ইনসাইড এজ: ক্রিকেটের অন্ধকার অন্দরমহলে যা ঘটে

নতুন আরেকটা আইপিএল মৌসুম, নতুন করে আবার ভারতজুড়ে টি-টোয়েন্টির উন্মাদনা। কিংবা বিশ্বজুড়েই হয়তো। আইপিএল তো এখন আর শুধু ভারতের ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি লিগ নয়, অনেকটাই বৈশ্বিক হয়ে গেছে। উন্মাদনা-উত্তেজনায় এটি আইসিসির যেকোনো টুর্নামেন্টকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতোই।

কিন্তু যে টুর্নামেন্ট নিয়ে এত মাতামাতি, তার ভেতরে কী ঘটে? টেলিভিশনের পর্দায় আর মাঠে বসে দর্শক যা দেখেন, তার কতটা সত্যি, কতটা পরিকল্পিত? এখানে কি শুধুই ক্রিকেট চলে, নাকি এর ভেতরেও আছে এক জটিল রাজনীতি, অদৃশ্য শক্তির লড়াই, অবিশ্বাসের অন্ধকার গলি?

‘ইনসাইড এজ’ আমাদের নিয়ে যায় সেই অদেখা পৃথিবীর গহিনে, যেখানে খেলোয়াড়েরা শুধু মাঠে ব্যাট-বল নিয়ে লড়াই করেন না, বরং বিশাল এক ক্ষমতার দাবা খেলায় তারা কখনো ঘুঁটি, কখনো ঘুঁটিবাজ। অ্যামাজন প্রাইমের এই ওয়েব সিরিজ আমাদের নিয়ে যায় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ঝলমলে দুনিয়ার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার অন্দরমহলে।

‘ইনসাইড এজ’ এর একটি দৃশ্য
আইএমডিবি

‘ইনসাইড এজ’ প্রথম সিজনের প্রথম পর্বটা শুরুই হয় একটা যৌনদৃশ্য দিয়ে। পরের দৃশ্যটা মাঠে খেলার। ম্যাচ চলছে। কিছুক্ষণ পর দর্শক বুঝতে পারেন, মাঠে যে দল খেলছে, সেই দলের এক ব্যাটসম্যান তখন লকার রুমে এক চিয়ারলিডারের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত। ক্রিকেটের অন্ধকার গলিতে তখনই প্রথম চোখ পড়ে দর্শকের। একটা উইকেট পড়ে যাওয়ার পর যখন সতীর্থরা বায়ু রাঘবন (তনুজ বীরওয়ানি) নামের সেই ব্যাটসম্যানকে খুঁজতে শুরু করে, তখন সে স্বর্ণকেশী চিয়ারলিডারের সঙ্গে উত্তেজনার চরম মুহূর্তে। তবে ঠিক সময়মতোই রাঘবন ক্রিজে পৌঁছায় এবং ছক্কা মেরে খোলে রানের খাতা। বেশ মেলোড্রামাটিকভাবে শুরু হওয়া সিরিজে ওই মুহূর্তেই মজে যাবেন দর্শক।

‘ইনসাইড এজ’ দেখতে বসলে দর্শক কখনো কখনো পাবেন আইপিএল ম্যাচ দেখার স্বাদও
আইএমডিবি

সিরিজের গল্প ‘মুম্বাই ম্যাভেরিক্স’ নামে একটি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট দলকে নিয়ে, যারা খেলে পাওয়ার প্লে লিগ (পিপিএল) নামের এক ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি লিগে। কল্পিত লিগ, কল্পিত দল, কিন্তু সিরিজটা দেখতে দেখতে সবার আগে আইপিএলের কথাই মনে পড়বে দর্শকের। কিংবা অন্য কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি লিগের ছবি ভাসবে চোখে।

আরও পড়ুন

‘মুম্বাই ম্যাভেরিক্স’-এর উত্থান-পতনের গল্পটা দেখতে গিয়ে দর্শক পাবেন ক্রিকেটে স্পট ফিক্সিং, স্বার্থের সংঘাত, ষড়যন্ত্র আর জটিল সম্পর্কের খোঁজ। যে গল্পের কেন্দ্রবিন্দু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী বিক্রান্ত ধাওয়ান (বিবেক ওবেরয়)। পিপিএল তার মস্তিষ্কপ্রসূত। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিক্রান্ত সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, অথচ মুখে সব সময় শুদ্ধতার মুখোশ।

