অন্য আরেকটা সাধারণ দিনের মতোই শুরু হয়েছিল সেদিনের সকালটা। অনেকটা টেস্ট ম্যাচের ধীরলয়ের আবহে। কে জানে, শীত পেরোনো মার্চের সকালে লাহোরের রাস্তাতেও হয়তো লুটোপুটি খাচ্ছিল শুকনো পাতা। গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের ভেতরের চিত্রটাও অনেকটা তেমনই। রুক্ষ-শুষ্ক উইকেটে দুই দিনেই শ্রীলঙ্কার সংগ্রহ ৬০৬।
থিলান সামারাবীরা করেছেন ডাবল সেঞ্চুরি, সেঞ্চুরি পেয়েছেন কুমার সাঙ্গাকারা ও তিলকরত্নে দিলশান। জবাবে সালমান বাটের উইকেট হারিয়ে পাকিস্তানের সংগ্রহ ১০১ রান। ম্যাড়মেড়ে টেস্টে উত্তেজনা ফেরাতে তৃতীয় দিন অলৌকিক কিছুরই যেন দরকার পড়ছিল। কিন্তু কে জানত, সেই অলৌকিক কিছু এমন একটি ঘটনার মধ্যে দিয়ে হাজির হবে, যা কিনা পাকিস্তান ক্রিকেটের তো বটেই, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অনেক হিসাব-নিকাশ বদলে দেবে।
সেদিন ১২ জন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী হামলা চালায় স্টেডিয়ামমুখী শ্রীলঙ্কার টিম বাসে। সেই হামলায় ৬ পুলিশ সদস্য এবং ২ জন সাধারণ মানুষ নিহত হন। আহত হন শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক মাহেলা জয়াবর্ধনে, সহ-অধিনায়ক কুমার সাঙ্গাকারা, পেসার চামিন্ডা ভাসসহ ছয় ক্রিকেটার। সেই হামলা স্তব্ধ করে দিয়েছিল গোটা ক্রিকেট দুনিয়াকে। যার প্রভাব হয়েছিল সুদূরপ্রসারী।
এ ঘটনার পর পুরোপুরিভাবে বদলে যায় পাকিস্তানের ক্রিকেটের চিত্র। ক্রিকেট-পাগল দেশটিতে আকস্মিকভাবেই নেমে আসে গভীর এক অন্ধকারের যুগ। সন্ত্রাসী হামলার এ ঘটনা কেমন প্রভাব ফেলেছিল, তা জানাতে গিয়ে পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক ও পিসিবির সাবেক চেয়ারম্যান রমিজ রাজা বলেছিলেন, ‘এ ঘটনা গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল এবং আমাদের শিক্ষা দিয়েছিল যে কোনো কিছুকেই নিশ্চিত ধরে নেওয়ার সুযোগ নেই।’
এ ঘটনার পর পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নিষিদ্ধ হয়ে যায়। যার প্রভাব পড়ে দেশটির ঘরোয়া ক্রিকেটেও। সে সঙ্গে ‘নিরাপত্তা’ শব্দটিও ক্রিকেটের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়। পাকিস্তানে ঘটনা ঘটলেও প্রভাব পড়ে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতেও। আগেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে খেলা নিয়ে বাইরের দেশগুলোর মধ্যে একটা চাপা অস্বস্তি কাজ করত।
লাহোর-হামলা সেই অস্বস্তিকে চরম নেতিবাচকতায় রূপ দেয়। হামলার কদিন পর পাকিস্তানের প্রখ্যাত লেখক-তাত্ত্বিক তারিক আলী ‘আফটার লাহোর’ শিরোনামের একটি লেখায় এ ঘটনার প্রভাব নিয়ে লিখেছিলেন, ‘শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট দলের ওপর হামলার ঘটনার ক্ষয়ক্ষতিই হবে পাকিস্তান ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ। আশাবাদী অনেক মানুষ মিউনিখে সন্ত্রাসী হামলার পর ১৯৭২ সালের অলিম্পিক বন্ধ না করার উদাহরণ দিচ্ছে, তবে আমার সন্দেহ হয়, এ ঘটনার পর জিম্বাবুয়ে দলকেও আর লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে খেলতে আনার ব্যাপারে রাজি করা যাবে!’
