ইয়র্কারই যাঁর প্রথম শেখা বল, সেই বুমরা তো অমন ইয়র্কার করবেনই
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে মাইক্রোফোন হাতে হার্শা ভোগলে। সামনে ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মা। তাঁকে ‘ফেস’ করতে হলো যশপ্রীত বুমরাকে এবং রোহিত সেটা আনন্দের সঙ্গেই করলেন—কথাটা একটু ভেঙে বলা উচিত।
ভারতের অধিনায়ককে ভোগলের করা প্রথম প্রশ্নটাই ছিল বিশাখাপট্টনম টেস্টে ৯১ রানে ৯ উইকেট নেওয়া ম্যাচসেরা বুমরাকে নিয়ে। মাঠে যাঁর বদৌলতে বিশাখাপট্টনম টেস্ট জিতে সিরিজে ১–১ ব্যবধানে সমতায় ফিরেছে ভারত। ভোগলে প্রশ্ন করলেন, ‘রোহিত, এমন ফর্মে থাকা বুমরাকে দলে পাওয়ার মতো আনন্দ তো আর অন্য কিছুতে হয় না?’ রোহিত সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, সে আমাদের চ্যাম্পিয়ন বোলার। সে অনেকদিন ধরেই দলের জন্য এই দায়িত্ব পালন করছে।’
রোহিতের পর হার্শা ভোগলের সামনে এলেন বিশাখাপট্টনম টেস্টের সেরা খেলোয়াড়। ম্যাচসেরার ১ লাখ রুপি প্রাইজমানির চেকের রেপ্লিকা নেওয়ার পর তাঁর হাত থেকে একবার তা পড়েও গেল। মাঠে ফর্মে থাকা বুমরার ডেলিভারিতে এমন ভুলচুক প্রায় হয়ই না। এই টেস্টে ব্যবধান গড়ে দিয়েছে দুই দলের প্রথম ইনিংস। ইংল্যান্ডকে ২৫৩ রানে শেষ করে দেওয়ায় বড় ভূমিকা বুমরার ৬ উইকেটের। দ্বিতীয় ইনিংসেও নিয়েছেন ৩ উইকেট। তবে ‘হাইলাইট’ অবশ্যই ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে ওলি পোপকে বোল্ড করে দেওয়া ওই ইয়র্কার।
ভোগলে অবশ্য কথার শুরুতে ওসব সিরিয়াস বিষয় টেনে আনেননি। শুরুটা করলেন মজায়। বুমরার এক হাতে ম্যাচসেরার ট্রফি, অন্য হাতে চেকের রেপ্লিকা। ভোগলে একটু হেসে বললেন, ‘আসুন, আসুন বুমরা, আমার মনে হয় মাইক্রোফোন ধরতে আপনার তৃতীয় হাত লাগবে!’ বুমরা কি একটু হাসলেন! ভোগলে এরপর সিরিয়াস প্রশ্নে চলে গেলেন, ‘(টেস্টে) ভারতের মাটিতে ১৩ গড়ে ২৯ উইকেট, বেশির ভাগ বলেন বিদেশে বেশি বেশি উইকেট নিতে, কিন্তু আপনি সম্ভবত ভারতে বোলিং উপভোগ করেন...’
বুমরা একটু হেসে বললেন, ‘আগেও সাক্ষাৎকারে বলেছি, আমি পরিসংখ্যানে তাকাই না। কম বয়সে এটা করেছি, পরিসংখ্যান তখন রোমাঞ্চিত করত। পরিসংখ্যান নিয়ে ভাবলে ভারতের হয়ে খেলাটা চাপ তৈরি করে। আর এই অতিরিক্ত বোঝাটা (পরিসংখ্যান নিয়ে ভাবনা) কোনো কাজেও আসে না। আমি খুব খুশি যে আমরা জিতেছি এবং আর সে জয়ে অবদান রাখতে পারায় আরও ভালো লাগছে।’
ভোগলে এরপর আসল প্রসঙ্গটি পাড়লেন, ‘আপনি জানেন, বিশ্বের আনাচকানাচ এমনকি কিংবদন্তি ওয়াকার ইউনিসও আপনার ইয়র্কারটি নিয়ে কথা বলেছেন। বলুন তো, এমন ইয়র্কার মারতে কতটা কঠিন অনুশীলন করেন?’
