ব্যাটিং স্বর্গেও কেন এমন ব্যাটিং
একই মাঠ, একই রকমের উইকেট। অথচ আফগানিস্তান, পাকিস্তান দুই ম্যাচে বাংলাদেশের ব্যাটিং হলো পুরো বিপরীত। প্রথমটিতে দুই সেঞ্চুরিসহ ৩৩৪ রান করে ৮৯ রানে জয়। আর আজ যেন উল্টো ব্যাটিংই ভুলে গিয়ে ইনিংসের ১১.২ ওভার বাকি থাকতে ১৯৩ রানে অলআউট বাংলাদেশ!
গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের ব্যাটিং উইকেটে এত কম রান করে জেতার স্বপ্ন দেখাও বাড়াবাড়ি, তা–ও আবার প্রতিপক্ষ দল যখন খেলছে ঘরের মাঠে এবং গ্যালারিভর্তি চেনা দর্শকের সামনে। সুপার ফোরের বাকি ম্যাচগুলো খেলতে আগামীকাল কলম্বো যাওয়ার আগে বাংলাদেশের সঙ্গী হচ্ছে তাই ৭ উইকেটের বড় ব্যবধানে হার।
লাহোরে বাংলাদেশের দুই ম্যাচের মাঝেও একটা খেলা হয়ে গেছে। গতকাল শ্রীলঙ্কা–আফগানিস্তান দুই দলই দেখিয়েছে এই উইকেটে চাইলেই রান করা সম্ভব। তাহলে আজ সুপার ফোরের প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ দুই শর দেখাও পেল না কেন?
বাংলাদেশের ব্যাটিং নিয়ে কাটাছেঁড়া করলে দুই রকম সিদ্ধান্তেই পৌঁছানো যাবে। প্রথমত, ব্যাটিং–স্বর্গে ব্যাটিংটাকে উপভোগ্য করে তোলার সূত্রটা হয়তো জানা নেই ব্যাটসম্যানদের। উইকেট যত ব্যাটিং সহায়কই হোক, রান তো ভালো ব্যাটিং করেই করতে হয়। প্রশ্নটা ওখানেই, আফগানিস্তানের বিপক্ষে ও রকম দুর্দান্ত ব্যাটিং তাহলে কীভাবে করেছিল বাংলাদেশ? মেহেদী হাসান মিরাজ আর নাজমুল হোসেনের সেঞ্চুরির পাশাপাশি অন্যরাও যতটুকু উইকেটে ছিলেন, দাপট দেখিয়েই তো খেলে গেছেন।
পাকিস্তানের গতিময় বোলিংয়ের বিপক্ষে কালকের ব্যাটিং তাহলে কি এই বার্তাটাই দিচ্ছে যে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের সামর্থ্য থাকলেও সেটার প্রকাশ পুরোপুরিই নির্ভরশীল প্রতিপক্ষের বোলিংয়ের ওপর?
প্রতিপক্ষ শিবিরে আগুন ছোড়ার বোলার থাকলে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের পাল্টা জবাব দেওয়ার সামর্থ্যটা কি তাহলে ব্যাটিং উইকেটেও সীমিত হয়ে পড়ে? ক্যান্ডিতে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের পর এ ম্যাচেও পাকিস্তানের পেসাররা তুলে নিয়েছেন বাংলাদেশের প্রায় সব উইকেট। ভারতের ১০ উইকেটই পেয়েছিলেন পেসাররা, আজ নিলেন ৯টি। অফ স্পিনার ইফতিখার আহমেদ শামীম হোসেনকে না ফেরালে পরপর দ্বিতীয় ম্যাচে পাকিস্তানের হয়ে শুধু পেসাররাই নিতেন প্রতিপক্ষের সব উইকেট।
সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে পারা এবং না পারা দুটোরই অবশ্য উদাহরণ খুঁজে পাবেন বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে। সাকিব আল হাসানের ব্যাটিংটা মনে করে দেখুন। পাকিস্তানের পেসারদের গতিকে কাজে লাগিয়েছেন অধিনায়ক রান তোলার ক্ষেত্রে। বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলে প্রতিরোধের দেয়াল তুলে পাল্টা আক্রমণে গেছেন, ফিফটিও করেছেন।
অভিজ্ঞতাই যেন তাঁকে বলে দিয়েছে, এই উইকেটে কেমন ব্যাটিং করতে হবে। আরেক অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিমও যতক্ষণ উইকেটে ছিলেন, মনে হচ্ছিল তিনিও পারবেন উইকেটের সুবিধা নিয়ে বাকিদের সঙ্গে রেখে রানটাকে ভালো জায়গায় নিয়ে যেতে।