তারিক আলীর এ ভবিষ্যৎ-দর্শন যে মোটেই ভুল ছিল না, তার প্রমাণ পেতে খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। সেই লেখায় তারিক আলী লাহোর হামলার প্রভাবকে আরেকটু বিস্তৃতভাবে দেখার চেষ্টা করেন। এক জায়গায় তিনি লেখেন, ‘পাকিস্তানের বস্তিতে ক্রিকেট খুবই জনপ্রিয়। পাকিস্তান এখন বিদেশে গিয়ে খেলবে। প্রতিটি হোম ম্যাচ এখন একেকটি অ্যাওয়ে ম্যাচ। অনেক দরিদ্র মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই, কোনো টেলিভিশন নেই। তাদের জন্য এখন ক্রিকেটও নেই।’
এ হামলার পর পাকিস্তানের ক্রিকেট-কাঠামো একরকম ধসে পড়ে। ধ্বংস হতে থাকে ক্রিকেটকে ঘিরে গড়ে ওঠা সংস্কৃতিও। এ ঘটনার পর পাকিস্তানের ক্রিকেট মাঠগুলোও আর ক্রিকেট মাঠ থাকেনি। সাবেক অধিনায়ক শহীদ আফ্রিদির কথাটা মনে পড়ে যায়, ‘আমাদের মাঠগুলো বিয়ের কমিউনিটি সেন্টারে পরিণত হয়েছিল। আমরা আমাদের মাঠে খেলতে চেয়েছিলাম। এটা পাকিস্তান ক্রিকেটের জন্য কঠিন একটা সময় ছিল। আমরা নিজেদের দর্শককে মিস করছিলাম।’
সেই সময়টায় পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা অন্য দেশের ক্রিকেটারদের পাকিস্তানে এসে খেলার জন্য কাকুতি-মিনতিও করেছেন। যা জানা যায় আফ্রিদির মাধ্যমেই, ‘আমরা যখন বিভিন্ন লিগে খেলতে যেতাম, তখন অন্য দেশের ক্রিকেটারদের পাকিস্তানে এসে ক্রিকেট খেলতে অনুরোধ করতাম।’
একজন পেশাদার ক্রিকেটারের জন্য নিজ দেশে ক্রিকেট খেলতে না পারা দুর্বিষহ এক অভিজ্ঞতা। যা জন্ম দেয় একধরনের অস্তিত্বসংকট ও হীনম্মন্যতার।
সেই চিত্রটা কতটা করুণ, তা ফুটে উঠেছিল হামলার পর পাকিস্তানের আরেক সাবেক অধিনায়ক ইউনিস খানের কথায়, ‘আমি ইমরান খান, জাভেদ মিয়াঁদাদ এবং ওয়াসিম আকরামকে বিদেশের দুর্দান্ত দলগুলোর বিপক্ষে খেলতে দেখে বড় হয়েছি। তাঁদের কারণে, তাঁদের খেলতে দেখে আমিও খেলা শুরু করেছিলাম। কিন্তু কী হবে যদি কেউ পাকিস্তানে না আসে? কীভাবে তরুণেরা এ খেলা সম্পর্কে জানবে? তারা কী করবে?আইসিসি ও সংশ্লিষ্টদের জন্য এটা বলা সহজ যে পাকিস্তানে কোনো ক্রিকেট হবে না। তবে পাকিস্তানের কাছ থেকে ক্রিকেট কেড়ে নেওয়া হলে, এর ভবিষ্যৎ ভালো হবে না।’
এই ভবিষ্যদ্বাণী একেবারেই মিথ্যা ছিল না। পাকিস্তানে ক্রিকেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশটির ক্রিকেটে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে। একের পর এক নির্ধারিত সিরিজ বাতিল হয় এবং একপর্যায়ে পাকাপাকিভাবে পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বন্ধ হয়ে যায়। ২০১১ সালের বিশ্বকাপের সহ-আয়োজকের তালিকা থেকেও বাদ পড়ে পাকিস্তান। এমনকি আয়োজক কমিটির অফিস লাহোর থেকে সরিয়ে আনা হয় মুম্বাইয়ে। পাকিস্তানে যে ১৪টি ম্যাচ আয়োজনের কথা ছিল, সেগুলো ভাগ করে দিয়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কাকে। অনেক ক্রিকেটারের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে নিজ দেশে কোনো ম্যাচ না খেলেই। এর আর্থিক ক্ষতির কথা তো বলাই বাহুল্য।
লাহোর হামলায় পরবর্তী প্রভাব নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। অনেক হিসাব-নিকাশ ও যুক্তিতর্ক উঠে এসেছে। তবে এ হামলায় সরাসরি ক্ষতি যাঁদের হয়েছে, তাঁদের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
সাবেক লঙ্কান অধিনায়ক কুমার সাঙ্গাকারার মুখেই শোনা যাক, ‘আমার মনে হয় না, কোনো ফ্ল্যাশব্যাকের প্রয়োজন আছে। কারণ, আমি সেই দিনটি এবং সেই মুহূর্তগুলো স্পষ্ট মনে করতে পারি। এটা এমন কিছু না যে আমি যেটাকে পুনরুজ্জীবিত করি কিংবা অনুভব করি। কিন্তু এটা এমন অভিজ্ঞতা, যা ভোলা উচিত নয়। কারণ, এটা আপনাকে জীবন এবং খেলা সম্পর্কে একটা দৃষ্টিভঙ্গি দেয়। আপনি মূল্যবোধ এবং চরিত্র সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারেন। পাশাপাশি অন্যদের সম্পর্কেও।’
হ্যাঁ, লাহোর হামলার দুঃস্মৃতি কবর দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফিরেছে পাকিস্তানে। বড় দলগুলোও এখন নিয়মিত পাকিস্তানে ক্রিকেট খেলতে যাচ্ছে। কিন্তু এ হামলার কারণে পাকিস্তানের ক্রিকেট থেকে হারিয়ে যাওয়া সময়টা আর কখনো ফিরে আসবে না। ক্রিকেট-পাগল একটা জাতির ক্রিকেটহীন হয়ে পড়ার যন্ত্রণাটাও কেউ আর পুষিয়ে দিতে পারবে না। করাচি, লাহোর, মুলতান কিংবা রাওয়ালপিন্ডিতে না লেখা ক্রিকেট মহাকাব্যগুলোও কেউ আর ফিরিয়ে দিতে পারবে না। শুধু খেলা ছাপিয়ে জীবনের বড় হয়ে ওঠার শিক্ষাটাই অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনার একমাত্র অর্জন। অনেক হারানোর ভিড়ে সেটিই শুধু থেকে যাবে।