গ্রাম থেকে এক ক্রিকেটভক্ত মুরব্বি প্রথমবারের মতো ঢাকায় ঘুরতে গেলেন। জাদুর শহরে বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলির মারপ্যাঁচে পড়ে তাঁর দিশা হারানোর দশা! কোন গলি কোথায় মিশেছে, সে হিসাব রাখাই দায়। বোনাস হিসেবে মোড়ে মোড়ে জ্যাম তো আছেই। মুরব্বি ফুটপাত দিয়ে দিগ্ভ্রান্ত নাবিকের মতো হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখলেন, এক লোক মাথায় করে টালি খাতা বিক্রি করছেন। শহুরে জীবনে খুব সাধারণ দৃশ্য, তবে এই দৃশ্যই মুরব্বির মাথায় বিপ্লব ঘটিয়ে দিল।
বিক্রেতাকে দাঁড় করিয়ে তিনি বেশ বড়সড় একটি খাতা কিনলেন, সঙ্গে কলম। রাস্তাঘাট মনে রাখতে ঢাকার যত অলি–উপ গলি–তস্য গলি খাতায় টুকে রাখবেন। ব্যস, ভাবনামতোই কাজ শুরু। টুকতে টুকতে মুরব্বির মনে হলো, আরে! জালের মতো ছড়িয়ে থাকা এই গলির শহর যে শুধু অসুবিধাই করছে তা তো নয়। মাথায় বুদ্ধি থাকলে এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে তা অন্য জায়গায় কাজেও লাগানো যায়!
আশি–নব্বইয়ের দশকের ক্রিকেট মুরব্বির ঠোঁটস্থ। টেস্ট–ওয়ানডেতে কার রান কত, কে কবে অবসর নিয়েছেন, হালকা করে মাথা চুলকে প্রায় সব বলে দিতে পারেন। তখন সুবিধাও ছিল। খেলা হতো মাত্র দুটি সংস্করণে। আর এখন? আন্তর্জাতিকে সংস্করণ তিনটি, এর বাইরে আছে আরও দুটি—দ্য হানড্রেড ও সিক্সটি। সেরের ওপর সোয়াসের হিসেবে টি–টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ তো আছেই। ক্রিকেট এখন ঢাকার গলি–উপ গলি–তস্য গলির মতোই, ঠাসা জ্যামের মতোই ঠাসা সূচি।
কে কোন ‘গলি’তে হাঁটছে, কোনটা ছাড়ছে আর কোনটায় হাঁটতে তাক করে আছে—সেসব হিসাব রাখা আর মাছের মায়ের ছেলেপুলে গুণে রাখা এক কথা! চুল–দাঁড়িতে পাক ধরলেও মুরব্বি মন ও মননে আধুনিক। পাঞ্জাবির পকেটে স্মার্টফোন। ফেসবুকেও ঘোরাফেরা হয়। ‘মুখবই’য়ে ঢুঁ মারতেই মুরব্বির চোখে পড়ল, সুরেশ রায়না সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে দেশের বাইরে টি–টোয়েন্টি লিগ খেলবেন। এ তো ভীষণ বেকায়দা! দেশের বাইরে টি–টোয়েন্টি লিগ কি তবে সব ধরনের ক্রিকেটের মধ্যে পড়ে না?
টুইটে রায়নাই তো লিখেছেন, ‘সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসর’—তাহলে! মুরব্বি মাথা চুলকাতে চুলকাতে একটা তিন মাথার গলিতে ট্রাফিক পুলিশের কায়দা–কসরতে তাকাতেই জটটা খুলে গেল। ঢাকার রাস্তায় চলাচলের কিছু নিয়ম আছে। ট্রাফিক পুলিশের নির্দেশ অমান্য করে এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তায় যাওয়া নিষেধ। আর ভারতীয় ক্রিকেটের অলিখিত নিয়ম হলো, আইপিএলও খেলবে, আবার দেশের বাইরেও টি–টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ খেলবে, তা হবে না। আগে ঘরোয়ায় অবসর নিতে হবে।
আচ্ছা, এই তাহলে বিষয়! পকেট থেকে দুটো পয়সা বের করে ভিক্ষুককে দেওয়ার সময় টালি খাতাটি উল্টেপাল্টে দেখার সময় তিনি আরেক বিপত্তিতে পড়লেন। খাতায় খোপ কাটা যতগুলো ঘর আছে, এখনকার ক্রিকেটের সংস্করণসংখ্যা তার চেয়ে বেশি!
