ ৩ বছরে নিজেকে এমনই এক ‘রান মেশিনে’ পরিণত করেছেন যে এ সময়ে সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রাহকের তালিকায় দুইয়ে থাকা উসমান খাজার রান তাঁর চেয়ে ১৯৯০ কম! বাজবল ক্রিকেটের সঙ্গেও দারুণভাবে মানিয়ে নিয়েছেন রুট। ব্রেন্ডন ম্যাককালামের কোচিংয়ে ৬৮.৬৩ স্ট্রাইক রেট সে কথাই বলছে।
অথচ ২০২১ সালের আগপর্যন্ত ‘ফ্যাবুলাস ফোর’-এর মধ্যে রুটের ব্যাটিং গড়ই ছিল সবচেয়ে কম। বিরাট কোহলির ৫৩.৪১, স্টিভেন স্মিথের ৬১.৩৩, কেইন উইলিয়ামসনের ৫২.৯০ গড়ের বিপরীতে তাঁর গড় ছিল ৪৯.৯৯। সেঞ্চুরিও ছিল এই তিনজনের চেয়ে কম। চতুষ্টয়ের তুলনা আনলে অনেকেই তাই রুটকেই সবার পেছনে রাখতেন।
টেস্টে রুটের এমন ধারাবাহিকভাবে রান করার অন্যতম কারণ, অন্য দুই সংস্করণ ওয়ানডে ও টি–টোয়েন্টি থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেওয়া। রুট সর্বশেষ আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলেছেন ২০১৯ সালে। আগামী দিনগুলোতে তাঁকে ইংল্যান্ডের জার্সিতে এই সংস্করণে খেলতে দেখা যাবে বলে মনে হয় না। এখনো অবসরের ঘোষণা না দিলেও তাই বলে দেওয়া যায়, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি তিনি একরকম ছেড়েই দিয়েছেন।
ওয়ানডেও খেলছেন বেছে বেছে। ২০১৯ বিশ্বকাপের পর ইংল্যান্ড ওয়ানডে খেলেছে ৫৪টি, রুট খেলেছেন প্রায় অর্ধেক; ২৮টি।
তবে ইংল্যান্ডের টেস্ট খেলা আর রুটের সেই দলে থাকা অনেকটা অবশ্যম্ভাবী ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। রুটের টেস্ট অভিষেক ২০১২ সালের ডিসেম্বরে। তাঁর প্রথম টেস্টের সময় থেকে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সদ্য সমাপ্ত লর্ডস টেস্ট পর্যন্ত ইংল্যান্ড খেলেছে ১৪৭তম টেস্ট। দীর্ঘ প্রায় এক যুগে রুট মিস করেছেন মাত্র দুটি টেস্ট!
২০২২ সালের এপ্রিলে অধিনায়কত্ব ছাড়ার পর বেশ নির্ভার রুট। তাই ব্যাটিংয়ে আরও মনোযোগী হওয়ার সময় পেয়েছেন। বিশেষ করে পাওয়ার হিটিং নিয়ে তিনি বেশ কাজ করেছেন। টেস্ট ক্যারিয়ারের ৪৪ ছক্কার ১৯টিই মেরেছেন নেতৃত্ব ছাড়ার পর; অর্থাৎ গত দুই বছরে।
রুটের বর্তমান ফর্ম বিশ্লেষণ করে বোঝা যাচ্ছে, ৫৬.৯২ গড়ে ব্যাট করলে টেন্ডুলকারের ১৫৯২১ রান ছাড়িয়ে যেতে রুটকে আরও ৩২ টেস্ট বা ৬৩ ইনিংস খেলতে হবে। তবে আগামী তিন বছর ইংল্যান্ড বর্তমান সময়ের চেয়ে অনেক কম টেস্ট খেলবে।
আইসিসির ভবিষ্যৎ সফর পরিকল্পনা (এফটিপি) অনুযায়ী, ২০২৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইংল্যান্ড ২৯টি টেস্ট খেলবে। সেই হিসাবে রুট সর্বোচ্চ ৫৮ বার ব্যাটিংয়ে নামার সুযোগ পেতে পারেন। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ২০২৫-২৭ চক্রের সূচি বর্তমান চক্র শেষ হওয়ার পর জানাবে আইসিসি। সূচি ঘোষণার পর ইংল্যান্ডের টেস্টের সংখ্যা কিছুটা বাড়তে পারে। রুটের বর্তমান ফর্ম বিবেচনায় সংখ্যাটা কিছুটা বাড়লেই চলবে।
তবে ইনিংসগুলোকে শতকে রূপান্তর করার হার বাড়াতে না পারলে টেন্ডুলকারের ৫১ সেঞ্চুরির রেকর্ড ভাঙতে আরও সময় লাগবে রুট। সর্বশেষ ৪৮ টেস্টে ৮৮ ইনিংসে তিনি করেছেন ১৭ সেঞ্চুরি। অর্থাৎ গড়ে প্রতি ৫.১৭ ইনিংস পরপর শতকের দেখা পেয়েছেন। ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ৫২ সেঞ্চুরি করতে চাইলে তাঁকে খেলতে হবে আরও অন্তত ৪৭ টেস্ট বা ৯৩ ইনিংস। ইংল্যান্ডের আরও ৪৭ টেস্ট খেলতে খেলতে ২০২৯ সাল লেগে যাবে। তত দিনে রুটের বয়স হবে প্রায় ৩৮ বছর।
রুট নিজে অবশ্য টেন্ডুলকারের রেকর্ড নিয়ে ভাবছেন না। নিজ লক্ষ্যের কথা জানাতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমি শুধু খেলে যেতে চাই, দলের জন্য রান করে যেতে চাই। আরও অনেক কিছু করার বাকি।’ রুটের এই কথাতেই স্পষ্ট, ব্যাট হাতে একের পর এক রেকর্ড গড়ে চললেও রানক্ষুধা একটুও কমেনি। এই ক্ষুধাই তাঁকে টেন্ডুলকারের ওপরে নিয়ে যেতে পারে।
রানে–সেঞ্চুরিতে রুট কি টেন্ডুলকারকে ছাড়িয়ে যেতে পারবেন? উত্তরটা সময়ের হাতেই তুলে রাখতে হচ্ছে।