শেষ পর্যন্ত সাকিব, মুশফিক কেউই তা পারেননি। অভিজ্ঞতার প্রতি অবিচার করে দুজনই ফিফটির পরপর ফিরে গেছেন ড্রেসিংরুমে। ৪৭ রানে ৪ উইকেট হারানো বাংলাদেশকে একপর্যায়ে তাঁদের জুটি ভরসা জাগালেও সেটাকে ঠিক ১০০–তে নিয়েই ফাহিম আশরাফের শর্ট বলের ফাঁদে পা দেন সাকিব। পুল খেলতে গিয়ে ক্যাচ মিড উইকেটে। এরপরও মুশফিক পারতেন ইনিংসটাকে টেনে নিয়ে যাওয়ায় নেতৃত্ব দিতে। লাহোরের উইকেটে কাজটা খুব কঠিনও ছিল না। মুশফিক ক্রিজে থাকলেই হতো। কিন্তু অন্যদের ভরসা দেবেন কী, সাকিবের পর আর এক উইকেট (শামীম) পড়ার পর হারিস রউফকে ডাউন দ্য উইকেটে খেলতে গিয়ে তিনি নিজেই কট বিহাইন্ড।
আউট হওয়ার আগপর্যন্ত যেভাবে খেলছিলেন, তাতে সাকিবের ৫৭ বলে ৫৩ বা মুশফিকের ৮৭ বলে ৬৪ রানের দুটি ইনিংসই বড় হতে পারত আরও। পাকিস্তানকেও তখন হয়তো আরেকটু কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলা যেত। উইকেটে থিতু হয়ে গিয়েও সহজ উইকেটে বড় কিছু করতে না পারার দায় যেমন সাকিব, মুশফিকের; উইকেটের বন্ধুতা কাজে লাগাতে ব্যর্থ অন্যরাও।
বাংলাদেশের ব্যাটিং অবশ্য শুরুতেই চমক দিয়েছে। টানা তৃতীয় ম্যাচে টসে জিতে প্রচণ্ড গরমের কারণে আজও আগে ব্যাটিং নেন বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব। কিন্তু লিটন দাস দলে ফেরার পরও ওপেনিংয়ে আরেকবার মিরাজকে দেখে অবাক হওয়ার পালা। সন্দেহ নেই, মেকশিফট ওপেনার হিসেবে আগের ম্যাচে সেঞ্চুরি করারই পুরস্কার। তা ছাড়া নাজমুল হোসেন ছিটকে পড়ায় ৩ নম্বরে হয়তো লিটনকেই বেশি নির্ভরযোগ্য মনে হয়েছে টিম ম্যানেজমেন্টের।
কিন্তু শাহিন শাহ আফ্রিদি–নাসিম শাহদের মতো পেসারদের সামনে মোহাম্মদ নাঈম আর মিরাজের মতো ওপেনিং জুটি মানে তো বিশ্বের অন্যতম ক্ষুরধার পেস বোলিংয়ের সামনে বিশ্বের অন্যতম অনভিজ্ঞ ওপেনিং জুটিকে ঠেলে দেওয়া!
তাঁরা বড় কিছু করলেই বরং অবাক হতে হতো। সেই বিস্ময় উপহার না দিয়ে মিরাজ নাসিমের করা ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলেই জীবনে প্রথমবারের মতো ওয়ানডেতে পেলেন ‘গোল্ডেন ডাক।’
টুর্নামেন্টে প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমে লিটন আত্মবিশ্বাসী কিছু শটে ভালো শুরু পেয়েছিলেন। ১৩ বলে চার বাউন্ডারিতেই ১৬ রান, যার দুটিই নাসিমের এক ওভারে। কিন্তু লিটন সেই শুরুটা ধরে রাখতে পারেননি। আফ্রিদির অফ স্টাম্পের বাইরে লাফিয়ে ওঠা বলে খোঁচা দিয়ে হয়ে যান কট বিহাইন্ড। নাঈম আরও একবার ভালো শুরু করেও পারেননি। আর তাওহিদ হৃদয়ের তো এশিয়া কাপটাই যাচ্ছে ফ্লপ।
সাকিব–মুশফিকের ১০০ রানের জুটির পর আরও একটি বিপর্যয়েই মাত্র ৪৫ রানে বাংলাদেশ হারায় শেষ ৬ উইকেট। টানা জয়ের মধ্যে থাকা বাবর আজমের দলের কাছে গাদ্দাফিতে ১৯৩ রান কোনো লক্ষ্যই নয় আসলে। তারপরও বাংলাদেশের বোলারদের সান্ত্বনা, দুই পেসার শরীফুল ইসলাম ও তাসকিন আহমেদ এবং অফ স্পিনার মিরাজ মিলে ফেরাতে পেরেছেন পাকিস্তানের তিন ব্যাটসম্যান ফখর জামান, ইমাম–উল–হক ও বাবরকে।
তবে ৩ উইকেট হারানোর পথেও কখনো মনে হয়নি পাকিস্তান ছিটকে যাবে জয়ের পথ থেকে। ৭৪ রানে দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে বাবরের বিদায়, এরপর তৃতীয় উইকেটে ইমাম–উল–হক এবং মোহাম্মদ রিজওয়ানের ৮৫ রানের জুটিতেই জয়ের কাছাকাছি চলে যায় পাকিস্তান।
ইমাম–উল–হক ৭৮ রান করে ফিরে গেলেও অপরাজিত ৬৩ রান নিয়ে রিজওয়ান ফিরেছেন সুপার ফোরে দলকে প্রথম জয় উপহার দিয়েই। এ রকম একটা একপেশে ম্যাচের পর বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইনআপের বিপক্ষে বাংলাদেশ কেন আরেকজন বোলার নিল না, হঠাৎ ফ্লাডলাইটের আলো কমে যাওয়ায় ১৮ মিনিটের মতো খেলা বন্ধ থাকা—এসব নিয়ে কথা বলা বাতুলতা মাত্র। খেলা তো শেষ আসলে বাংলাদেশের ইনিংসের পরই! গাদ্দাফির উইকেটে বাকিটা ছিল কেবলই আনুষ্ঠানিকতা।