নাহ, হবে না। এভাবেও হবে না। মুরব্বি ব্যর্থ মনোরথে বাসায় ফিরলেন। বাসায় আদরের নাতি ক্রিকেটের পোকা। তাঁকে দেখলে মুরব্বির নিজের কৈশোর মনে পড়ে। খেলোয়াড়দের পেপারকাটিং, তথ্যপঞ্জি কেটে রাখতে রাখতে তাঁর মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। এখনো মনে পড়ে, ভিভ রিচার্ডস অবসর নেওয়ার দিন কী খারাপটা–ই না লেগেছিল! ইমরান খান, রিচার্ড হ্যাডলি, কপিল দেব—তাঁদের খেলা ছাড়ার দিনটাও মনে আছে। অনুভূতি সেই একই। প্রস্থান আর যা–ই হোক, হাসি–তামাশার বিষয় হতে পারে না। কিন্তু নাতিকে দেখে তাঁর ভুল ভাঙল।
নাতির কক্ষে ঢুকে মুরব্বি দেখলেন, তাঁর উত্তর–আধুনিক বংশপ্রদীপ কম্পিউটারে কষিটানা পাতার মধ্যে কী সব তথ্য টুকে রাখছে। কাছে গিয়ে ভালো করে দেখতেই বুঝলেন, সুরেশ রায়না! কী বিষয়, জানতে চাইতেই নির্মোহ জবাব এল, ‘আন্তর্জাতিক ও আইপিএলের চ্যাপটার ক্লোজ করে দিলাম। টি–টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের জন্য আলাদা ঘর কেটে রাখলাম।’ মুরব্বি জানেন, তথ্যপ্রযুক্তির এই দুনিয়া অনেক এগিয়েছে, পেপার কাটিং জমিয়ে রাখার সেই দিনও ফুরিয়েছে, কিন্তু এখন খেলোয়াড়দের বিভিন্ন সংস্করণের নানামুখী তথ্যপঞ্জি কম্পিউটারে টুকে রাখা যে এত সহজ, তা তো খেয়াল করেননি! চটপটে নাতিটি মুরব্বির টালি খাতা ছুড়ে ফেলে রসিকতার সুরেই বলল, মাইক্রোসফট এক্সেল আছে না!
মুরব্বি ভাবলেন, রোসো! এবার জব্দ করতে হয়। জিজ্ঞেস করলেন, ‘বল তো মুশফিকুর রহিমের ব্যাটিং গড় কত?’ পাল্টা প্রশ্ন এল, ‘কোন সংস্করণে? টেস্ট, ওয়ানডে না টি–টোয়েন্টি?’ কিছুদিন আগে কিন্তু আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টি থেকে অবসর নিয়েছে। নাতি এরপর এক্সেল শিটে তাকিয়ে পটপট করে সব সংস্করণের ব্যাটিং গড় বলার পর যোগ করল, অবশেষে তাঁর বোধোদয় হলো! মুরব্বি অবাক। কথার কী ছিরি! দেশের হয়ে দীর্ঘদিন খেলার পর একজন ক্রিকেটারের অবসর নিয়েছে। নাহয় একটা সংস্করণ থেকেই নিয়েছে। তাই বলে এভাবে বলতে হবে, বলা যায়!
নাতি সোজাসাপটা বলে দিল, ‘আরে দাদু, এখন খেলারও অভাব নেই, খেলোয়াড়ের তো নেই–ই। কে কবে কোন সংস্করণ থেকে অবসর নিল, এখন সেই হিসাব রাখাই কষ্ট। তাই এক্সেল শিটে সব টুকে রাখি। সবকিছু মনে রেখে এত আবেগ দেখানোর সময় কোথায়! আর যত দিনই খেলুক, জমানা টি–টোয়েন্টির, বলতে পারো “গিভ অ্যান্ড টেক”—দিন শেষে স্ট্রাইকরেট, রান, গড় আর উইকেটই তো মুখ্য।’ মুরব্বি ভাবেন, ক্রিকেট নিয়ে লোকে এত নির্মোহ হলে কবে থেকে! নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকেও তো এমন ছিল না। হ্যাঁ, একটা নিদান আছে। শহীদ আফ্রিদি!