বুমরা এই প্রশ্নের উত্তরে ভোগলেকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন তাঁর শৈশবে। উপমহাদেশের ক্রিকেটের সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে কচিকাঁচাদের ক্ষেত্রে যে বলের ক্রিকেট বেশ বড় ভূমিকা রেখেছে, সেই বলের স্মৃতি ফেরালেন বুমরা—টেনিস বল আর সেখানে টেপ প্যাঁচানোর সংস্কৃতিও চালু আছে। তবে বুমরা শুধু টেনিস বলের কথাই বললেন, ‘শৈশবে সম্ভবত এটাই (ইয়র্কার) আমার শেখা প্রথম ডেলিভারি। আমি টেনিস বল ক্রিকেট খেলে উঠে এসেছি। ওয়াকার–ওয়াসিমদের মতো কিংবদন্তিদের দেখেছি, এমনকি জহির খানকেও। টিভিতে তাদের ইয়র্কার মারতে দেখেছি। অল্প বয়সে সেসব ডেলিভারি দেখে মনে হতো উইকেট নেওয়ার এটাই একমাত্র পথ। এটাই আমার শেখা প্রথম ডেলিভারি।’
বুমরা বলে চললেন, ‘আমি এটা (ইয়র্কার) ধরে রেখেছি এবং নিজের শক্তির জায়গা হিসেবে ব্যবহার করি। আর টেস্ট ক্রিকেটে এই ডেলিভারিতে উইকেট পেলে দারুণ লাগে।’ ভোগলে এরপর প্রসঙ্গ পাল্টালেন। সোজাসুজি একটা প্রশ্ন করলেন, ‘নিজেকে কি এখন ভারতের বোলিং আক্রমণের নেতা হিসেবে দেখেন?’ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৮৯ ম্যাচে ৩৭৮ উইকেট নেওয়ার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বুমরা প্রশ্নের উত্তরটা দিলেন বেশ কূটনৈতিক ঢঙে, ‘নেতা নয়, তবে এটা বুঝি যে বেশ ভালোই ক্রিকেট খেলেছি। আমরা পালাবদলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। অনেক নতুন বোলার এসেছে। তাদের পথ দেখানো আমার দায়িত্ব। তাই কোন সময়ে কী করতে হবে, এসব নিয়ে কথা বলতেও দারুণ লাগে।’
ভোগলে এরপর আবার একটু হালকা মেজাজে ফিরে গেলেন। বললেন, ‘ক্রিকেট নিয়ে গভীরভাবে ভাবেন, এমন একটা প্রশংসা প্রচলিত আছে আপনাকে নিয়ে। (বিশাখাপট্টনম টেস্টে) কী কথা হয়েছে রোহিতের সঙ্গে? সে কি আপনার হাতে বল তুলে দিয়ে বলেছে, যশপ্রীত যা খুশি করো।’
বুমরার উত্তরাটা হলো রচনামূলক, ‘কিছু বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে। তার সঙ্গে অনেক দিন ধরে খেলেছি। সেই তরুণ বয়স থেকে সে আমাকে দেখেছে। এখন প্রায় ৩০ বছর (বয়স), টেস্ট খেলছি তার সঙ্গে। তার সঙ্গে আলোচনায় বলেছি আমি কী ভাবছি এবং সে–ও পরামর্শ দিয়েছে কী করা উচিত নয়। এগুলো নিয়েই কথা হয়েছে।’
ভোগলে একটি সম্ভাব্য ছায়া–প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রসঙ্গও টানলেন। টেস্ট ইতিহাসে সবচেয়ে সফল পেসার জিমি অ্যান্ডারসন উঠে এলেন সে প্রশ্নে। বিশাখাপট্টনমে ইংল্যান্ডের হয়ে ৫ উইকেট নেওয়া ৪১ বছর বয়সী অ্যান্ডারসনের সঙ্গে বুমরা প্রচ্ছন্ন কোনো প্রতিযোগিতায় মেতেছিলেন কি না? ভোগলের ভাষায়, ‘প্রতি সকালে অ্যান্ডারসন দারুণ স্পেল করছে, আপনিও কি ভেবেছেন যে আমাকেও এমন কিছু করতে হবে?’
বুমরার উত্তর, ‘না, না। ক্রিকেটার হওয়ার আগে আমি ফাস্ট বোলিংয়ের ভক্ত ছিলাম। অন্য কিছু উপভোগ করিনি। তাই অন্য দলের ফাস্ট বোলারদের বোলিংও উপভোগ করেছি। কিন্তু ব্যাপারটা এমন নয় যে আমাকেও এ রকম কিছু করতে হবে ভেবেছি। অন্য কেউ যদি ভালো করে, সেটা ভালোই।’
ভোগলে শেষ প্রশ্নে একটি দৃশ্যপট রচনা করলেন, ‘ব্যাটসম্যানরা যেমন কোনো শট খেলে মনে মনে ইঙ্গিত পান, আজ হয়তো আমার দিন! তেমনি আপনারও কি বল হাতে নিয়ে কিংবা নির্দিষ্ট কোনো বল করার পর মনে করেন, আজ হয়তো আমার দিন?’ বুমরা বলেছেন, ‘না। আমি ম্যাচের পরিস্থিতিতে তাকাই। কী করতে হবে, সেটা বুঝে নিই। সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করি। কারণ, প্রতিটি উইকেটের জন্যই আলাদা কিছু করতে হয় বলে মনে করি। তাই ভান্ডারে যা কিছু আছে সবকিছু নিয়েই নামতে হয়। নির্দিষ্ট একটি দক্ষতায় কাজ হয় না। ভিন্ন ভিন্ন উইকেটে বুঝে নিই আমি কী করতে পারি এবং সে অনুযায়ী বল করি।’
বুমরার উত্তরে ভোগলেকে বেশ সন্তুষ্টই মনে হলো। কণ্ঠে তৃপ্তি ঝরিয়ে বললেন, ‘কথা শুনে মনে হয়, আপনি খুব ভালো ম্যানেজার। কিন্তু আপনি আসলে অসাধারণ এক বোলার। দারুণ বল করেছেন!’
একটি ইয়র্কারের মতোই এক শব্দে পরিপূর্ণ উত্তর বুমরার, ‘ধন্যবাদ।’