বিক্রান্ত ধাওয়ান চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিবেক ওবেরয়
আইএমডিবি

আরেক প্রধান চরিত্র যশবর্ধন পাতিল (আমির বশির), ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান, যাকে সবাই ‘ভাইসাব’ বলে ডাকে। পাতিল আবার বিক্রান্তের বৈমাত্রেয় ভাই, বিক্রান্তের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের আইডিয়া যে নিজের নামে চালিয়ে টাকা ও নাম কামাচ্ছে।
অন্যদিকে মুম্বাই ম্যাভেরিক্সের মালিক জারিনা মালিক (রিচা চাড্ডা) এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিনেত্রী। তারও লক্ষ্য ক্ষমতার এই শীতল খেলায় জেতা। এই দুজনের ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়ে মুম্বাই অধিনায়ক অরবিন্দ ভাসিস্ট (অঙ্গদ বেদি) ও অন্য খেলোয়াড়েরা। ব্যক্তিগত স্বপ্ন সত্যি করতে গিয়ে তারা আটকে যায় বিশ্বাসঘাতকতা ও দুর্নীতির এক গভীর জালে।

আরও পড়ুন

রাঘবনের কথা তো আগেই বলা হলো, তার সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্র হলো প্রশান্ত কানাউজিয়া (সিদ্ধান্ত চতুর্বেদী)। উত্তর প্রদেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা ফাস্ট বোলার। মুম্বাই ম্যাভেরিক্সে যে ছিল মূলত রিজার্ভ খেলোয়াড়। অন্য একজন চোট পাওয়ায় হঠাৎ করে অভিষেক হয় তার। সেই অভিষেকের আগে রোমাঞ্চ আর উত্তেজনায় ফাঁকা স্টেডিয়ামে ফাঁকা উইকেটে বল করার সময় তার নার্ভাস চেহারা আর আত্মবিশ্বাসী হাসিটা পুরো সিরিজেরই মনে দাগ কাটার মতো একটা দৃশ্য। গ্রাম থেকে আসা প্রশান্ত লকার রুমে জ্যেষ্ঠ খেলোয়াড়দের র‍্যাগিংয়ের শিকার হয়, হয় বর্ণবৈষম্যের শিকারও। কিন্তু সব জয় করেই একসময় প্রশান্ত হয়ে ওঠে মুম্বাইয়ের এক নম্বর বোলার।

রিচা চাড্ডা ও ফ্লোরা সাইনি আছেন দুটি গুরুত্বপূর্ন চরিত্রে
আইএমডিবি

আইপিএলেও তো এমন কত স্বপ্নপূরণের গল্প লেখা হয় প্রতি মৌসুমে। ‘ইনসাইড এজ’ বারবার দর্শকদের তাই আইপিএলকেই মনে করিয়ে দেবে। খেলোয়াড়দের হৃদয়ের গভীরে জমে থাকা যন্ত্রণা, কোচের নিঃসঙ্গ সংগ্রাম, অধিনায়কের নৈতিক দ্বন্দ্ব, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বেড়াজালে আটকে পড়া এক নারীর যুদ্ধ, ব্যবসায়িক স্বার্থের কাছে নৈতিকতার পরাজয়, মানসিক স্বাস্থ্যের অদৃশ্য ক্ষত—এই সিরিজ যেন ক্রিকেটের গল্পে আসলে আমাদের সমাজের প্রতিচ্ছবিও। কিছু দৃশ্য দর্শকদের অস্বস্তিতে ফেলতে পারে। ক্রিকেটের গ্ল্যামারাস জগতের আড়ালে যে নোংরামি লুকিয়ে আছে, তা দেখে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এটা কি সত্যিই ভদ্রলোকের খেলা?