পাকিস্তানি অলরাউন্ডার ক্যারিয়ারে কতবার অবসর নিয়েছেন, সে হিসাব অন্তত নাতির ছুড়ে ফেলা টালি খাতায় রাখা সম্ভব। আসলে একসময় অবসর বিষয়টি ছিল এমন, যখন যাবে তখন বাকিদের খারাপ লাগবে। কিন্তু আফ্রিদি অবসর নামের ‘লেবু’ কচলে কচলে তেতো বানানোর পর থেকেই কি এর ওপর থেকে লোকের ভক্তি–শ্রদ্ধা উঠে গেল
মুরব্বি ভাবেন আর শুধু ভাবেন। সংস্করণ দুটি থেকে তিনটি হলো, শেষটি তো মারাত্মক, শুধু টাকাই টাকা! সেই সংস্করণ থেকেও বের হলো আরও দুটি—হানড্রেড ও সিক্সটি। এখানেও টাকা আর টাকা। খেলোয়াড়েরা তাই এখন গোপনে গোপনে একেকজন হিসাবরক্ষক—কোনটা খেললে বেশি টাকা তা হিসাব করেই ঘোষণাটা আসে। ক্যারিয়ারের শেষ দিকে তো ওয়ানডে–টেস্ট ছেড়েছুড়ে টি–টোয়েন্টি আর ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগকেই সবাই পাখির চোখ করছে। গোটা বিষয়টি যে টাকার জন্য, লোকে তা বোঝে বলেই হয়তো এখন কারও অবসরে আর চোখ মোছে না। হিসাব রাখারও বালাই নেই। সবাই জানে, এত সংস্করণে কে কবে অবসর নিল তা মনে রাখা বেগার খাটারই নামান্তর।
আজ ছাড়ছে তো কাল ফিরতেও পারে! আর ইন্টারনেট তো আছেই। দরকারমতো ক্লিক করলেই চোখের সামনে সব তথ্য চলে আসছে। অতএব, খামোখা মনে রেখে মনের ওপর চাপ তৈরি করার কী দরকার! খেলাটা এখন যেহেতু অনেকটাই ‘যান্ত্রিক’, তার সব খুঁটিনাটি তথ্য মনে রাখতেও যন্ত্র আছে, আর দর্শকেরাও নির্মোহ চোখে যন্ত্রের মতো সব দেখছেন। খেলোয়াড় অবসর নিলে তাঁর জন্য আক্ষেপ যতটা ঝরছে, তার চেয়ে রঙ্গরসিকতা হচ্ছে বেশি। ক্রিকেটের বিনোদন দেওয়া আর ব্যস্ত দর্শকদের নেওয়ার ধরনও পাল্টে যাওয়ায় এখন আর কেউ গোপনে অশ্রু ফেলার বিলাসিতাও করে না। তার চেয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাসে লাভ বেশি। নাতির মুখ থেকে এসব কথা শুনে মুরব্বির দম বন্ধ হয়ে আসে। ঘর ছেড়ে আবারও বাইরে বের হন। একটু দম নেওয়া দরকার।
ক্রিকেটারদের জন্যও তাঁর মায়া হয়। পরিবারকে সময় দিয়ে এত এত সংস্করণে খেলার সময় কোথায়! তাঁর নাতিটি বলছিল, ‘তোমাদের যুগের অবসর কাটানোর অনুষঙ্গ খেলাটিকে শিল্পবিপ্লবে পরিণত করেছে সবাই। হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া সাদা পোশাকের প্রতি সবাই মুখে মুখে যে ভালোবাসা তা দেখায়, তা মুখেই মরে যায়। হৃদয় পর্যন্ত আর আসে না। খেলোয়াড়েরা এখন হৃদয়ে টি–টোয়েন্টি নিয়ে মুখে টেস্টের প্রতি ভালোবাসা দেখায়—এটাই “ট্রেন্ড”।’ মুরব্বি জানতে চেয়েছিলেন, ট্রেন্ড কী জিনিস? নাতির সপাট উত্তর—যখন যা চলে!
বাবার বলা একটা কথা মনে পড়ে মুরব্বির। গ্রামে বাড়ির সামনে চাষাবাদের জমি দেখিয়ে তাঁর বাবা অনেক আগে বলেছিলেন, ‘এই জমি চাষ করে আমি যে ফসল পেয়েছি, তোরা সার–বিষ দিয়ে তার চেয়ে বেশি পাবি। তোর ছেলে সার–বিষ ও হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করে তোর চেয়েও বেশি ফলন পাবে। তারপর আরও বেশি...।’ মানুষ এভাবে একদিন পৃথিবীর সব চাষযোগ্য জমির সবটুকু নিংড়ে নিয়ে থামবে! তারপর?
মুরব্বি ভাবেন, টেস্ট থেকে ওয়ানডে, তারপর টি–টোয়েন্টি, এখন হানড্রেড ও সিক্সটি—যে ক্রিকেটে লোকে একসময় টেস্টে মাঝেমধ্যে চার–ছক্কা দেখে বিমল আনন্দ পেত, ওয়ানডে এসে সেই আনন্দ দ্বিগুণ করল, টি–টোয়েন্টি আসার পর ‘ডট’ বল আগাছা হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় এখন তো ২০ ওভারের পুরোটাই আনন্দ! তবে আনন্দ বেশি হলে যা হয়, হানড্রেড ও সিক্সটি আসার পর তা বোঝা যাচ্ছে। মিস্টি বেশি খেলে যেমন মুখ মেরে যায়, এত এত সংস্করণ দেখে লোকেরও তেমনি মুখ মেরে যাচ্ছে। তাই ক্রিকেট আকাশে কোথায়, কবে কোন তারা খসে পড়ল, লোকে তা কেন মনে রাখবে!
গ্রাম থেকে যেমন নগর, নগর থেকে হয়তো আরও উন্নত সভ্যতা বের করে ফেলবে মানুষ। এটাই সভ্যতার শুরু থেকে শেষের প্রক্রিয়া। পৃথিবীকে নিংড়ে–শুষে যতটুকু নেওয়া যায়। ক্রিকেটও তেমনই। তবে কোন ধাপে আছে, তা ভাবতেই মুরব্বির গা শিউরে উঠল আর মায়া হলো নাতির জন্য।
( চরিত্র দুটি কাল্পনিক। জীবিত কিংবা মৃত কোনো ব্যক্তির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।)