আরও পড়ুন

সিরিজের অন্যতম শক্তিশালী দিক হলো এর চিত্রনাট্য। মুঠোফোনে পাওয়া নির্দেশ আর গ্যালারি থেকে আসা ইশারায় কীভাবে হয় স্পট ফিক্সিং, কীভাবে এতে জড়ানো হয় খেলোয়াড়-কোচদের, কীভাবে কখনো কখনো তাঁদের ফেলা হয় ফাঁদে, সেটা দেখানো হয়েছে খুবই বিশ্বাসযোগ্যভাবে। চরিত্রগুলো প্রায় নিখুঁতভাবে তৈরি। রিচা চাড্ডা, বিবেক ওবেরয়, অঙ্গদ বেদি, আমির বশির, সিদ্ধান্ত চতুর্বেদী, তনুজ বীরওয়ানি ও সায়ানী গুপ্তা প্রত্যেকেই যাঁর যাঁর চরিত্রে বেশ ভালো অভিনয় করেছেন। সিনেমাটোগ্রাফি ও সম্পাদনাও প্রশংসনীয়। বিশেষ করে স্টেডিয়ামের দৃশ্যগুলো দর্শকদের অনেকটাই সরাসরি ম্যাচ দেখার স্বাদ দেবে। শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্তগুলো তৈরি করা হয়েছে খুব ভালোভাবে।

‘ইনসাইড এজ’ এ স্বপ্না পাব্বি অভিনয় করেছেন মন্তা চরিত্রে
আইএমডিবি

মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ সিরিজে মুম্বাই অধিনায়ক অরবিন্দ ভাসিস্টের চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন, সেই অঙ্গদ বেদি বিখ্যাত ভারতীয় স্পিনার বিষেন সিং বেদির ছেলে। মুম্বাইয়ের সবচেয়ে বড় তারকা রাঘবনকে দেখানো হয়েছে ভারতের ২৬৯ নম্বর টেস্ট খেলোয়াড় হিসেবে। বাস্তবে ভারতের ২৬৯ নম্বর টেস্ট খেলোয়াড় কে, জানেন তো? বিরাট কোহলি! রাঘবনের চরিত্রের সঙ্গে কোহলির কতটা মিল? সেটা জানতে নাহয় ইনসাইড এজ দেখে ফেলুন।

আরও পড়ুন
‘ইনসাইড এজ’ এ সিদ্ধান্ত চতুর্বেদী
আইএমডিবি

বিখ্যাত বলিউড পরিচালক ফারহান আখতার এ সিরিজের অন্যতম প্রযোজক, সঙ্গে রীতেশ সিদ্ধওয়ানি। এ দুজনের প্রযোজনা সংস্থা এক্সেল এন্টারটেইন্ট এর আগে ‘দিল চাহতা হ্যায়’, ‘ডন’, ‘জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা’, ‘তালাশ’ ও ‘ফুকরে’র মতো বক্স অফিস হিট বলিউড ছবি উপহার দিয়েছে। সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে ‘রক অন’ দিয়ে। ‘ইনসাইড এজ’ও নিরাশ করেনি দর্শকদের। করণ অংশুমান, গুরমিত সিং, আকাশ ভাটিয়া ও কনিষ্ক ভার্মা পরিচালিত এ সিরিজ মনোনীত হয়েছিল ২০১৮ সালে এমি অ্যাওয়ার্ডসে। এখন পর্যন্ত ৩টি সিজন মুক্তি পেয়েছে, প্রতিটি সিজনে ১০টি পর্ব।

ইনসাইড এজ

ধরন: ওয়েব সিরিজ
ভাষা: হিন্দি
পরিচালক: করণ অংশুমান, গুরমিত সিং, আকাশ ভাটিয়া ও কনিষ্ক ভার্মা
অভিনয়: বিবেক ওবেরয়, রিচা চাড্ডা, অঙ্গদ বেদি, আমির বশির, সিদ্ধান্ত চতুর্বেদী, তনুজ বীরওয়ানি, সায়ানী গুপ্তা।
সিজন: ৩টি, মোট পর্ব ৩০।
রানিং টাইম: প্রতি পর্ব ৪৫-৫০ মিনিট
আইএমডিবি রেটিং: ৭.৯/১০

আরও পড়ুন